অথর্ব নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেছেন জুলাই অভূত্থানের নায়করা। গতকাল সোমবার শহীদ মিনারে ইনকিলাব মঞ্চ কর্তৃক আয়োজিত ওসমান হাদীকে হত্যাচেষ্টার সর্বদলীয় প্রতিরোধ সমাবেশে তারা এ কথা বলেন। এসময় উপস্থিত হাজারো ছাত্র-জনতা হামলায় জড়িতদের প্রতিরোধের শপথ নিয়ে বলেছেন, এদের আর ছাড় নয়।
এর আগে বিকেল ৩টায় ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান হাদীর ওপর গুলীর প্রতিবাদে এ সমাবেশ শুরু হয়। সমাবেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা অংশ নিয়েছেন। গান ও কবিতা আবৃত্তির মাধ্যমে হামলার প্রতিবাদ এবং সহিংসতার বিরুদ্ধে অবস্থান তুলে ধরা হয়। নেতাকর্মীদের অনেকেই হাতে ব্যানার ও ফেস্টুন নিয়ে শরীফ ওসমান হাদীর ওপর হামলার ঘটনার নিন্দা জানান এবং দোষীদের বিচারের দাবি তোলেন।
সমাবেশে যোগ দিয়ে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ইনকিলাব মঞ্চের নেতা ওসমান হাদীকে গুলীর ঘটনায় ‘ইন্টেলিজেন্স ফেইলিয়র’ রয়েছে। এই ব্যর্থতার জন্য বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে জবাবদিহি করতে হবে। তিনি বলেন, হাদীর ওপর আক্রমণের আগে থেকেই সে বলছিল, ‘আমি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি’। কথাগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় ইন্টেলিজেন্সের সবাই জানার পরও তার নিরাপত্তায় গোয়েন্দা সংস্থা কী ব্যবস্থা নিয়েছে? এই ইন্টেলিজেন্স ফেইলিয়রের জন্য সরকারকে জবাব দিতে হবে।
তিনি বলেন, হাদীর ওপর হামলা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এটা একটা প্যাকেজ প্রোগ্রাম। আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে গত রোববার বলেছি, ডিজিএফআই, ডিবি, এসবি, এনএসআই হাজার হাজার কোটি টাকা বেতন নেয়। স্বাধীনতার ৫৪ বছরে আপনারা জনগণের নিরাপত্তায় একটি গোয়েন্দা তথ্য দিয়েও সহায়তা করতে পারেননি।
প্রধান উপদেষ্টার উদ্দেশে দেশের বৃহত্তর দলের এই নেতা বলেন, আপনি দায়িত্ব নেওয়ার পর অনেকগুলো হত্যাকাণ্ড ঘটলো। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে যারা ছিলাম তাদের ওপর আক্রমণ হলো। আপনি বারবার জাতীয় ঐক্য অটুট রাখতে বলেন, সেটা তো আমরা করছি। আমরা ঐক্যবদ্ধ, কিন্তু আপনার সরকার ফ্যাসিবাদের অস্ত্রধারীদের গ্রেফতার করতে ব্যর্থ হয়েছে। ভারতীয় আধিপত্যবাদের সমালোচনা করে গোলাম পরওয়ার বলেন, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামী শেখ হাসিনাকে যারা আশ্রয় দিয়েছে, হাদীর ওপর গুলী করা ব্যক্তিকে যারা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে, তারা বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে দেবে না। কিন্তু নির্বাচন বানচাল করে এদেশকে ভারতের কলোনি বানাতে দিতে আমরা রাজি নই। তিনি বলেন, টকশোতে সুশীলরা, বুদ্ধিজীবীরা করপোরেট হাউজে বসে যে ন্যারেটিভ হাদীর দিকে টার্গেট করলেন, সেই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এ জনসভা। আজ গোটা জাতি প্রতিরোধের আওয়াজ তুলেছে।
সমাবেশে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, আজ আমরা এখানে একটি বার্তা দেওয়ার জন্য সমবেত হয়েছি। সেটা হলো, বাংলাদেশ ও জুলাই বিপ্লবীরা ঐক্যবদ্ধ। ওসমান হাদীর শরীরে গুলী লাগার মাধ্যমে জুলাই বিপ্লব আক্রান্ত হয়েছে। বাংলাদেশ যতবার আক্রান্ত হয়, তরুণরা ততবার নেমে আসে। তিনি আরও বলেন, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবি উঠেছে। আমরা মনে করি নৈতিকভাবে উনি আর এই দায়িত্বে থাকতে পারেন না। ৫ আগস্টের পর জুলাই বিপ্লবীদের টার্গেট করা হলেও দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসেনি।
নাহিদ ইসলাম বলেন, ১৬ ডিসেম্বরে আমরা যেমন বিজয় পেয়েছি, একই সঙ্গে আমাদের প্রতিরোধের যাত্রাও শুরু হয়েছিল। সেই প্রতিরোধ ছিল ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। সেই প্রতিরোধের যাত্রা আমাদের আজও অব্যাহত রাখতে হচ্ছে। মঙ্গলবার আমরা সারা দেশের রাস্তায় রাস্তায় প্রতিরোধের যাত্রা শুরু করব। ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আমরা ঐক্যবদ্ধ হব। ভারত যদি মনে করে ৫ আগস্টের পরেও তারা আগের মতো দেশের রাজনীতির ওপর হস্তক্ষেপ করবে, নির্বাচনে কারচুপি করবে, তবে সে ভাবনাটা ভুল।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার যে কথা বলেছেন, তারপর তার এই দায়িত্বে থাকার আর কোনো নৈতিক অধিকার নেই। এই অথর্ব নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচন হওয়া সম্ভব নয়।
ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি জেনারেল নুরুল ইসলাম সাদ্দাম বলেন, ফ্যাসিবাদ নির্মূলে সরকারের কার্যকর উদ্যোগের অভাব দেখা যাচ্ছে। প্রশাসনে বিপুল জনবল ও অর্থ বিনিয়োগ সত্ত্বেও, সন্ত্রাসী তৎপরতার বিরুদ্ধে এবং হাদীর ওপর গুলীর ঘটনায় দৃশ্যমান ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। শরীফ ওসমান হাদী শুধু একটি নাম নয়, তিনি বাংলাদেশের মানুষের অন্তরের নাম। তিনি আরও বলেন, প্রশাসনে কোটি কোটি টাকা ও বিপুল জনশক্তি বিনিয়োগ করা হলেও ফ্যাসিবাদ নির্মূলে যে ধরনের কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন ছিল, তা দেখা যায়নি। জুলাই পরবর্তী সময়ে যেসব সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তাদের অধিকাংশকেই মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। যার ফলে তারা আবার অস্ত্রের মাধ্যমে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। সরকারকে অবিলম্বে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে সরাসরি অভিযান পরিচালনা করতে হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে আসন্ন সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড গঠন জন্য না হলে জুলাইয়ের বিদ্রোহীরা আবার রাস্তায় নামতে বাধ্য হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সহ-সভাপতি (ভিপি) আবু সাদিক কায়েম বলেছেন, আমাদের এখনই সময় জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার। আমাদের এখনই সময় শত্রু ও মিত্রদের চিহ্নিত করার। জুলাই বিপ্লবের পর আমাদের অনেকের মধ্যে ঐক্যের ফাটল ধরেছে। এখনই সময় সেই ফাটল দূর করে ঐকমত্য হওয়ার। তিনি বলেন, আমাদের বিপ্লব পরবর্তী বিভাজন ভেঙে আবার ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ভারতের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী করার জন্য আমাদের আবারও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আমাদের হাদী ভাই এই কাজটি করেছেন। আমাদেরও তার কাজে অংশগ্রহণ করতে হবে। তিনি বলেন, যে জুলাই বিপ্লবের রক্তের ওপরে দাঁড়িয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা হয়েছে, সেই জুলাই বিপ্লবীর নিরাপত্তা দিতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে।
বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করলে ভারতের সেভেন সিস্টার্সকে আলাদা করে দেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, যারা দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে, নির্বাচন বানচাল করতে চায়, ওসমান হাদীকে হত্যার সঙ্গে জড়িত, এমনকি সীমান্তে বাংলাদেশী ভাই-বোনদের ঝুলিয়ে রাখছে, তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে ভারত। তিনি বলেন, স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও শকুনদের হাত থেকে মুক্তির জন্য আন্দোলন করতে হচ্ছে। আবারও শকুনেরা বাংলাদেশের মানচিত্রে থাবা বসানোর চেষ্টা করছে। ভারত বাংলাদেশকে আরেকটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায় বলেও অভিযোগ করেন তিনি। নির্বাচন কমিশনের কঠোর সমালোচনা করে তিনি বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন মেরুদণ্ডহীন। একজন ইলেকশন কমিশনার ওসমান হাদীর মৃত্যুকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে উল্লেখ করেছেন, এটি অমানবিক। তিনি বলেন, এখনও এক শ্রেণির আওয়ামী লীগ শিক্ষক পরিচয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কার্যক্রম চালাচ্ছে। টকশোর নামে টেলিভিশনে হত্যার বৈধতা উৎপাদন করা হচ্ছে। ভারতের আধিপত্যে বসে এসব টকশো তৈরি করা হচ্ছে। সেখানে ফ্যাসিস্টদের মানবাধিকার নিয়ে আলোচনা হলেও মজলুমের মানবাধিকারকে উপেক্ষা করা হয়।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেন, অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে স্বাধীনতার পক্ষে থাকা প্রতিটি মানুষই এক একজন ‘ওসমান হাদী’। কাউকে আক্রমণ বা দমন করে দেশের গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষা ও স্বাধীনতাকে থামিয়ে দেওয়া যাবে না। এক উসমান হাদীর বিরুদ্ধে সহিংসতা চালানো হলে তার প্রতিক্রিয়ায় আরও বহু ওসমান হাদির জন্ম হবে। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে জনগণ আর কোনো আপস করবে না।
আরেকটি লাশ পড়লে আমরাও লাশ নেব বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। তিনি বলেন, খুবই সংকটময় পরিস্থিতি সামনে। একটি লাশ পরলে আমরাও লাশ নেব। অনেক ধৈর্য ধরা হয়েছে, আর না। আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়ে ভাইদের ওপর হামলা করবেন, এটা আমরা বরদাশত করব না। এই লড়াই দীর্ঘ, এর জন্য আমার প্রথমে বলেছি মুজিববাদের মূল উৎখাত করতে হবে। কিন্তু সেই চেষ্টা কমই দেখেছি। তিনি বলেন, ৫ আগস্টের পর আমরা চাইলে এদের সব ধ্বংস করে দিতে পারতাম, করিনি। আমরা ক্ষমা করে ভুল করে থাকলে প্রতিজ্ঞা করি, আর ক্ষমা করব না।