# বিতর্কিত আইন রহিত করা, আর্থিক অপচয় রোধে ভর্তুকি ও ব্যয় কমাতে সফলতা

# জ্বালানী খাতে এক বছরে সাশ্রয় ১৪ হাজার কোটি টাকা

# বকেয়া বিদ্যুৎ বিল আদায় ও পরিশোধে কঠোর পদক্ষেপ

সরকার বিদ্যুৎ খাতে স্বচ্ছতা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য নানামুখী কর্মসূচি বাস্তবায়ন শুরু করেছে। বিদ্যুৎ খাতে যে বহুমুখী ও সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপগুলো নিয়েছে, তার ফলাফল এরই মধ্যে দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। বিতর্কিত আইন রহিত করা, আর্থিক অপচয় রোধে ভর্তুকি ও ব্যয় কমানোর মতো সিদ্ধান্ত গুলো আলোচিত হচ্ছে।

বিদ্যুৎ খাতে দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কার্যক্রমের মধ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন ২০১০ রহিত করা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বলে জানা গেছে। এখাতে ভুর্তকির চাহিদা কমাতে অনেকটা সফল হয়েছে গেল এক বছরে।

এছাড়া নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং গ্রাহকদের ভোগান্তি কমানোর লক্ষ্যে গ্রীষ্মকালীন, রমযান ও সেচ মৌসুমে লোডশেডিংমুক্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছিল। একই সঙ্গে গ্রাহক হয়রানি কমাতে এবং বিদ্যুৎ-সংযোগ প্রক্রিয়া সহজ করতে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে

বিদ্যুৎ খাতে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় লুৃটপাটের একটা স্বর্গরাজ্য তৈরী হয়েছিল।

বিদ্যুতের বিশেষ আইন রহিতকরনের পর একটি বিশেষজ্ঞ ও একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে, এ কমিটি ভবিষ্যতে আরও কার্যকর ও স্বচ্ছ চুক্তি সম্পাদনে সহায়ক হবে বলে জানা গেছে। পাশাপাশি, বিদ্যুৎ খাতের দক্ষতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে একটি সার্বিক সংস্কার কমিটিও গঠন করা হয়। এই কমিটি ‘পলিসি ফর এনহ্যান্সমেন্ট অব প্রাইভেট পার্টিসিপেশন ইন দ্য পাওয়ার সেক্টর, ২০২৫’ নামে একটি খসড়া নীতি তৈরি করেছে, যা বর্তমানে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতামতের জন্য উন্মুক্ত রয়েছে। এই দুটি পদক্ষেপই বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে সরকারের সামগ্রিক সংস্কারের চিত্র তুলে ধরে।

জানা গেছে, সরকারের আর্থিক সাশ্রয় ও বিদ্যুৎ খাতের স্বনির্ভরতা নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ভর্তুকি ব্যবস্থাপনা এবং ব্যয় সাশ্রয়ের ওপর বিশেষ জোর দিয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভর্তুকির চাহিদা ৪৭ হাজার কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ৩৭ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা দেশের অন্যান্য উৎপাদনশীল খাতে ব্যবহারের সুযোগ তৈরি করবে। এই লক্ষ্য পূরণে আইএমএফের সহায়তায় একটি রোডম্যাপ তৈরির কাজ চলছে। একই সঙ্গে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যয় সাশ্রয়ের জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের জন্য ১০ শতাংশ ব্যয় হ্রাসের পরিকল্পনা ইতিমধ্যে আগস্ট ২০২৪ থেকে মে ২০২৫ পর্যন্ত ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা সাশ্রয় করেছে। তরল জ্বালানি আমদানির সার্ভিস চার্জ ৯ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে, যার মাধ্যমে ৪৭০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে।

এ ছাড়া মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ট্যারিফ কম নির্ধারণ ও ১০টি মেয়াদোত্তীর্ণ ও পুরোনো আইপিপি/রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে যথাক্রমে ২ হাজার ৫০০ কোটি ও ৫২৫ কোটি টাকা সাশ্রয় করা হয়েছে। সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোর ট্যারিফ কমানোর মাধ্যমে ২ হাজার ৬৩০.৩১ কোটি টাকা সাশ্রয় করা হয়েছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর জন্য ৬ শতাংশ উৎসে কর কমানোর অনুরোধ এবং এলএনজি আমদানির জন্য বাবিউবোর ভর্তুকির অর্থ থেকে ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা জ্বালানি বিভাগে হস্তান্তর করা হয়েছে। এসব আর্থিক পদক্ষেপের পাশাপাশি সরকারি কোম্পানিগুলোর মুনাফা ও বোনাস স্থগিত রাখা এবং পরিচালনা পর্ষদ সভার সম্মানির হার অভিন্নকরণের মাধ্যমে সরকারের অর্থ সাশ্রয় নিশ্চিত করা হয়েছে।

