# অংশীজনদের সাথে আলোচনা হওয়ার পক্ষে মত বিশ্লেষকদের # করিডোর দেওয়ার অতীত অভিজ্ঞতা সুখকর না # স্থানীয়রাও করিডোর দেওয়ার বিপক্ষে

ঘটনা এবছরের এপ্রিল মাসের। মিয়ানমারের রাখাইনের রোহিঙ্গাদের জন্য শর্ত পূরণ সাপেক্ষে একটি হিউম্যানিটারিয়ান প্যাসেজ বা মানবিক করিডর দেয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে; বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন এই তথ্য প্রকাশের পর মানবিক করিডর নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও বিতর্ক হয়। করিডর বিষয়ে সরকারের এমন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ব্যাখ্যা দাবি করে বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি বিএনপি ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। প্রথমে সরকারের পক্ষ থেকে এমন কথা বলা হলেও পরবর্তীতে সরকারের পক্ষ থেকে তা নকোচ করে দেওয়া হয়। প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে জানানো হয়, সরকার তথাকথিত মানবিক করিডর নিয়ে জাতিসংঘ অথবা অন্য কোনো সংস্থার সঙ্গে আলোচনা করেনি। রাখাইন রাজ্যে যদি জাতিসংঘের নেতৃত্বে মানবিক সাহায্য দেয়া হয়, তাহলে বাংলাদেশ লজিস্টিক সাপোর্ট দিতে রাজি হবে। এটাই আমাদের অবস্থান বলে বলে জানিয়ে দেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। এরপর বিষয়টি থেমে যায়। এর আগে গত মার্চ বাংলাদেশ সফরে এসে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস রাখাইনে মানবিক সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বাংলাদেশের সহযোগিতা চান। এর অংশ হিসেবে একটি মানবিক প্যাসেজ তৈরির প্রস্তাব দেন তিনি।

মঙ্গলবার ঢাকায় নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত সাইদা শিনইচি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জাপানে আসন্ন পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকের প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, রাখাইনে মানবিক করিডোর হতে পারে, যদি কার্যকর হয়। তবে রাষ্ট্রদূত এও বলেন, এ বিষয়ে সব পক্ষের মত থাকতে হবে। জাপানের রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘রাখাইনে আমাদের কোনো রাষ্ট্রদূত যেতে পারে না। আমরা জাতিসংঘের উদ্যোগের বিষয়টি পর্যালোচনা করছি।

বিএনপির দুই শীর্ষ নেতা মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক আলোচনায় আবারো ‘মানবিক করিডোর’কে সামনে নিয়ে এসেছেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর অবসরপ্রাপ্ত হাফিজ উদ্দিন বিষয়টির অবতারণা করেছেন। বাংলাদেশে মানবিক করিডোর নিয়ে চলমান আলোচনা এবং এর বাস্তবায়ন নিয়ে জনগণ ও দেশের রাজনৈতিক দলগুলো অন্ধকারে রয়েছে বলে মন্তব্য করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ। তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, এই করিডোরের আড়ালে বাংলাদেশকে একটি সম্ভাব্য যুদ্ধে জড়ানো হতে পারে, যা দেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। একই মত দেন সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।

প্রসঙ্গত রাখাইনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও দেশটির বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির তীব্র সংঘাত চলছে। প্রদেশটির অধিকাংশ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ এখন আরাকান আর্মির দখলে। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের যে সীমান্ত তাও নিয়ন্ত্রণ করছে বিদ্রোহী গোষ্ঠীটি।

এমতাবস্থায় মানবিক করিডোর দেওয়া উচিত কি-না জানতে চাইলে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আমেনা মহসিন দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, প্রথমত বিষয়টি নিয়ে খোলামেলা আলোচনা দরকার। এছাড়া বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘের কোন রেজুলেশন দেখিনি। কোথা থেকে কোথায় গিয়ে শেষ হবে তাও আমরা জানি না। এছাড়া মিয়ানমারে জরুরী খাদ্য এবং ওষুধ পৌঁছানোর বিষয়তো ? এটা বাংলাদেশ মিয়ানমারের সীমানা পর্যন্ত নিয়ে দিতে পারে। সেখান থেকে বিতরণ করা যেতে পারে। তিনি বলেন এখানে অনেক বিষয় কাজ করে। নিরাপত্তার ব্যাপার আছে। রোহিঙ্গারা সেখানে অবস্থান করছে। অন্য পাশে আরাকান আর্মি আছে। সবার সাথে আলোচনা করা দরকার। এখানে ভূরাজনীতির ব্যাপার আছে। চীনের ইস্যু আছে। এছাড়া বিকল্প ব্যবস্থাতো আছে। জাতিসংঘ যদি বাংলাদেশকে দিয়ে দেয় তাহলে বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকায় দিয়ে আসতে পারে। বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।

