# নিস্তার মিলবে ১ লা জুনের পর # ফেনীসহ ৬ জেলায় বন্যার শঙ্কা # সারাদেশে নৌপথে লঞ্চ চলাচল বন্ধ ঘোষণা
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ছড়ায় বলেছেন, ‘নীল নবঘনে, আষাঢ় গগনে, তিল ঠাঁই আর নাহি রে। ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে’। বাংলার জমিনে জৈষ্ঠ্য মাসে যে আষাঢ় দেখা দিয়েছে। সাহিত্যে ছড়ায় ছান্দিক স্পন্দনে. মেলবন্দ উচ্চারণে বৃষ্টির বর্ণনা যতটা মিষ্টি লাগে তার উল্টোটাই বাস্তবতায়। বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শহরের যান্ত্রিক জীবনে সীমাহীন ভোগান্তির সৃষ্টি করে বৃষ্টি। আর যদি টানা বৃষ্টি শুরু হয়, তাহলে ভোগান্তির মাত্রাটাও প্রলম্বিত হয়। বৃষ্টিপাত আরও বাড়তে পারে জানিয়ে আবহাওয়া অফিস বলছে, আগামী ৪৮ ঘণ্টায় ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টিপাত হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। কারণ বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া নি¤œচাপটি আরও ঘণীভূত হয়ে গভীর নি¤œচাপে পরিণত হতে পারে। এতে বিশেষ করে চট্টগ্রাম অঞ্চলে। এছাড়া উপকূলীয় এলাকায় বয়ে যেতে পারে ঝোড়ো হাওয়া। তবে এই ভোগান্তির ইতি ঘটতে পারে ১লা জুনের পর। এদিকে সাগরে নি¤œচাপ এবং অতি বৃষ্টির কারণে ফেনীসহ ৬ জেলায় বন্যার আভাস দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। সারাদেশে বন্ধ করা হয়েছে নৌ চলাচল।
ভোগান্তির শুরু সকাল থেকেই :
বৃহস্পতিবার সকাল বেলাতেই যেন নেমে আসে রাতের আঁধার, কালো মেঘে ছেয়ে যায় রাজধানীর আকাশ। সেই সঙ্গে বইতে শুরু করে হওয়া। এমন আবহাওয়ার মধ্যেই আকাশের বুক চিরে নেমে আসে বৃষ্টি। এতে অফিসগামী ছাড়াও কাজের প্রয়োজনে বের হওয়া নগরবাসী ভোগান্তিতে পড়েন। মানুষের ঘুম ভাঙ্গে বৃষ্টিভেজা ঠা-া বাতাসের আবহে। আরামের ঘুম থেকে উঠে কর্মের দিকে পা বাড়াতেই শুরু হয় ভোগান্তি। রাস্তায় পা ফেলতেই নানা রকমের জটিলতার মুখে পড়তে হয়। বিশেষ করে অফিসগামী মানুষ, শিক্ষার্থী ও নি¤œআয়ের পথচারীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হন। স্কুল কলেজ অফিস আদালতে সময় মতো পৌছানোর তাড়ায় বিড়ম্বনার মাত্রা যোগ হয় কয়েক গুণ। স্বাভাবিক দিনে পায়ে হেঁটে যাওয়ার সুযোগ থাকলেও বৃষ্টির দিনে গন্তব্যে পৌঁছাতে রিকশা কিংবা অন্য যানবাহনের সাহায্য নিতে হয়। বিশেষ করে বৃষ্টি শুরু হওয়ার পর রাজধানীর সড়কে কমে যায় যানবাহন চলাচল। এই সুযোগে রিকশাভাড়া হয়ে যায় দ্বিগুণ। বিশেষ করে, যারা অফিসের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে হেঁটে, বাইকে বা রিকশায় বের হন তারা মাঝ রাস্তায় আটকা পড়েন। এমন অবস্থায় পথচারী ছাড়াও ছিন্নমূল মানুষদের মেট্রোরেলের পিলারের নিচে আশ্রয় নিতে দেখা যায়।
ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, টানা বৃষ্টির কারণে রাজধানীর মানুষের কাছে বৃহস্পতিবারের সকালটা ছিল সীমাহীন ভোগান্তির। বৃষ্টির দিনে ঢাকার কিছু এলাকায় যানজট আবার কিছু এলাকা ফাঁকা দেখা যায়। এর মধ্যে আবার নিচু এলাকাগুলোতে সৃষ্টি হয় পানিবদ্ধতা। রেইনকোট গায়ে তেজগাঁওয়ের কর্মস্থলে যাচ্ছিলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মিয়া হোসেন। তিনি বলেন, সকাল থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি থামার কোনো নামই নেই। রিকশারও সংকট তাই পায়ে হেঁটে রওনা দিয়েছি অফিসের দিকে।
বিশেষ করে সকালে স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের নিয়ে অভিভাবকদের দুশ্চিন্তা ছিল বেশি। ধানম-ির এক স্কুলের সামনে দেখা যায় অনেক অভিভাবক ছাতা নিয়ে অপেক্ষা করছেন বৃষ্টির মধ্যেও। সন্তানকে স্কুলে পৌঁছাতে ছাতা নিয়ে রিকশার অপেক্ষায় রয়েছে আবদুল হান্নান। তিনি বলেন, স্বাভাবিক সময়ে মিনিটে একটি রিকশা পেতাম এখন ৩০ মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে আছি কোনো রিকশা পাচ্ছি না। আবার যেগুলো পাচ্ছি তারা দ্বিগুণের চেয়ে বেশি ভাড়া চাচ্ছে। এতে মনে হচ্ছে আবহাওয়ার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাদের চরিত্রও পরিবর্তন হয়েছে।
আবার রিকশা চালকেরও পাল্টা যুক্তি আছে। তারা জানান, সকাল থেকে বৃষ্টি, রাস্তায় রিকশা কম আবার ভাড়া কম পাচ্ছি। এজন্য যে দুই একটা ভাড়া পাচ্ছি তা একটু বাড়িয়ে নিচ্ছি। এছাড়া ঢাকার বাইরে থেকে আসা বাশার বলেন, ঢাকায় এসেছি জরুরি কাজে, এসে দেখি বৃষ্টি। কোথাও যেতে পারছি না। এক জায়গায় স্থির হয়ে আছি। আবার রাতের গাড়িতে গ্রামে ফিরতে হবে। আবার যে কাজে এসেছি তা শেষ করতে না পারলেও সমস্যায় পড়ে যেতে পারি।
