চব্বিশের জুলাই-আগস্টের গণঅভুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা জনরোষের ভয়ে এলাকাছাড়া। আর যারা আছেন, তারাও কোনঠাসা অবস্থাসহ পলাতক জীবন যাপন করছেন। তাদের মধ্যে অধিক সংখ্যক নেতাকর্মী নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় উঠে এসেছেন রাজধানী ঢাকায়। আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এসব নেতাকর্মী এখন রাজধানীতে দলীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে তৎপর। ক্ষমতাচ্যুতির পর নিষিদ্ধ হয়ে সংগঠনটির নেতাকর্মীরা ঢাকাসহ একাধিক নগর মহানগরে ‘ঝটিকা মিছিল’ নামক কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। পুলিশসহ আইনশৃংখলাবাহিনীর সদস্য ও গোয়েন্দারাও বেশ তৎপর রয়েছেন ‘নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ’ এর সকল অপতৎপরতা রোধে। এ যাবত শুধুমাত্র রাজধানীতেই অভিযান চালিয়ে ২৬০০ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশসহ গোয়েন্দারা। শিগগিরই তাদের এই তৎপরতা বন্ধ হয়ে যাবে বলে আশাবাদী পুলিশ।
গেল মে মাসে আওয়ামী লীগ ও তার বিভিন্ন সংগঠনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হলেও দলটির নেতাকর্মীরা ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে মাঝেমধ্যে ঝটিকা মিছিল করে আসছে। এসব মিছিল থেকে নেতাকর্মীরা ধরাও পড়ছে।
জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা) মো: শফিকুল ইসলাম বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জড়ো হয়ে ঝটিকা মিছিল করছে, আমরাও তাদেরকে শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনছি। সন্ত্রাস দমন আইনে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে। নিষিদ্ধ সংগঠন কোন কার্যক্রম চালাতে পারবে না বলে যে আইন আছে, সেটা তাদের মানাতে চেষ্টা করছি। আমরা বসে নেই, কাজ করছি উল্লেখ করে ডিএমপির গোয়েন্দা প্রধান আশা প্রকাশ করে বলেন, শিগগিরই তাদের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে।
জানতে চাইলে ডিএমপির মিডিয়া শাখার উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো: তালেবুর রহমান বৃহস্পতিবার দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, গত জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ঝটিকা মিছিল করার কারনে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগসহ এর অঙ্গ সংগঠনের ২৬০০ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে অনেকেই জামিনে বের হয়ে এসে পরবর্তীতে কোন কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছে কিনা, তা শনাক্ত করা হচ্ছে। গোয়েন্দা নজরদারী চলছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
জানা গেছে, বিভিন্ন পেশার আড়ালে রাজধানীতে অবস্থান করছে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতা কর্মীরা। তারা ব্যাটারি চালিত অটোরিক্সা, ভাড়ায় মটরসাইকেল চালক, উবার ও পাঠাও চালকের বেশ ধরেছে। এছাড়া অনেকেই দলীয় পরিচয় গোপন করে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়েছে। বিশেষ করে গার্মেন্ট সেক্টরেই বেশি। গত কয়েকমাস ধরে ঢাকায় গ্রেফতার হওয়া আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বেশিরভাগই ঢাকার বাইরে থেকে এসে অবস্থান করছে বলে তদন্তে উঠে এসেছে। এমন পরিস্থিতিতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা ইউনিট ও ৮টি ক্রাইমজোনকে আরো নজরদারী বাড়ানোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