কক্সবাজারের জেলা প্রেসক্লাবের সদস্য এবং সিনিয়র সাংবাদিক গোলাম আজম খান দৈনিক সংগ্রামকে জানিয়েছেন মানবিক করিডোর নিয়ে দেশব্যাপী আলোচনা থাকলেও বাস্তবে এখানে কোন করিডোরের অস্তিত্ব নেই। কক্সবাজার জেলা প্রেসক্লাবের ক্রিড়া সম্পাদক এম আর মাহবুব জানান, টেকনাফে মানবিক করিডোরের প্রস্তাবনা ছিল। কিন্তু এখন এর কোন অস্তিত্ব নেই। বিষয়টি এখনো আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে। তবে কক্সবাজারের মানুষ মানবিক করিডোরের বিপক্ষে।

মানবিক করিডোরের অভিজ্ঞতা :

সাম্প্রতিক সময়ে ফিলিস্তিনের গাজায় ভয়াবহ নৃশংসতায় তীব্র মানবিক সংকটে পড়া গাজার মানুষদের জন্য সহায়তা পাঠাতে মানবিক করিডর বারবার আলোচনায় এসেছে। বিশ্বের সংঘাতময় অঞ্চলগুলোয় যেখানে মানুষ খাদ্য ও ঔষধসহ জীবন রক্ষাকারী সামগ্রী পায় না কিংবা বেসামরিক নাগরিকসহ যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেয়ার প্রয়োজন দেখা দেয়, সেখানে মানবিক করিডরের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। তার মতে, আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার বিষয়ে আইনের আওতায় যাদের সরাসরি সহযোগিতা করা যায় না তাদের জন্যই এ ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্বের সংঘাতময় অঞ্চলগুলোয় যেখানে মানুষ খাদ্য ও ঔষধসহ জীবন রক্ষাকারী সামগ্রী পায় না কিংবা বেসামরিক নাগরিকসহ যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেয়ার প্রয়োজন দেখা দেয়, সেখানে মানবিক করিডরের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। তাদের মতে, আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার বিষয়ে আইনের আওতায় যাদের সরাসরি সহযোগিতা করা যায় না তাদের জন্যই এ ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়।

মূলত জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশন রেজুলেশন (৪৬/১৮২ এবং ৫৮/১১৪) এ মানবিক নীতিকে অনুমোদন করা হয়েছিলো। সংস্থাটি মানবিক সহায়তার ক্ষেত্রের সব কার্যক্রম গাইড করে থাকে। আর নিরাপদ মানবিক করিডরের অর্থের সংজ্ঞায় সংস্থাটি বলেছে–– জরুরি সরবরাহের জন্য একটি প্যাসেজ। এমন একটি মানবিক করিডরের মধ্য দিয়ে ত্রাণসামগ্রী মুক্তভাবে সংঘাতময় এলাকায় যেতে পারে। জাতিসংঘের সনদ অনুসারে, ক্ষতিগ্রস্ত দেশের সম্মতিতে মানবিক সহায়তা দেওয়া উচিত। এটি হবে একটি অসামরিক জোন, একটি নির্দিষ্ট এলাকা এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। সংঘাতে জড়িত পক্ষগুলো তাতে সম্মত হতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতীতে যেসব দেশে মানবিক করিডর পরিচালিত হয়েছে এমন অনেক জায়গাতেই অভিজ্ঞতা ভালো হয়নি। অনেক জায়গায় নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করেছে। শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন হয়নি এমন জায়গায় বিবদমান কোনো কোনো পক্ষ এই প্যাসেজে আক্রমণ করার নজির আছে। এমনকি অনেক জায়গায় মানবিক করিডরে হামলায় সিভিলিয়ানের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। আবার কোনো জায়গায় এমন করিডরে থাকা সেতু উড়িয়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। বিশ্লেষকদের মতে, অনেক ক্ষেত্রে এমন করিডরের রাজনৈতিক ও সামরিক অপব্যবহারের ঝুঁকি থাকে। আবার অস্ত্র পাচার এবং দখলকরা এলাকায় জ্বালানি চোরাচালানের জন্যও এই করিডর ব্যবহৃত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি নতুন কিছু নয়। বরং বিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে সংঘাতময় অঞ্চলগুলোতে মানবিক করিডরের প্রচলন শুরু হয়। নাৎসি নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলো থেকে ইহুদি শিশুদের যুক্তরাজ্যে সরিয়ে নেয়া হয়েছিলো ১৯৩৮-৩৯ সালে। নিরাপত্তা পরিষদের নেয়া প্রস্তাবের ভিত্তিতে বসনিয়ার সারায়েভোতে ১৯৯২-৯৫ সালে এবং ২০১৮ সালে সিরিয়ার ঘৌতা থেকে বেসামরিক লোকজনকে সরিয়ে আনার জন্য মানবিক করিডর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলো।

