রাজধানীর কুড়িল এলাকায় রেললাইনে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণচূড়া ফুলের ছবি তোলার সময় ইশতিয়াক আহমেদ নামে এক ফটোগ্রাফারের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। গেলো ২ মে বিকালের দিকে এ ঘটনা ঘটে। ছবি তোলার সময় দ্রুতগতির একটি ট্রেন চলে আসায় ঘটনাস্থলে কাটা পড়ে মারা যান তিনি।
তার দুর্ঘটনার বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিও আকারে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওতে দেখা যায়, ক্যামেরা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় ট্রেন আসার বিষয়টি খেয়াল করতে পারেননি ইশতিয়াক। দ্রুতগতির ট্রেনটি তাকে চাপা দেয়। ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি।
জানা গেছে, ইশতিয়াক রাজশাহী কলেজের বাংলা বিভাগের ছাত্র ও সৌখিন ফটোগ্রাফার ছিলেন। ইশতিয়াক আহমেদের মৃত্যুর পর সামাজিকমাধ্যম ফেসবুকে এ নিয়ে সমবেদনা জানান তার ফটোগ্রাফির ভক্তরা। ইশতিয়াক অসাধারণ ছবি তুলতেন। তার ছবিতে মুগ্ধ হতেন ছবিপ্রেমীরা। সেই ছবি তুলতে গিয়েই আজ প্রাণ হারালেন ইশতিয়াক।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে শুধু ইশতিয়াকই নয় রেললাইন থেকে প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ৮৫টি লাশ উদ্ধার করা হয়। ট্রেনে কাটা পড়ে এসব মৃত্যুর সংখ্যা বেশি বলে জানা গেছে। এসব মৃত্যুর কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখা গেছে, অনেকে মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে রেললাইন দিয়ে হাঁটার সময় ট্রেনের নিচে পড়েছে, কেউ সেলফি তুলতে গিয়ে কেউ বা রেললাইনে বসে আড্ডা দেওয়ার সময় বা অন্য কোনো কাজে ব্যস্ত থাকা অবস্থায় দুর্ঘটনা ঘটেছে। অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ের জন্য চলন্ত ট্রেনের সামনে দিয়ে তাড়াহুড়া করে রেললাইন পার হতে গিয়েও মারা গেছে অনেকে। এ ছাড়া রেললাইনে মৃত্যুর ঘটনার একটি বড় অংশের কারণ চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। এসব মৃত্যুর কারণ দুর্ঘটনা নাকি হত্যা, তা স্পষ্ট না হওয়ায় অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে রেললাইন থেকে চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি) রেললাইন থেকে ১৬৮টি লাশ উদ্ধার করা হয়। এছাড়া ২০২৪ সালে এক হাজার ১৭টি লাশ উদ্ধার করেছে রেলওয়ে পুলিশ। সেই হিসাবে রেললাইন থেকে প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ৮৫টি লাশ উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে ৭৯৪ জন পুরুষ এবং ২২৩ জন নারী। এসব লাশ উদ্ধারের ঘটনায় ৯৯৮টি অপমৃত্যুর মামলা করা হয়েছে।
এর মধ্যে তদন্ত শেষে ছয়টি মামলা খুনের মামলায় রূপান্তরিত হয়। রেলওয়ে পুলিশের সদর দপ্তর থেকে পাওয়া ডাটা বিশ্লেষণে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
রেলওয়ে পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৫০৪ জন, অর্থাৎ ৫০ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে রেললাইনে বসে থাকা ও চলতে থাকা অবস্থায় চলন্ত ট্রেনে কাটা পড়ে। অসতর্কভাবে লেভেলক্রসিং পার হওয়ার সময় মৃত্যু ২৭২ জনের, যা ২৭ শতাংশ।
অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দেশের রেলপথের অনেক লেভেলক্রসিং অরক্ষিত থাকাটা রেললাইনে মৃত্যুর অন্যতম কারণ।
রেলওয়ে পুুলিশের তথ্য বিশ্লেষণে আরো দেখা গেছে, গত বছর ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে ২৩ জন, ইয়ারফোন লাগিয়ে রেললাইনে চলাচল করতে থাকা অবস্থায় ও অন্যান্য কারণে ট্রেনের শব্দ শুনতে না পাওয়ায় ৭৬ জন এবং স্বাভাবিক, অসুস্থতাজনিত, বার্ধক্যজনিত, আত্মহত্যা ও মানসিক প্রতিবন্ধিতার কারণে ১৪২ জনের মৃত্যু হয়।
