আগামী নির্বাচনে কাকে ভোট দেবেন এমন প্রশ্নে নীরব ৪৮.৫ শতাংশ মানুষ। এছাড়া যারা ভোট চান তাদের মধ্যে ৫১ শতাংশ মানুষ ভালো মতো পুরো সংস্কার কাজ সম্পন্ন করে তারপর জাতীয় নির্বাচন দেখতে চান। তারা মনে করেন মব সন্ত্রাস, কালোটাকার প্রভাব বন্ধ করা, আইনশৃঙ্খলার উন্নতি, কেন্দ্র দখলের আশংকা না থাকলে দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হবে। গত বছরের অক্টোবর এবং চলতি বছরের ১ থেকে ২০ জুলাই ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক সার্ভের ফলাফলে এই তথ্য বেরিয়ে এসেছে। সার্ভে বলছে, তরুণদের মধ্যে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) জনপ্রিয়তা কমলেও উল্লেখযোগ্যহারে বেড়েছে জামায়াতে ইসলামীর জনপ্রিয়তা। নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জনপ্রিয়তা বেড়েছে। গতকাল সোমবার রাজধানীর আগারগাঁওস্থ জাতীয় আর্কাইভ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত ‘বিআইজিডি পালস সার্ভে’-এর এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) ও ভয়েস ফর রিফর্ম যৌথভাবে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে ফলাফল তুলে ধরেন বিআইজিডির ফেলো সৈয়দা সেলিনা আজিজ। এতে বক্তব্য রাখেন, বিআইজিডির পরিচালক অপরাশেন মেহনাজ রাব্বানী, ভয়েজ অব রিফর্মেও কো-কনভেইনার এ কে এম ফাহিম মাশরুর, বিআইজিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. মির্জা এম হাসান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. আসিফ শাহান।
‘জনগণের মতামত, অভিজ্ঞতা ও প্রত্যাশা জুলাই ২০২৫’ শীর্ষক এই জরিপ করেছে ভয়েস ফর রিফর্ম ও বিআইজিডি। অন্তর্বর্তী সরকারের পারফরমেন্স, জনগণের সংস্কার প্রত্যাশা ও আগামী নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর জনসমর্থনের ওপর সম্প্রতি এই জরিপ পরিচালিত হয়। সারাদেশের ৬৪ জেলায় পাঁচ হাজার ৪৮৯ জন নারী ও পুরুষের মধ্যে টেলিফোনে এই জরিপ পরিচালিত হয়। যদিও ফোন করা হয়েছিল নয় হাজার ২০৩ জনকে।
জরিপে বয়স ভেদে দলগুলোর জনসমর্থনে দেখা গেছে, ২৭ থেকে ৩৫ বছরের ভোটারদের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন বেড়েছে। কমেছে বিএনপির সমর্থন। এখানে দেখানো হয়েছে, ২৭ বছরের নিচে বিএনপির সমর্থণ যেখানে ৯ শতাংশ সেখানে জামায়াতের সমর্থন ১ শতাংশ। ২৮ থেকে ৩৫ বছরের ভোটারদের মধ্যে বিএনপির সমর্থন ১১ শতাংশ, সেখানে জামায়াতের সমর্থনও ১১ শতাংশ। বয়সভেদে দলগুলোর জনসমর্থনের মধ্যে বিএনপির রয়েছে ৪৯ শতাংশ, জামায়াতে ইসলামীর ৪২ শতাংশ এবং এনসিপির ১২ শতাংশ। শিক্ষার স্তরভেদে দলগুলোর সমর্থনে দেখা গেছে, এখানে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী প্রায় কাছাকাছি। গ্রাজুয়েটদের মধ্যে বিএনপি ও জামায়াতের জনসমর্থন ১০ শতাং করে, এসএসসি ও এইচএসসির মদ্যেও দুই দলের ১০ শতাংশ। হাইস্কুল পর্যন্ত বিএনপির ১২ শতাংশ, জামায়াতের ১১ শতাংশ, প্রাইমারি স্কুল পর্যন্ত বিএনপির ১৪ শতাংশ এবং জামায়াতের ১১ শতাংশ এবং আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নেই এমন ভোটারের মধ্যে বিএনপির ১৪ শতাংশ, জামায়াতের ৯ শতাংশ। শিক্ষার স্তরভেদে বিএনপি ও জামায়াতের জনসমর্থন দেখানো হয়েছে ৬০ ও ৫১ শতাংশ। জরিপের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের অক্টোবরে যেখানে বিএনপিকে ভোট দেয়ার কথা জানিয়েছিলেন ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ, সেখানে ২০২৫ সালের জুলাইয়ে ১০ মাসে এসে তা কমে ১২ শতাংশে নেমেছে। বিপরীতে এনসিপির প্রতি সমর্থন ২ শতাংশ থেকে বেড়ে ২ দশমিক ৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। আর জামায়াতের অবস্থা ১১ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে কমে এখন ১০ দশমিক ৪ শতাংশে এসেছে। তবে ‘কোন দলকে ভোট দেবেন’ জরিপের এমন প্রশ্নে এখনো সিদ্ধান্ত না নেয়ার কথা জানিয়েছেন ৪৮ দশমিক ৫ শতাংশ।
