দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে বকেয়া বিদ্যুৎ বিল। বকেয়া আদায়ে প্রায়ই চলছে অভিযান। বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে বিদ্যুতের সংযোগ । তবুও কাঙ্খিত বকেয়া আদায় হচ্ছে না। আগামীতে যাতে প্রতিষ্ঠানগুলো বিদ্যুৎ বিল বকেয়া রাখতে না পারে, সেজন্য বিদ্যুৎ বিতরণকারী সংস্থাগুলো পোস্টপেইড মিটার পরিবর্তন করে প্রি-পেইড মিটার বসাচ্ছে।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, দেশের ছয়টি বিদ্যুৎ বিতরণকারী সংস্থার বিদ্যুৎ বিল বাবদ ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি বকেয়া পাওনা রয়েছে । সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে এ বকেয়া রয়েছে বলে জানা গেছে। মার্চ মাস পর্যন্ত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে বকেয়া রয়েছে ৭ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা।৫৬টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এবং তাদের আওতাধীন বিভিন্ন সংস্থার কাছে বকেয়া বিদ্যুৎ বিলের পরিমাণ ২ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা।

জানা গেছে, সরকার বকেয়া বিদ্যুৎ বিল আদায় ও পরিশোধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। এর ফলে অভ্যন্তরীণ বকেয়া ১,৭২,৭৯৪.৩ মিলিয়ন টাকা এবং বৈদেশিক বকেয়া ১৫২.৬৯ মিলিয়ন ডলার হ্রাস পেয়েছে। বকেয়া বিল আদায়ের জন্য মন্ত্রণালয়ভিত্তিক কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, যার ফলস্বরূপ এর মধ্যে ৮১৩.৫৭০২ কোটি টাকা আদায় করা সম্ভব হয়েছে।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, ‘সকল পর্যায়ে বকেয়া আদায়ে চেষ্টা চলছে। এজন্য অর্থ বিভাগকে বলা হয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বকেয়া পরিশোধ করার জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দিতে।

কর্মকর্তারা বলেন, পুঞ্জীভূত বকেয়া পরিশোধের জন্য ২০২৫-২৬ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে অর্থ বিভাগ যাতে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের জন্য অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ রাখে, সেই সুপারিশ করে চিঠি পাঠানোর প্রক্রিয়ায় রয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

বকেয়া থাকা বিল আদায়ে বিদ্যুৎ সচিব ফারজানা মমতাজ এ বছর দুইবার সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রধানদের কাছে আধাসরকারি পত্র (ডিও লেটার) পাঠিয়েছেন। ওই আধাসরকারি পত্রে তিনি বলেছেন, দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত এ বকেয়ার কারণে সার্বিক বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

ওই পত্রে তিনি আরও বলেন, বিদ্যুৎ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বিদ্যুৎ কিনে গ্রাহককে বিতরণ করে। বিদ্যুৎ বিল বকেয়া থাকার কারণে বিতরণকারী সংস্থাগুলোকে বিদ্যুতের ক্রয়মূল্য পরিশোধের ক্ষেত্রে আর্থিক সংকটে পড়তে হচ্ছে। বিতরণকারী সংস্থাগুলোর আর্থিক সংকট উত্তরণে এবং জাতীয় স্বার্থে গ্রাহকদের সময়মতো বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করা অপরিহার্য।

জানা গেছে, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিপি), বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বাপবিবো), ঢাকা পাওয়ার ডিষ্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি), ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো), ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিষ্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো) ও নর্দার্ন ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো)এই ছয়টি প্রতিষ্ঠান সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনে গ্রাহকদের বিতরণ করে।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে বিপিডিবি পাবে ৪৫৭ কোটি টাকা, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের পাওনা ২৩২ কোটি টাকা। এছাড়া ডিপিডিসি ৭৮৮ কোটি, ডেসকো ৪৩৯ কোটি, ওজোপাডিকো ১৯১ কোটি ও নেসকো ৩৬৭ কোটি টাকা পাবে।

বিপিডিবির চেয়ারম্যান রেজাউল করিম বলেন, বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে বকেয়া পরিশোধে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে চিঠি দেওয়ার পর সংস্থাগুলোর পরিশোধ বাড়ছে। তবে সেটা খুব আশাব্যঞ্জক নয়। ‘নতুন অর্থবছর শুর” হয়েছে, প্রতিষ্ঠানগুলো বিদ্যুৎ বিল বাবদ বরাদ্দ পেয়েছে। আশা করা হচ্ছে সামনে বকেয়া পরিশোধ বাড়বে,’ বলেন তিনি।

সরকারি ও বেসরকারি গ্রাহকদের কাছে বিদ্যুৎ বিতরণকারী কোম্পানিগুলোর সম্মিলিত ১০ হাজার কোটি টাকা পাওনা থাকলেও বিদ্যুৎ কেনা বাবদ কোম্পানিগুলোর নিজেদের দেনা রয়েছে এর চেয়ে বেশি। এতে তাদের আর্থিক সংকটকে আরও ঘনীভূত হচ্ছে।

