নিহত বেড়ে ৩৫, চলতি সপ্তাহেও বন্ধ থাকবে মাইলস্টোন

চারদিন ধরে হাসপাতালে কাতরাচ্ছিল জারিফ ফারহান (১৩)। তার শ্বাসনালীসহ শরীরের ৪০ শতাংশ দগ্ধ হয়েছিল। ক্রিটিকাল অবস্থায় লাইফ সাপোর্টে ছিল সে। চিকিৎসকরা প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন বাঁচানোর জন্য। কিন্তু শেষপর্যন্ত সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেছে জারিফ। রাজধানীর উত্তরা মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় দগ্ধ শিক্ষার্থী জারিফ সকাল ৯টার দিকে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়্ সে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তার পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর করেছে। এই দিন মাইলস্টোনের কর্মচারী মাসুমাও মৃত্যুমুখে পতিত হন।

হাবিবুর রহমান লিটন ও রাশিদা ইয়াসমিন দম্পতির ছেলে জারিফ। তারা বর্তমানে ঢাকার উত্তরার ১২ নম্বর সেক্টরে থাকে। তাদের গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ী পৌরসভার ৫নং ওয়ার্ডের হোসনাবাদ গ্রামে। জারিফের বাবা মো. হাবিবুর রহমান লিটন জানান, তাদের বাড়ি রাজবাড়ীর সদর উপজেলার শ্রীপুর এলাকায়। তার ২ ছেলে-মেয়ের মধ্যে জারিফ ছিল ছোট। মাইলস্টোন স্কুলের ৭ম শ্রেণিতে ইংলিশ ভার্সনে পড়ত সে।

জারিফের পরিবারের সূত্রে জানা গেছে, প্রতিদিন সকালে জারিফের মা তাকে স্কুলে রেখে আসতেন। ঘটনার দিনও স্কুলে রেখে বাসায় চলে আসেন তিনি। জারিফের একাই বাসায় ফেরার কথা ছিল সেদিন। স্কুলে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে অগ্নিকা-ের খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে যায় জারিফের পরিবার। কিন্তু কোথাও পাওয়া যাচ্ছিল না জারিফকে। পরে দুপুর আনুমানিক ২টার দিকে উত্তরার একটি বেসরকারি হাসপাতাল থেকে তার বাবা হাবিবুর রহমান লিটনকে ফোন করে জানানো হয়, জারিফকে দগ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়েছে। অবস্থা গুরুতর। তাকে অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে। এরপরই বাবাসহ জারিফের পরিবারের সদস্যরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। জারিফের শরীরের ৪০ শতাংশ দগ্ধ ছিলো। গত মঙ্গলবার বিকেল থেকেই আইসিইউতে ছিল জারিফ। এ বিষয়ে রাজবাড়ীর সিভিল সার্জন ডা. এস এম মাসুদ বলেন, ঢাকার মাইলস্টোন ট্রাজেডির ঘটনায় রাজবাড়ীর ছেলে জারিফ মারা গিয়েছে। তার দাফন ঢাকার উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টরে হবে। আমি জানাজায় অংশগ্রহণ করব।

মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় মাসুমা নামে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে। তিনি জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এ নিয়ে এ ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৩৫ জনে দাঁড়ালো। দগ্ধ মাসুমা (৩৮) জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে শনিবার সকাল ১০টা ১৫ মিনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আবাসিক চিকিৎসক শাওন বিন রহমান মাসুমার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় মাসুমা নামে আরও একজন মারা গেছেন। তার শরীরের ৯০ শতাংশ দগ্ধ ছিল। এর আগে, সকাল আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় শিক্ষার্থী জারিফ।

চলতি সপ্তাহেও বন্ধ থাকবে মাইলস্টোন: মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের পর এখনো ট্রমা কাটিয়ে উঠতে পারেনি শিক্ষার্থীরা। এমন পরিস্থিতিতে চলতি সপ্তাহেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ থাকবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। আগামী সপ্তাহে ঠিক কবে ক্লাস-পরীক্ষা চালু হবে তাও নির্ধারণ করা হয়নি এখনো। মাইলস্টোন স্কুলের দিয়াবাড়ি ক্যাম্পাসের ইংলিশ শাখার অধ্যক্ষ ক্যাপ্টেন (অব.) জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, ক্যাম্পাসে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় তদন্ত কমিটি কাজ করছে। শিক্ষার্থীদের ট্রমা এখনো কাটেনি। তাদের জন্য ক্যাম্পাসে তিনজন কাউন্সিসেলিংয়ের জন্য রয়েছেন। শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকরা ক্যাম্পাসে গিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলছেন। এমন পরিস্থিতিতে চলতি সপ্তাহের ক্লাস-পরীক্ষা চালু করা সম্ভব নয়। কবে নাগাদ চালু হবে তা নিয়েও কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয়নি। তবে হয়তো আগামী সপ্তাহে ক্লাস চালু হতে পারে।