আবহাওয়া অফিসের ভাষ্য :
সতর্কবার্তায় বলা হয়, নি¤œচাপটি উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে আরও ঘণীভূত হয়ে গভীর নি¤œচাপে পরিণত হতে পারে। এর প্রভাবে আগামী ৪৮ ঘণ্টায় (বৃহস্পতিবার সকাল ১১টা থেকে) খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, সিলেট, ঢাকা, ময়মনসিংহ, রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের অনেক জায়গায় ভারী (৪৪-৮৮ মি.মি./২৪ ঘণ্টা) থেকে অতি ভারী (>৮৮ মি.মি./২৪ ঘণ্টা) বর্ষণ হতে পারে। এছাড়া অতি ভারী বৃষ্টির কারণে চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবন ও কক্সবাজার জেলার পাহাড়ি এলাকার কোথাও কোথাও ভূমিধসের আশঙ্কা রয়েছে। সেইসাথে ভারী বর্ষণের ফলে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীর কোথাও কোথাও অস্থায়ীভাবে পানিাবদ্ধতা তৈরি হতে পারে। দেশের চার সমুদ্র বন্দরেও দেয়া হয়েছে তিন নম্বর সতর্ক সংকেত। এছাড়াও আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক এক ব্রিফিংয়ে জানান, উত্তর-পূর্ব বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া লঘুচাপ বর্তমানে নি¤œচাপে পরিণত হয়েছে। এর প্রভাবে দেশের বিভিন্ন এলাকায় অতিভারী বৃষ্টিপাত হতে পারে। সাথে থাকবে দমকা হাওয়া ও বজ্রপাত। তবে এই নি¤œচাপটি ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হবার কোনো সম্ভাবনা নেই।
৬ জেলায় বন্যার শঙ্কা :
এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, আগামী দুদিন চট্টগ্রাম বিভাগের গোমতী, মুহুরী ও ফেনী নদীর পানি সমতল বাড়তে পারে। এ সময় মুহুরী নদীর পানি সমতল বিপৎসীমা অতিক্রমের সম্ভাবনা রয়েছে। ফেনী জেলার মুহুরী নদী সংলগ্ন নি¤œাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। পরবর্তী একদিনে নদীর পানি সমতলে হ্রাস পেতে পারে। এছাড়া সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগের সারিগোয়াইন, যাদুকাটা, মনু, ধলাই, খোয়াই ও সোমেশ্বরী নদীর পানি সমতলে আগামী তিনদিন বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে। এ সময়ে সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলার নি¤œাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
রংপুর বিভাগের তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদীসমূহের পানি সমতলে আগামী তিনদিন বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তিস্তা নদী সতর্কসীমায় প্রবাহিত হতে পারে। আগামী দুদিন পর্যন্ত বরিশাল, খুলনা ও চট্টগ্রাম বিভাগের উপকূলীয় নদীতে স্বাভাবিক অপেক্ষা অধিক উচ্চতায় জোয়ার পরিলক্ষিত হতে পারে। এদিকে, সুরমা, কুশিয়ারা নদীর পানি সমতলে হ্রাস পাচ্ছে, যা আগামী তিনদিন পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। তবে বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে।
নৌপথে লঞ্চ চলাচল বন্ধ :
বৈরী আবহাওয়ার কারণে বরিশাল নদী বন্দর থেকে অভ্যন্তরীণ নৌপথের সব লঞ্চ চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে গতকাল থেকে। সেইসাথে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে লঞ্চ চলাচল সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। বিআইডব্লিউটিএ গতকাল জানিয়ে দেয়, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকবে। আবহাওয়া পরিস্থিতির উন্নতি হলে লঞ্চ চলাচল পুনরায় শুরু হবে। বৃহস্পতিবার সকালে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং সকাল থেকে বরিশাল নদী বন্দর থেকে একটিও লঞ্চ ছেড়ে যায়নি বলে জানায় বরিশাল নৌবন্দর কর্মকর্তা মোহাম্মদ সেলিম রেজা । বৃহস্পতিবার সকাল থেকে দমকা বাতাস, বৃষ্টি এবং নদী কিছুটা উত্তাল থাকায় বরিশাল নৌবন্দরকে দুই নম্বর সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পুনরায় লঞ্চ চলাচল শুরু হবে। বৃহস্পতিবার সকাল ৯টার আপডেটে পায়রা সমুদ্র বন্দরকে তিন নম্বর এবং বরিশাল নদী বন্দরকে দুই নম্বর সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়।
কেউ যাসনে ঘরের বাহিরে :
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট একটি নি¤œচাপের প্রভাবে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থা আরও দু-একদিন স্থায়ী হতে পারে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। আবহাওয়াবিদদের পরামর্শ, প্রয়োজন ছাড়া কেউ যেন ঘর থেকে বের না হন, আর বাইরে গেলে ছাতা বা রেইনকোট সঙ্গে রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।