জরিপের ফলাফলে বলা হয়, আগামী জাতীয় নির্বাচনে আপনি কাকে ভোট দেবেন- এমন প্রশ্নের জবাবে ২০২৪ সালের অক্টোবরে ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ বলেছে, বিএনপিকে ভোট দেবে। সেখানে ২০২৫ সালের জুলাইয়ে তা কমে ১২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে ভোট দেয়ার কথা বলেছিল ১১ দশমিক ৩ শতাংশ, তা কমে ২০২৫ সালের জুলাইয়ে ১০ দশমিক ৪ শতাংশে নেমেছে। ২০২৪ সালে এনসিপির পক্ষে ভোট দেয়ার মত দিয়েছিল ২ শতাংশ। যা চলতি বছরের জুলাইয়ে সমর্থন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ৮ শতাংশে। জাতীয় পার্টির প্রতি সমর্থন ২ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে কমে শূন্য দশমিক ৩ শতাংশে নেমেছে। আর অন্যান্য ইসলামিক দলের সমর্থনও কমছে, অক্টোবরের জরিপে ২ দশমিক ৬ শতাংশ থেকে কমে জুলাই মাসে শূন্য দশমিক ৭ শতাংশে নেমেছে। অন্যান্য দলের প্রতিও সমর্থন কমেছে জনগণের। যেখানে ২০২৪ সালে অন্যান্য দলে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ ভোট দেয়ার মত জানিয়েছিল, চলতি বছরের জুলাইয়ে তা কমে ১ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে এসেছে।
জরিপে কোন দলকে ভোট দেবে এখনো সিদ্ধান্ত নেই এমন ভোটারের সংখ্যা বেড়েছে। জরিপে ২০২৪ সালের অক্টোবরে যেখানে ৩৭ দশমিক ৬ শতাংশ ছিল, জুলাইয়ে তা বেড়ে ৪৮ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। আর ভোট না দেয়ার কথা জানিয়েছে ১ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ। আর কাকে ভোট দেবে এমন তথ্য জানাতে চাননি এই জরিপে অংশ নেয়া ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ, যা গত অক্টোবরে ছিল ১২ দশমিক ৯ শতাংশ।
বিআইজিডি জরিপে অংশ নেয়া বেশিভাগ মানুষ সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে আশাবাদী। ৭০ শতাংশ বলেছেন যে আগামী জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে। নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না বলে জানিয়েছন ১৫ শতাংশ মানুষ। জরিপে অংশ নেয়া ৫১ শতাংশ মনে করে ভালো মতো সংস্কার করে তারপরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। কিছু জরুরি সংস্কার করে নির্বাচন চায় ১৭ শতাংশ। তবে জাতীয় নির্বাচন ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে হোক এমন বিষয়ে মত দিয়েছে ৩২ শতাংশ। আর ২০২৬ সালে নির্বাচনের পক্ষে ৪৮ শতাংশ। এর মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের বিষয়ে মত দিয়েছে ১২ শতাংশ, জুনের মধ্যে ১১ শতাংশ এবং ডিসেম্বর ২০২৬ অথবা এর পরে নির্বাচন হওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে ২৫ শতাংশ।
অন্তর্বর্তী সরকারের এ পর্যন্ত যেসব প্রচেষ্টা, সেগুলোকে আপনি ১০০-তে কত নম্বর দেবেন, এই প্রশ্নে সরকারকে ৬৩ শতাংশ নম্বর দিয়েছেন উত্তরদাতারা। গত অক্টোবরে এটি ছিল ৬৮ শতাংশ।