জানা গেছে, ‘নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালা ২০২৫’ অনুমোদিত হয়েছে এবং এ বছরের ১৬ জুন গেজেটে প্রকাশিত হয়েছে, যা এই খাতের জন্য একটি কার্যকর রোডম্যাপ হিসেবে কাজ করবে। এই নীতির আলোকে, ‘জাতীয় রুফটপ সোলার কর্মসূচি’ হাতে নেওয়া হয়েছে, যার লক্ষ্য হলো ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে সরকারি অফিস, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের ছাদে সোলার প্যানেল স্থাপন করে জাতীয় গ্রিডে ২০০০ থেকে ৩০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা।

এ ছাড়া সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য চারটি ধাপে ৫৫টি স্থানে ৫ হাজার ২৩৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যার জন্য উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে কাজ চলছে। পরিবেশদূষণ কমাতে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়েছে, যা একই সঙ্গে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও বিদ্যুৎ উৎপাদন উভয় ক্ষেত্রেই ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

জানা গেছে, সরকার বকেয়া বিদ্যুৎ বিল আদায় ও পরিশোধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। এর ফলে অভ্যন্তরীণ বকেয়া ১,৭২,৭৯৪.৩ মিলিয়ন টাকা এবং বৈদেশিক বকেয়া ১৫২.৬৯ মিলিয়ন ডলার হ্রাস পেয়েছে। বকেয়া বিল আদায়ের জন্য মন্ত্রণালয়ভিত্তিক কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, যার ফলস্বরূপ এর মধ্যে ৮১৩.৫৭০২ কোটি টাকা আদায় করা সম্ভব হয়েছে।

এক বছরে সাশ্রয় ১৪ হাজার কোটি টাকা :

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে একের পর এক খরচ সাশ্রয়ী পদক্ষেপ নেওয়ার মাধ্যমে গত এক বছরে ১৪ হাজার ১৩১ কোটি ৮১ লাখ টাকা সাশ্রয় করতে সক্ষম হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট দায়িত্ব গ্রহণের পর বর্তমান সরকার আইন সংশোধন ও কনসোর্টিয়াম গঠনের মাধ্যমে জ্বালানি খাতে সরকারি অর্থ সাশ্রয়ের লক্ষ্যে একাধিক খরচ সাশ্রয়ী পদক্ষেপ নিয়েছে।

জ্বালানি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০’ বাতিল এবং ২০০৮ সালের পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস অনুসরণ করে ২৩টি সংস্থার মাধ্যমে কম প্রিমিয়ামে ৪৯ কার্গো জ্বালানি ক্রয় করে ৩০২ কোটি ৭০ লাখ টাকা সাশ্রয় করা হয়েছে।

জ্বালানি বিভাগ জানায়, ১৭ কার্গো এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানির জন্য গত ২২ জুলাই পেট্রোবাংলা ও ওমানভিত্তিক ওকিউ ট্রেডিং লিমিটেড স্বল্পমেয়াদি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। সেখানে ৩০৮ কোটি ১৩ লাখ টাকা সাশ্রয় হবে।

এছাড়াও, অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচিত দেশীয় ও বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকের সঙ্গে কনসোর্টিয়াম গঠন করেছে, যা বিশ্বব্যাংকের ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (আইডিএ) ৩৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের গ্যারান্টি সুবিধার আওতায় নন-ফান্ডেড ও ফান্ডেড গ্যারান্টি সুবিধা প্রদান করবে। এটি চলতি বছরের নভেম্বর থেকে কার্যকর হবে। ২০২৭ সাল থেকে এই সুবিধা বেড়ে ৭০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হবে। সাত বছরের এই সুবিধা থেকে ২ হাজার ৭৭২ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে।

অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জ্বালানি চাহিদা পূরণে কার্যকর সরকার টু সরকার আলোচনার মাধ্যমে এবং আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তুলনায় ৭ হাজার ৫৪ কোটি টাকা সাশ্রয় করেছে। জ্বালানি বিভাগের কার্যকর পদক্ষেপে ২০২৫ সালের এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে পাথর ভাঙার বিস্ফোরক ক্রয়ে ২ কোটি ৪০ লাখ টাকা সাশ্রয় হয়েছে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড এবং কাফকোর সঙ্গে একটি গ্যাস চুক্তির মাধ্যমে বছরে ৬৪০ কোটি ৭১ লাখ টাকা রাজস্ব আয় বৃদ্ধি করেছে।

জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম (জিজিটিডিএসএল) এবং লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশের মধ্যে আরেকটি চুক্তি হয়েছে, যা থেকে বছরে ৪৬৩ কোটি ২৬ লাখ টাকা রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পেয়েছে।

জ্বালানি বিভাগ ২০২৫ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি সিস্টেম লস কমানোর জন্য পেট্রোবাংলা ও এর বিতরণ কোম্পানির সঙ্গে একটি রোডম্যাপ প্রস্তুত করেছে। এই রোডম্যাপ বাস্তবায়নের ফলে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তুলনায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সিস্টেম লস কমেছে, যা থেকে ২১৮ কোটি ৯৪ লাখ টাকা সাশ্রয় হয়েছে।

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) খুচরা পর্যায়ে গ্যাসের দাম কমিয়েছে এবং শিল্প ও ক্যাপটিভ টায়ারের গ্যাসের দাম পুনর্র্নিধারণ করেছে, যা থেকে বছরে অতিরিক্ত ৯৮ কোটি ২২ লাখ টাকা রাজস্ব আসবে।

এছাড়াও সরকার প্রকল্প ব্যয় কমাতে যুগোপযোগী পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। বাপেক্সের সক্ষমতা বৃদ্ধির অংশ হিসেবে ১৫০টি কূপ অনুসন্ধান ও উন্নয়নের পাশাপাশি তিনটি রিগ কেনা হবে।

এদিকে, বাপেক্স ১৯টি কূপ অনুসন্ধান, উন্নয়ন ও ওয়ার্কওভার করে জাতীয় গ্রিডে ৮২ মিলিয়ন ঘনফুট প্রতিদিন (এমএমসিএফডি) গ্যাস সরবরাহ করেছে, যা থেকে ১ হাজার ৯৪৩ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে।

সরকার সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) ও ডাবল পাইপলাইন প্রকল্প থেকে ১৯৩ কোটি ২৯ লাখ টাকা এবং চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় জ্বালানি পাইপলাইন থেকে ৪৫ কোটি ১১ লাখ টাকা সাশ্রয় করেছে।

বাখরাবাদ-মেঘনাঘাট-হরিপুর গ্যাস ট্রান্সমিশন পাইপলাইন নির্মাণ প্রকল্প (সংশোধন-১) থেকে ৩১ কোটি ৪ লাখ টাকা এবং গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেডের গ্যাস স্টেশন স্থাপন ও সংস্কার প্রকল্প (সংশোধন-১) থেকে ২৭ কোটি ৬৪ লাখ টাকা সাশ্রয় হয়েছে।

সরকার ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএল) থেকে ৯ কোটি ৭৫ লাখ টাকা এবং বগুড়া-রংপুর-সৈয়দপুর গ্যাস লাইন থেকে ৮ কোটি ২৪ লাখ টাকা সাশ্রয় করেছে।

তিতাস, হবিগঞ্জ, বাখরাবাদ ও মেঘনা গ্যাসক্ষেত্রে সাতটি কূপের ওয়ার্কওভার থেকে ৬ কোটি ৫৫ লাখ টাকা এবং রংপুর, নীলফামারী, পীরগঞ্জ ও আশপাশের এলাকায় গ্যাস বিতরণ নেটওয়ার্ক নির্মাণ থেকে ৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা সাশ্রয় হয়েছে।

খরচ সাশ্রয়ী উদ্যোগের মাধ্যমে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের প্রিপেইড মিটার প্রকল্প থেকে ২ কোটি ১৬ লাখ টাকা এবং ফৌজদারহাট-সীতাকুণ্ড-মিরসরাই এলাকায় গ্যাস বিতরণ নেটওয়ার্কের উন্নয়ন কাজ থেকে ১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা সাশ্রয় হয়েছে।