জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮১তম অধিবেশনের সভাপতি পদে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেনি বাংলাদেশ। এ বিষয়ে জাতিসংঘের জেনারেল এসেম্বলি অফিসকে লিখিতভাবে কোনো চিঠি পাঠানো হয়নি, নির্বাচনে অন্য দুই প্রতিযোগী দেশ ফিলিস্তিন বা সাইপ্রাসকে কিংবা যাদের নিকট ইতিমধ্যেই ভোট চাওয়া হয়েছে-সেই সদস্য রাষ্ট্রগুলোকেও বাংলাদেশের প্রার্থিতা বিষয়ে লিখিত বা মৌখিকভাবে কিছু বলা হয়নি। জাতিসংঘ বাংলাদেশ মিশন সূত্রে জানা গেছে যে, এই পদে জাতিসংঘে বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রচারণা আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে এবং বিষয়টি আগামী নির্বাচিত সরকারের সিদ্ধান্তের উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে।

উল্লেখ্য, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভাপতির পদটি প্রতি বছর পাঁচটি আঞ্চলিক গ্রুপের মধ্যে ঘুরে ঘুরে নির্ধারিত হয়: আফ্রিকান গ্রুপ, এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় গ্রুপ, পূর্ব ইউরোপীয় গ্রুপ, লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় গ্রুপ এবং পশ্চিম ইউরোপ ও অন্যান্য রাষ্ট্রসমূহের গ্রুপ। এ বছরের নির্বাচনে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় গ্রুপ থেকে নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশ পাঁচ বছর আগেই প্রার্থীতা দিয়ে রেখেছে। বাংলাদেশের প্রার্থী হয়েছেন বর্তমান পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। তার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় রয়েছেন সাইপ্রাসের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী সচিব, রাষ্ট্রদূত আন্দ্রেয়াস কাকৌরিস এবং সর্বশেষ প্রার্থী হিসেবে এ বছর মার্চ মাসে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছেন জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের স্থায়ী পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রদূত রিয়াদ মনসুর। আগামী ২০২৬ সালের জুন মাসে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। স্মরণ করা যেতে পারে, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভাপতি পদে ফিলিস্তিনের প্রার্থীতার বিষয়টি নজরে আসার পর বিগত সেপ্টেম্বর মাসে নিউইয়র্কে অবস্থানকালীন প্রধান উপদেষ্টা ফিলিস্তিনের পক্ষে বাংলাদেশের প্রার্থিতা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। এ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টাকে উদ্ধৃত করে ৩০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের সকল সংবাদ মাধ্যমে ফলাও করে সংবাদ প্রচার হয়। সম্প্রতি, নিউইয়র্কে ফিলিস্তিনি দূতাবাস সূত্রে জানা যায় যে, বাংলাদেশ তাদেরকে এ বিষয়ে লিখিতভাবে কিছু জানায়নি। জানতে চাইলে, জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত অফিসিয়ালি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। ঢাকায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার কার্যালয়ের পরিচালক বলেন, ‘এ বিষয়ে স্যার (পররাষ্ট্র উপদেষ্টা) কিছু না বলা পর্যন্ত আমার পক্ষে মন্তব্য করা অসম্ভব’। গত বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে লিখিতভাবে জানতে চাওয়া হয় জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্রের অফিসে। “বাংলাদেশ কি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভাপতি পদে নির্বাচনের প্রার্থীতা প্রত্যাহার করেছে? এ বিষয়ে বাংলাদেশ কি জাতিসংঘকে লিখিতভাবে কিছু জানিয়েছে? এমন প্রশ্নের লিখিত জবাবে মুখপাত্র ফারহান আজিজ হক এ প্রতিনিধিকে জানান, ‘এ বিষয়ে জাতিসংঘে আমরা বাংলাদেশ সরকারের নিকট থেকে কিছু পাইনি-আপনি বিষয়টি নিশ্চিত হতে চাইলে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।’