রেলওয়ে পুলিশের সূত্র বলছে, যেসব কারণে রেললাইনে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ট্রেনের ছাদে ভ্রমণ, সেলফি তুলতে গিয়ে ট্রেনের ধাক্কা লাগা বা কাটা পড়া, চলন্ত ট্রেনে ওঠানামা করতে গিয়ে ভারসাম্য হারানো, কানে হেডফোন বা ইয়ারফোন লাগিয়ে রেললাইন দিয়ে হাঁটা, ট্রেনের দরজার হাতলে ঝুলে যাতায়াত, রেললাইনে বসে থাকা, অসতর্কভাবে রেললাইন পার হওয়া এবং দুই বগির সংযোগস্থল বাফারে বসা।
কর্মকর্তারা বলছেন, প্রকৃত ঘটনা আড়াল করতে অনেক সময় সুযোগ বুঝে অপরাধীরাও রেললাইনে লাশ ফেলে যায়। অনেক ক্ষেত্রে এসব লাশ দেখে বোঝা যায় না দুর্ঘটনা না হত্যা। ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু বলে ধরে নিলে সে ক্ষেত্রে দুর্ঘটনার তদন্ত হবে, হত্যাকান্ডের নয়। এতে পার পেয়ে যাবে অপরাধী। তবে হত্যাকান্ড বলে সন্দেহ হলে সে ক্ষেত্রে তদন্তের মাধ্যমে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।
রেলওয়ে পুলিশের তথ্য বলছে, ২০১৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে রেললাইন থেকে পাঁচ হাজার ৩৬২ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে ৮১ জন হত্যাকান্ডের শিকার বলে তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। পরে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হয় বলে জানা গেছে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে ২০১৮ সালে রেললাইনে মোট লাশ উদ্ধার করা হয় এক হাজার দুই জনের। এরপর ২০১৯ সালে ৯৮০ জনের, ২০২০ সালে ৭১৩ জনের, ২০২১ সালে ৭৭৮ জনের এবং ২০২২ সালে এক হাজার ৫০ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। সবশেষ ২০২৩ সালে রেললাইন থেকে এক হাজার ৬৪ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। সবমিলিয়ে এই ৬ বছরে রেললাইন থেকে লাশ উদ্ধার হয়েছে ৫ হাজার ৫৮৭ জনের। সেই হিসেবে গড়ে রেললাইন থেকে মাসে ৭৮ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়।
উদ্ধার হওয়া লাশের মধ্যে চার হাজার ২৮৪ জন পুরুষ ও এক হাজার ৩০৩ জন নারী। পেশার দিক থেকে ৩৭৭ জন শিক্ষার্থী, দুই হাজার ৬১২ জন শ্রমজীবী ও ৪৫০ জন চাকরিজীবীর লাশ উদ্ধার হয়েছে। বাকি দুই হাজার ১৪৮ জনের পেশা সম্পর্কে জানা যায়নি। এ ছাড়া উদ্ধার হওয়া লাশের মধ্যে ৪৫৩ জনের বয়স ১৮ বছরের নিচে। ১৯ থেকে ৫০ বছর বয়সের মধ্যে তিন হাজার ৬৪৯ জন। পঞ্চাশের বেশি বয়স এক হাজার ৪৮৫ জনের।
রেলওয়ে পুলিশের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, রেললাইন থেকে লাশ উদ্ধারের পর প্রথমে আলামত বিশ্লেষণ করে কী কারণে মৃত্যু হয়েছে, সেটা জানার চেষ্টা করা হয়। একই সঙ্গে পর্যায়ক্রমে জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। রেলওয়ে পুলিশ সম্প্রতি মাদকদ্রব্য উদ্ধারেও সাফল্য অর্জন করছে বলে জানান তিনি।
ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক বলেন, কিছু ক্ষেত্রে খুনের পর অপরাধের দায় এড়াতে লাশ রেললাইনে ফেলে রাখছে দুর্বৃত্তরা। তাদের মূল উদ্দেশ্য খুনের ঘটনাকে দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়া। এ ছাড়া কানে হেডফোন লাগিয়ে রেললাইনে হাঁটাহাঁটি করা বা রেললাইনে বসে গল্পগুজবে মশগুল থাকায় অনেকে ট্রেন দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। এসব বিষয়ে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী ও রেল পুলিশ যৌথভাবে সচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করতে পারে। তবে জনগণকে আরো সচেতন হতে হবে।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মো. সালাউদ্দিন জানান, সামাজিক ও পারিবারিক সংকটের কারণে অনেক মানুষের মধ্যে একধরনের হতাশা কাজ করছে। এসব হতাশা থেকে মানুষ অবচেতন মনে চলাফেরা করে। সেসব মানুষের কেউ যদি রেললাইন দিয়ে চলাচলের সময় অসতর্কতার কারণে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন। তাড়া থাকার কারণে বা অন্য কোনো শব্দে ট্রেন আসার বিষয়টি খেয়াল করতে পারে না। এভাবে কিছু ঘটনা ঘটেছে। কাজেই রেললাইনের আশপাশে থাকলে কানের ওপর ভরসা না করে চোখের ওপর ভরসা করাই ভালো।