প্রথম আর্মেনিয়া-আজারবাইজান যুদ্ধের (নাগোর্নো-কারাবাখ যুদ্ধ) সময় ১৯৮৯ সালে লাচিন করিডোর স্থাপিত হলেও সেটি দুই বছরের মধ্যেই বন্ধ করে দিয়েছিলো আজারবাইজান সরকার। আবার ১৯৯৩ সালে নিরাপত্তা পরিষদের এক প্রস্তাবের মাধ্যমে সেরেনিৎসা ছিটমহলকে নিরাপদ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরে ওই বছরেই আরেক প্রস্তাবের মাধ্যমে সারায়েভো, জেপা, গোরাজদে, তুজলা ও বিহাচকেও এর অন্তর্ভুক্ত করে মোট ছয়টি মানবিক করিডর প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু নিরাপদ এলাকাগুলোকে কীভাবে সুরক্ষিত রাখা হবে তার কোনো রূপরেখা ছিল না। ফলে পরে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়। ১৯৯৫ সাল নাগাদ সেব্রেনিৎসায় গণহত্যার পরিস্থিতি তৈরি হয়। এটি ইউরোপের ভয়াবহ নৃশংসতার একটি। এছাড়া অনেক জায়গায় এ ধরনের মানবিক করিডর প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। ইয়েমেনের চলমান যুদ্ধের মধ্যে বার বার এমন করিডরের আহ্বান জানিয়েও সফল হয়নি জাতিসংঘ। আফ্রিকার কঙ্গোয় ২০০৮ সালে রাষ্ট্রীয় বাহিনী এবং জেনারেল লরেন্ট নকুন্ডার নেতৃত্বাধীন মিলিশিয়া বাহিনীর মধ্যে সশস্ত্র দাঙ্গা চরম আকার ধারণ করলে জাতিসংঘের প্রস্তাবে গোমা অঞ্চলে একটি মানবিক করিডোর খোলার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু সেটি শেষ পর্যন্ত সামরিক নানা বিষয়ে জড়িয়ে সংকটে পড়ে যায়। বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘ নিজেও অনেক সময় অসহায় থাকে। বৃহৎ শক্তিগুলো যা চায় তার বাইরে যাওয়ার সামর্থ্য তার থাকে না। যে কারণে অনেক জায়গায় মানবিক করিডর প্রয়োজন হলেও করা যায়নি। আবার অনেক জায়গায় করিডর হলেও সেটি টেকসই ও কার্যকর হয়নি। আবার ইথিওপিয়ায় টাইগ্রে অঞ্চলে বহু মানুষ মাসের পর মাস সরকারি অবরোধে আটকে পড়লে ২০২২ সালের নভেম্বরে মানবিক করিডোরগুলো পুনরায় চালুর মধ্য দিয়ে তাদের প্রাণে বাঁচানো সম্ভব হয়। যদিও বাংলাদেশে এটি আলোচনায় এসেছে রাখাইনে মানবিক সহায়তা পাঠানোর প্রসঙ্গে। এর বাইরে বিশ্বের নানা দেশে সংঘাতময় এলাকায় এ ধরনের করিডর প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ দেখা গেছে।