বিপিডিবির একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বিপিডিবি বিদ্যুৎ বিক্রি বাবদ সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে ১ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। অন্যদিকে গত মার্চ পর্যন্ত বিদ্যুৎ কেনা বাবদ দেশি ও বিদেশি বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাছে বিপিডিবির নিজেরই প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা দেনা রয়েছে। আর নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য গ্যাস কেনা বাবদ দেনা রয়েছে আরও প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। বিদ্যুৎ বিল না পাওয়া এবং সরকার থেকে ভর্তুকির অর্থ সময়মতো না পাওয়ার কারণে বিপিডিপির এই দেনা থেকে যাচ্ছে।

ডেসকোর নির্বাহী পরিচালক মো. কামর”ল ইসলাম বলেন, মোহাম্মদপুরের বিহারী ক্যাম্পে একটি বড় বকেয়া রয়েছেÍপ্রায় ২৪০ কোটি টাকা। এছাড়া অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানে ডেসকোর পাওনা খুব বেশি নয়।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সবচেয়ে বেশি ৯২৪ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ (এলজিডি) ও এই বিভাগের আওতাধীন সংস্থাগুলোর কাছে। সংস্থাগুলোর মধ্যে রয়েছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনা ওয়াসা, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদ।

এলজিডি কর্মকর্তারা বলেন, বেশিরভাগ বকেয়া রয়েছে সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ অফিসগুলোতে। এছাড়া ওয়াসাগুলোতেও উল্লেখযোগ্য বকেয়া রয়েছে। সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভাগুলো সড়কবাতি সেবা দিয়ে থাকে; এসব সড়কবাতির জন্য অনেক বিদ্যুৎ ব্যবহার হয়।

দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৫৭৭ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং এর অধীনস্থ সংস্থাগুলোর। কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ের বকেয়া বিদ্যুৎ বিলের কারণে এই মন্ত্রণালয়ের মোট বকেয়া অনেক বেড়েছে। এ কার্যালয়ের অধীনে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি এবং ভাসানচরের একটি শরনার্থী ক্যাম্প রয়েছে। এসব ক্যাম্পের বিদ্যুৎ বিল সরকার পরিশোধ করে থাকে। মোহাম্মদপুরের বিহারী কাম্পের ২৪০ কোটি টাকা বকেয়াও এ মন্ত্রণালয়ের অধীনে।

এছাড়া প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ২০০ কোটি টাকা, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত বিভাগের ১২৯ কোটি টাকা, জননিরাপত্তা বিভাগের ৮৪ কোটি টাকা, কৃষি মন্ত্রণালয়ের ৭৪ কোটি টাকা এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের ৭০ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে।

আগামীতে যাতে প্রতিষ্ঠানগুলো বিদ্যুৎ বিল বকেয়া রাখতে না পারে, সেজন্য বিদ্যুৎ বিতরণকারী সংস্থাগুলো পোস্টপেইড মিটার পরিবর্তন করে প্রি-পেইড মিটার বসাচ্ছে। ইতিমধ্যে অনেক ক্ষেত্রে এ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানেও এ প্রক্রিয়া শুরু হবে বলে বিদ্যুৎ বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান।

তিনি বলেন, ‘গ্রাহকদের আগে বিদ্যুৎ কিনতে হবে, তারপর ব্যবহার করতে হবে। বিতরণ কোম্পানি বিদ্যুতের দামের জন্য গ্রাহকের পেছনে ঘুরবে না।

জানা গেছে,বিদ্যুতের বিশেষ আইন রহিতকরনের পর একটি বিশেষজ্ঞ ও একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে, একমিটি ভবিষ্যতে আরও কার্যকর ও স্বচ্ছ চুক্তি সম্পাদনে সহায়ক হবে বলে জানা গেছে। পাশাপাশি, বিদ্যুৎ খাতের দক্ষতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে একটি সার্বিক সংস্কার কমিটিও গঠন করা হয়। এই কমিটি ‘পলিসি ফর এনহ্যান্সমেন্ট অব প্রাইভেট পার্টিসিপেশন ইন দ্য পাওয়ার সেক্টর, ২০২৫’ নামে একটি খসড়া নীতি তৈরি করেছে, যা বর্তমানে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতামতের জন্য উন্মুক্ত রয়েছে। এই দুটি পদক্ষেপই বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে সরকারের সামগ্রিক সংস্কারের চিত্র তুলে ধরে।

জানা গেছে, সরকারের আর্থিক সাশ্রয় ও বিদ্যুৎ খাতের স্বনির্ভরতা নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ভর্তুকি ব্যবস্থাপনা এবং ব্যয় সাশ্রয়ের ওপর বিশেষ জোর দিয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভর্তুকির চাহিদা ৪৭ হাজার কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ৩৭ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা দেশের অন্যান্য উৎপাদনশীল খাতে ব্যবহারের সুযোগ তৈরি করবে।