বিমান বিধ্বস্তের ৫ পাঁচদিন পর গতকাল শনিবার স্কুলের সামনে সাধারণ মানুষের জটলা দেখা যায়। বেশিরভাগই গেটের ফাঁকা অংশ দিয়ে ভেতরটা দেখার চেষ্টা করছেন। তবে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের ভেতরে প্রবেশ করতে বাধা দেওয়া হচ্ছে না। স্কুলের অধিকাংশ শিক্ষার্থী বাবা-মায়ের হাত ধরে ক্যাম্পাসে ঢুকছেন। তবে সাংবাদিকসহ উৎসুক লোকজনকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। বেলা ১১টার দিকে গলায় স্কুলের পরিচয়পত্র ঝুলিয়ে ক্যাম্পাসে ঢোকে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র জুনায়েদ সিদ্দিকী। আধা ঘণ্টা ক্যাম্পাসে ঘুরে বেলা সাড়ে ১১টায় বের হয় জুনায়েদ। এ সময় জুনায়েদ সাংবাদিকদের জানায়, ওদিন বিমান দুর্ঘটনার সময় বিকট শব্দ হয়েছিল। মনে হয়েছিল কানের পর্দা ফেটে যাবে। আতঙ্কে সবাই ছোটাছুটি করি। একপর্যায়ে শান্ত হয়ে স্কুলের যে ভবনটিতে বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে সেখানে আসি। দেখি শিশু শিক্ষার্থীদের হাত-পা ছড়িয়ে ছিটে আছে। বহু শিক্ষার্থী আগুনে পুড়ে গেছে। এমন করুণ দৃশ্য বলে বোঝানো যাবে না। এখন রাতে ঘুমাতে গেলে এই দৃশ্য চোখে ভেসে উঠে। এমন পরিস্থিতিতে কীভাবে ক্লাস-পরীক্ষা অংশ নেয়া মাথায় আসে না।

দগ্ধ ৪ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক: মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন চারজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক মেহাম্মদ নাসির উদ্দিন। গতকাল শনিবার বিকেল পৌনে ৩টার দিকে সাংবাদিক সম্মেলনে এ তথ্য জানান তিনি। তিনি বলেন, একই সঙ্গে এ ঘটনায় দগ্ধ রাফসি (১২) ও আয়ান খান (১২) নামের দুই শিক্ষার্থীকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। শারীরিক অবস্থার উন্নতি হওয়ায় তাদের হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। তিনি আরও জানান, এখনো জাতীয় বার্নে ৩৬ জন রোগী ভর্তি রয়েছে। তাদের মধ্যে আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছে চারজন। তাদের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। সিবিআর ক্যাটাগরিতে ৯ জন আছে। বাকিরা অন্যান্য ওয়ার্ডে ভর্তি রয়েছে। আগামী এক সপ্তাহে আরও ১০ জনকে পর্যায়ক্রমে ছেড়ে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান তিনি।

উল্লেখ্য, গত ২১ জুলাই বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর এফ-৭ বিজেআই বিমানটি দুপুর ১টা ৬ মিনিটে উড্ডয়নের ১২ মিনিটের মাথায় ১টা ১৮ মিনিটে উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে বিধ্বস্ত হয়। বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫ জনে। এ দুর্ঘটনায় রাজধানীর সাতটি হাসপাতালে এখনো চিকিৎসাধীন রয়েছে প্রায় অর্ধশত আহত ও দগ্ধ শিক্ষক-শিক্ষার্থী। নিহতদের মধ্যে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ১৭ জন, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ১৫ জন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে একজন, লুবনা জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড কার্ডিয়াক সেন্টারে একজন (অজ্ঞাতনামা) এবং ইউনাইটেড হাসপাতালে একজন মারা গেছেন।