আমরা চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়িয়ে এটিকে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম বন্দর হিসেবে গড়ে তুলতে চাই, যাতে শুধু বাংলাদেশ নয়, আশপাশের দেশগুলোরও ৪০ কোটি মানুষ উপকৃত হতে পারে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে নগরীর একটি হোটেলে ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও সুশীল সমাজের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় তিনি এসব কথা বলেন।

সরকারের উদ্যোগ নিয়ে নানা বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘অনেকে বলছেন চাকরি চলে যাবে, কিন্তু বাস্তবে চাকরির সংখ্যা দশগুণ বাড়বে। অনেকে বলছেন দেশের স্বার্থহানি হবে, কিন্তু সেটা হবে না।”

তিনি বলেন,“চট্টগ্রাম বন্দরকে কেন্দ্র করে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের স্বপ্ন এবং মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে প্রতি বছর বাংলাদেশে মাল্টিবিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ আসবে। হয়তো আমরা (বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার) থাকব না, অন্য সরকার এসে এর সুফল ভোগ করবে, কিন্তু দেশের জন্য আমরা ভিত্তি তৈরি করছি।’’

শফিকুল আলম বলেন, ‘‘বাংলাদেশে ড. ইউনূসের মতো প্রো-বিজনেস মনোভাবাপন্ন নেতা আর আসেননি। আমরা যখন ডাভোসে গিয়েছিলাম, তিনি একদিনে ৩৬টি মিটিং করেছেন, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শুধুই বাংলাদেশে বিনিয়োগ আনার কৌশল নিয়ে কথা বলেছেন। নিউইয়র্ক সফরেও তিনি চার দিনে ৫১টি বৈঠক করেছেন। তার মূল লক্ষ্য হলো বাংলাদেশে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ আনা এবং দ্রুত কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা।’’

চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি না হলে বড় বিনিয়োগ আসবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘ড. ইউনূসের অন্তত দুই ডজন বৈঠকে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম বন্দরের দক্ষতা ও কার্যকারিতা বাড়াতে হবে। এখন কোনো অর্ডারের ডেলিভারিতে যেখানে ৩০-৪০ দিন লাগে, সেটি ৭-১০ দিনের মধ্যে আনতে হবে। না হলে বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীরা আসবে না।’’

চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য সরকারের বড় ধরনের মহাপরিকল্পনা রয়েছে জানিয়ে শফিকুল আলম বলেন, ‘‘বিশ্বের শীর্ষ পোর্ট অপারেটরদের সঙ্গে চুক্তি করে বন্দরের দক্ষতা বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে, যাতে আমরা সবাই উপকৃত হই এবং বড় বিনিয়োগ আসে।’’ তিনি আশা প্রকাশ করেন, পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে প্রতি বছর বাংলাদেশে বর্তমানের চেয়ে ১০-১৫ গুণ বেশি বিনিয়োগ আসবে।

বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী জানিয়েছেন, দেশের বিনিয়োগ সম্ভাবনা অনেক, তবে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত সুবিধার অভাবে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ দ্রুত বাস্তবে রূপ নিচ্ছে না।

একটি আলোচনায় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা তাদের সমস্যার কথা তুলে ধরলে আশিক চৌধুরী বলেন, “বাংলাদেশে যারা ব্যবসা করেন, তারা নানা চ্যালেঞ্জের মুখে ব্যবসা চালাচ্ছেন। আমরা সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করছি। তবে দুঃখজনকভাবে, গ্যাস সরবরাহ বড় একটি সমস্যা। শিল্পে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানোর পরিকল্পনা নেওয়া হলেও, এটিই যথেষ্ট নয়; আরও অনেক পদক্ষেপ নিতে হবে।”

তিনি জানান, সম্প্রতি চীনা বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে তার বৈঠক হয়েছে, যারা ছয় থেকে বারো মাসের মধ্যে কারখানা চালু করতে চান। কিন্তু বিদ্যুৎ, গ্যাস, রাস্তা—এই গুরুত্বপূর্ণ সুবিধাগুলো দ্রুত নিশ্চিত করার সুযোগ বিডার হাতে নেই। আশিক বলেন, “আমাদের কাছে বিনিয়োগকারীরা প্রস্তুত, কিন্তু আমরা এখনও সেই প্রস্তুতি নিতে পারিনি। যত দ্রুত সম্ভব এই সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠতে হবে।”

প্রধান অতিথির বক্তব্যে আশিক চৌধুরী জানান, শুধু চট্টগ্রাম বন্দর কেন্দ্রিক আগামী তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে অন্তত তিন বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ আসবে। তিনি বলেন, “লালদিয়ার চরে প্রায় ৬০০ থেকে ৮০০ মিলিয়ন ডলারের এফডিআই সম্ভাবনা আছে। বে-টার্মিনালে দুইটি অপারেটর এক বিলিয়ন ডলার করে বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছে। এনসিটিতেও ২০০ মিলিয়ন ডলারের কথাবার্তা চলছে। আমরা তিন বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগের কথা বলছি, অথচ বর্তমানে দেশে বছরে মোট এফডিআই মাত্র ৭০০-৮০০ মিলিয়ন ডলারের মতো।”

তিনি কর্মসংস্থানের দিকটি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে তুলে ধরে বলেন, “শুধু বে-টার্মিনালেই ২৫ হাজার কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে। আগামী সরকারসহ প্রতিটি সরকারের সবচেয়ে বড় এজেন্ডা হওয়া উচিত কর্মসংস্থান। পোর্টগুলোকে দক্ষভাবে পরিচালনা করতে পারলে আমাদের ট্রেড ও কর্মসংস্থান দুটোই বাড়বে।”

চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “শ্রীলঙ্কার সাতটি পোর্টের হ্যান্ডলিং ক্ষমতা ৭.৭৮ মিলিয়ন টিইইউস, আর আমাদের মাত্র ১.৩ মিলিয়ন টিইইউস। ভিয়েতনামে ৪৪টি পোর্টের ক্ষমতা ৪৭ মিলিয়ন টিইইউস। আমরা যদি ভিয়েতনামের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে চাই, তাহলে আমাদের অনেক এগোতে হবে।”

আশিক চৌধুরী আরও বলেন, “ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের কন্টেইনার পোর্ট পারফরম্যান্স ইনডেক্সে চট্টগ্রাম বন্দরের র‌্যাংকিং ৩৩৯। সেরা ১০০ পোর্টের মধ্যে ৯৭টি বেসরকারি পরিচালিত, মাত্র তিনটি সরকারি। তাই আমাদের সেরা পরিচালিত পোর্ট গড়ে তুলতে হবে।”

তিনি জানান, চট্টগ্রামে চীনা ইকোনমিক জোন, আনোয়ারায় কোরিয়ান ইপিজেড এবং মীরসরাইতে ন্যাশনাল ইকোনমিক জোনকে ঘিরেই দেশের দীর্ঘমেয়াদি শিল্পায়ন পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, “দুদিন আগে ফ্রি ট্রেড জোনের জন্য জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে, যেসব স্থান প্রাথমিকভাবে বিবেচনায় এসেছে, সেগুলোও চট্টগ্রামে। সুতরাং উৎপাদন, এক্সপোর্ট ও ইম্পোর্ট—সবকিছুতেই চট্টগ্রামই কেন্দ্রবিন্দু হবে।” মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান। এরআগে তারা সকালে পতেঙ্গার লালদিয়ারচর ও বে-টার্মিনাল এলাকা পরিদর্শন করেন।