জানা গেছে, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দলের নেতাকর্মীরা নিজ এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। এরপর কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়ার পর তারা আত্মগোপনে চলে যায়। সম্প্রতি ঢাকায় বিভিন্নস্থানে ঝটিকা মিছিলে দেশের বিভিন্ন জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের ছবি ভাইরাল হওয়ার পর তাদের পরিচয় প্রকাশ করে সাধারণ মানুষ। এরপর নড়েচড়ে বসেন গোয়েন্দারা। ধারাবাহিক অভিযানে গ্রেফতার হচ্ছেন অনেকে। যাদের বেশিরভাগই ঢাকার বাইরের নেতাকর্মী।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি গ্রেফতার হওয়া অনেকেই ঢাকার বাইরের নেতাকর্মী। তারা বিভিন্ন পেশার আড়ালে ঢাকায় অবস্থান করছেন। এরপর কোথাও মিছিল হলেই সেখানে যোগ নিয়ে নাশকতার চেষ্টা চালাচ্ছে। এমনকি তারা নামায আদায় করে ফেরার সময়ও সংঘবদ্ধ হয়ে মিছিল করে সরকার বিরোধী কর্মকান্ডে যুক্ত হচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে গোয়েন্দা পুলিশের সব ইউনিটকে নজরদারী বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, দেশের বাইরে অবস্থান করা আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা এসব মিছিল অর্গানাইজড করছেন। সেখান থেকে অর্থায়নও করছেন। এরপর অনলাইনে বিভিন্নগ্রুপে ঝটিকা মিছিলের সময় ও স্থান নির্ধারণ করে দেওয়া হচ্ছে। মিছিলের শুরুতে ৪/৫ জনের উপস্থিতি দেখা গেলেও মুহূর্তেই তা ২০/৩০ জনে রুপ নিচ্ছে। সম্প্রতি গ্রেপ্তার হওয়া অনেককে রিমান্ডে এসে জিজ্ঞাসাবাদ করে বিভিন্ন জেলা, উপজেলা, ও মহানগরের মাঝের সারির নেতাকর্মীদের অবস্থানের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। রাজধানী ছাড়াও সাভার, আশুলিয়া, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও কোরানীগঞ্জের বিভিন্নস্থানে অবস্থান করছেও বলে তদন্তে তথ্য পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, অন্তর্বর্তী সরকার গত ১০ মে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকালে হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় বিচার না হওয়া পর্যন্ত সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে। এর আগে গত বছরের অক্টোবরে নিষিদ্ধ করা হয় আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগকে। এরপর থেকে থেমে থেমে ঝটিকা মিছিলের তথ্য পাওয়া গেলেও সম্প্রতি এর সংখ্যা বেড়ে গেছে। এর ধারাবাহিকতায় গত ২১ অক্টোবর রাজধানীর ১১স্থানে মিছিল বের করে নিষিদ্ধ দলটির অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। ওই মিছিল থেকে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটে। এসব মিছিল থেকে পুলিশ ১৩১জনকে গ্রেপ্তার করে।
পুলিশ জানায়, গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে কক্সবাজার জেলার ডুলহাজারা ইউনিয়নের ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি এখলাস মিয়া, খাগড়াছড়ি জেলার মহালছড়ি থানার ছাত্রলীগের সভাপতি মোঃ জিয়াউর রহমান, আওয়ামী লীগের সক্রিয় কর্মী ও রাজধানীতে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন মিছিল মিটিং এর অংশগ্রহণকারী সাইফুল ইসলাম, মাদারীপুর জেলার সদর উপজেলার যুবলীগের সাবেক আহ্বায়ক জুয়েল আহাম্মেদ রনি, একই উপজেলার মো. রিয়াজ উদ্দিন ও বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মোঃ আক্তার হোসেন রয়েছেন। বাকী সদস্যরা বিভিন্ন জেলা উপজেলার নানা পদে রয়েছেন।
সূত্র জানায়, দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে আসা নেতাকর্মীদের বেশিরভাগ বিভিন্ন আবাসিক হোটেলে অবস্থান করছেন। এর সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে যাবে। এলাকা থেকে নানা অপকর্মের কারণে তারা বিতাড়িত হয়ে নাম-পরিচয় গোপন রেখে হোটেল ও মেসে অবস্থান করার তথ্য রয়েছে। এদের অনেকের নামে মামলাও রয়েছে। সেখানে বসে তারা নিজ এলাকার নেতা-কর্মীদের নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। তবে একটি হোটেলে তারা ৩ থেকে ৪ দিনের বেশি অবস্থান করেন না। রুম ভাড়া নেওয়ার ক্ষেত্রে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা চিকিৎসা ও ব্যবসাসহ নানা প্রয়োজনিয়তার কথা উল্লেখ করেন। আগেরমত থানা পুলিশের নজরদারী না থাকার কারণে হোটেলে অবস্থান করার ক্ষেত্রে তাদের কোন বাধার মুখোমুখি হতে হচ্ছে না বলে অভিযোগে প্রকাশ।