মূল প্রবন্ধের সার্বিক বিশ্লেষণ ও মূল বার্তায় বিআইজিডির ফেলো সৈয়দা সেলিনা আজিজ বলেন, বর্তমানে সমস্যার ধরন বহুমাত্রিক এবং এই সমস্যায় অর্থনীতির একতরফা প্রভাব কমেছে। এই বহুমাত্রিকতার কেন্দ্রে রয়েছে রাজনীতির সাথে সম্পর্কিত সমস্যা এবং এগুলোর মধ্যে প্রধান হচ্ছে আইনশৃঙ্খলার অবনতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অস্থিতিশীলতা। এই কারণগুলোর জন্যই অন্তবর্তী সরকারের গ্রহণযোগ্যতা কমেছে। মানুষ এই অস্থিতিশীলতার সমাধান খুঁজছেন দু’ভাবে, এক- নির্বাচন, দুই- সংস্কার। যদিও মানুষ নির্বাচনমুখী, তবু আমাদের ফলাফল অনুযায়ী একটি বিশাল গোষ্ঠী এখনো সিদ্ধান্ত নেননি। ভোটের ক্ষেত্রে উপযুক্ত প্রার্থী মনোনয়ন বড় ভূমিকা পালন করতে পারে।
আলোচনায় ড. মির্জা এম হাসান বলেন, দেশের সাধারণ মানুষের মতের সাথে এলিট শ্রেণির মতের মিল নেই। এলিটরা বলছে, নির্বাচন হলে রাজনৈতিক সরকার এলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তারা নিজেদের গোষ্ঠীগত স্বার্থেও কথা বলেন। তিনি বলেন, ৭০ শতাংশ যে বলছে নির্বাচন ভালো হবে তাতে অবাক হচ্ছি। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন সাধারণ মানুষ অর্থনীতি ও রাজনীতিকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। এবার দেখা যাচ্ছে, নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় হলে মানুষ আইনশৃঙ্খলা ও অন্যান্য বিষয়ে মনোযোগ দেয়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে, বিশেষ করে মব নিয়ন্ত্রণে। শেখ হাসিনার আমলে তৈরি হওয়া ভয়ের সংস্কৃতি এখন আর নেই এবং তা ফেরানো সম্ভব নয়। নারীর অধিকার রক্ষায় সমর্থন বেড়েছে।
ড. আসিফ শাহান বলেন, আগে ধারণা ছিল, অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হলে দেশ খারাপ হয়। কিন্তু এবার অর্থনীতি তুলনামূলক ভালো থাকলেও মানুষ দেশকে ভালো মনে করছে না। অন্তর্বর্তী সরকারের সময় নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। নারীরা ভোট ও রাজনৈতিক আলোচনায় পিছিয়ে আছে। কোনো দল তাদের সামনে তুলে ধরছে না। তিনি বলেন, মানুষ সংস্কার চায় নিজের অভিজ্ঞতা থেকে। পুলিশ, অর্থনীতি ও শিক্ষা খাতে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আস্থা কমে গেছে, কারণ নির্বাচনের আগে দেয়া প্রতিশ্রুতি পরে বাস্তবায়িত হয় না।
জামায়াতের প্রতি ভোটারদের সমর্থন বাড়ার কারণ কি? এমন প্রশ্নের জবাবে ড. আসিফ বলেন, ৫ আগস্ট পরবর্তী ঘটনার পাশাপাশি ভোটাররা হয়তো মনে করেছে, বিএনপি ও আ’লীগ ক্ষমতায় ছিল। তাদের শাসন দেখা হয়ে গেছে। তাই জনগণ এখন হয়তো জামায়াতকে দেখতে চাচ্ছে।
অনুষ্ঠানে জরিপের ফল তুলে ধরেন বিআইজিডির ফেলো অব প্র্যাক্টিস সৈয়দা সেলিনা আজিজ জানান, জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৫৩ শতাংশ পুরুষ, ৪৭ শতাংশ নারী, ৭৩ শতাংশ গ্রামের ও ২৭ শতাংশ শহরের।
কোন সংস্কারগুলো প্রয়োজন বলে মনে করেন, এই প্রশ্নে একাধিক উত্তর দেওয়ার সুযোগ ছিল। এর উত্তরে ৩০ শতাংশ মানুষ আইনশৃঙ্খলার উন্নয়নের কথা বলেছেন। আইন ও বিচারব্যবস্থার উন্নতির কথা বলেছেন ১৬ শতাংশ। এ ছাড়া ১১ শতাংশ মানুষ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ১৬ শতাংশ অর্থনীতি বা ব্যবসা চাঙা করা, ১৩ শতাংশ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমানো, ১০ শতাংশ বেকারত্ব কমানো, ১৭ শতাংশ দুর্নীতি দমনের কথা বলেছেন। এর বাইরে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অসহনশীলতা কমানো এবং নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কারের কথা বলেছেন ১৯ শতাংশ করে মানুষ।