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীতে পুলিশের তালিকায় প্রায় ১২শ’ হোটেল রয়েছে। এরমধ্যে বেশিরভাগ হোটেলের অবস্থান টার্মিনাল কেন্দ্রিক। এছাড়াও হাসপাতাল ও বিভিন্ন মার্কেট কেন্দ্রিকও অনেক আবাসিক হোটেল রয়েছে। তবে এসব হোটেলের কোন নিবন্ধন ঢাকা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে নেই। এমনকি ওই প্রতিষ্ঠানগুলো আবাসিক হোটেল ও রোস্তারাঁ ব্যবসায়ি কোন সংগঠনের সদস্যও না। ওইসব হোটেলে স্থানীয় থানা পুলিশের কোন নজরদারীও নেই। এই সুযোগে হোটেলগুলোতে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের বিভিন্নস্তরের নেতাকর্মীরা অবস্থান করছেন। সেখানে বসে তারা মোবাইল ফোনে মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের দিক নির্দেশনা দিচ্ছেন। রাত হলেই ওইসব হোটেলে নেতাকর্মীদের নিয়ে আড্ডায়ও বসেন অনেকে। সেখানে থেকে পরবর্তী দিনের কার্যক্রম বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়। বেশিরভাগ হোটেলই থ্রীস্টার মানের।
সূত্র জানায়, হোটেলে বসে অনেক নেতা ‘পকেট ওয়াফাই রাউটার’ ব্যবহার করেন। এ কারণে তাদের অবস্থান শনাক্ত করতে বেগ পেতে হচ্ছে। পাশাপাশি স্থানীয় থানা পুলিশের পর্যন্ত লোকবল ও যানবাহন সংকটের কারণে হোটেলগুলোতে নজরদারী চালানো সম্ভব হচ্ছে না। সূত্র মতে, সাধারণত ওইসব নেতাকর্মীরা ঢাকায় তাদের আত্বিয়স্বজদের বাসায় এসে উঠলেও সেখানে অবস্থার বেগতিক দেখলে তারা আবাসিক হোটেলে থাকছেন । আবার অনেকে এক হোটেলে দুই দিনের বেশি অবস্থান করেন না। ঘুরেফিরে বিভিন্ন হোটেলে অবস্থান করছেন। ওইসব নেতারা এলাকায় নানা ধরনের অপকর্মে যুক্ত ছিলো। এখন ঢাকায় এসে আত্মগোপনে।
ঝটিকা মিছিলের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান : কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা থাকা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ মিছিল করেছন। সর্বশেষ ২১ অক্টোবর মঙ্গলবার সকাল ১০টা থেকে সাড়ে ১১টার মধ্যে বের করা এসব মিছিল থেকে ১৩১ জনকে গ্রেফতার করার কথা জানিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ।
ডিএমপি সূত্রে জানানো হয়, তাদের মধ্যে ছজনকে গ্রেপ্তার করেছে উত্তর পূর্ব থানা, দু’জনকে উত্তরা পশ্চিম থানা, ২৪ জনকে গুলশান থানা, চারজনকে খিলক্ষেত থানা, তিনজনকে ক্যান্টনমেন্ট থানা, ছয়জনকে ধানমন্ডি থানা, ছয়জনকে নিউ মার্কেট থানা, তিনজনকে শাহবাগ থানা, আটজনকে মোহাম্মদপুর থানা, একজনকে হাতিরঝিল থানা, ছয়জনকে পল্টন থানা, ৪০ জনকে মতিঝিল থানা ও ডিবি-ওয়ারীর হাতে ২২ জন ধরা পড়েছেন।
এর আগে গত ২৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীর বিভিন্ন স্থানের ঝটিকা মিছিল থেকে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ২৪৪ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। পুলিশী তৎপরতার বড় খবর সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে এই দুটিই। একসাথে এতো সংখ্যক নেতাকর্মী বিগত দিনগুলোতে ধরা পড়েনি।
এর আগের দিন ২০ অক্টোবর রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ৭ নেতাকর্মী গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। এর আগেরদিন ১৯ অক্টোবর ৪ জনকে ধরে ডিবি পুলিশ।
ডিএমপির মিডিয়া শাখা সূত্র জানায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এ যাবৎ নিষিদ্ধ সংগঠনের ২৬০০ নেতাকর্মীকে ধরা হয়েছে ঝটিকা মিছিলসহ নানা ধরনের অপতৎপরতার অভিযোগে। গত দু’সপ্তাহ ধরে নিষিদ্ধ কার্যক্রম বন্ধে অভিযান জোরদার করা হয়েছে।