২০১৬ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭১ তম অধিবেশনের সভাপতি পদে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় গ্রুপের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে লড়েছিলো সাইপ্রাস। ওই বছর একই গ্রুপের প্রার্থী ফিজির সাবেক রাষ্ট্রদূত পিটার থমসন, সাইপ্রাসের প্রার্থী আন্দ্রেয়াস মাভরোইয়ানিসকে ৯৪-৯০ ভোটে পরাজিত করে বিজয়ী হন। সাইপ্রাসের প্রার্থী আন্দ্রেয়াস মাভরোইয়ানিস ছিলেন সাইপ্রাস সংকট সমাধান আলোচনার প্রধান আলোচক ও জাতিসংঘে দেশটির রাষ্ট্রদূত। ওই বছরের নির্বাচনে মাত্র চার ভোট হেরে গিয়ে ১০ বছরের ব্যবধানে এ বছর আবারো প্রার্থী হয়েছে সাইপ্রাস। বাংলাদেশ শেষবার এই মর্যাদাপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৮৬ সালে, যখন তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী জাতিসংঘের ৪১তম সাধারণ পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হন। এরপর দীর্ঘ চল্লিশ বছর এইপদে প্রার্থীতা দেয়নি বাংলাদেশ।

এবারের নির্বাচনে সর্বশেষ প্রার্থীতা জমা দিয়েছে জাতিসংঘের একমাত্র নন-মেম্বার অবজার্ভার স্টেট ফিলিস্তিন। ২০০৫ সাল থেকে জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের ‘স্থায়ী পর্যবেক্ষক’ হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী রিয়াদ মনসুর ২০২৬-২৭ সালে সাধারণ পরিষদের সভাপতিত্বের দায়িত্ব নেয়ার জন্য জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, মনসুর মূলত নিজ উদ্যোগেই এই পদে লড়ছেন-কারণ এই মুহূর্তে ফিলিস্তিনে কোনো কার্যকর সরকার নেই। এই নির্বাচনে জেতার মাধ্যমে মনসুর মূলত ফিলিস্তিনের আগামী দিনের নেতৃত্বের দৌড়ে নিজেকে এগিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। আর এ কারণেই গাজায় চলমান ইসরাইলি গণহত্যার মাঝখানে আন্তর্জাতিক মহলের সহমর্মিতাকে কাজে লাগিয়ে নিজের আখের গোছানোর লক্ষ্যে তড়িঘড়ি করে নিজের প্রার্থীতা দাখিল করেছেন এই ঝানু কূটনীতিবিদ। জাতিসংঘের বহুপাক্ষিক কূটনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্ববাস্তবতা বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য ও ফিলিস্তিননীতি সম্পর্কে যাদের ন্যূনতম ধারণা আছে তারা জানেন, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভাপতির হাতে ফিলিস্তিনের জাতীয় স্বার্থ আদায়ের কোনো কার্যকর টুলস নেই। নিউইয়র্কে কূটনীতিকরা বলছেন, ট্রাম্প প্রশাসন ইতিমধ্যেই জাতিসংঘের সংস্থাগুলি থেকে বিপুল অর্থায়ন প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। ফিলিস্তিনের মতো একটি অ-রাষ্ট্রীয় সদস্য দেশের প্রতিনিধি এর আগে কখনও জেনারেল অ্যাসেম্বলির সভাপতিত্ব করেননি, ফিলিস্তিন প্রার্থী দেয়ার ফলে তা একটি আইনি ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে।

উল্লেখ্য, গত বছর মে মাসে, সাধারণ পরিষদ ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে রাষ্ট্র বহির্ভূত সদস্যদের (নন-মেম্বার অবজারভার স্টেট) জন্য সংরক্ষিত অধিকারের বাইরেও নতুন কিছু অধিকার (রাইটস এন্ড প্রিভিলিজেস) প্রদানের জন্য একটি অভূতপূর্ব পদক্ষেপ অনুমোদন করেছে, যার মধ্যে সাধারণ পরিষদের সামনে যেকোনো বিষয়ে কথা বলা এবং উত্থাপিত যেকোনো প্রস্তাবে সংশোধনী আনা অন্তর্ভুক্ত ছিল। সাধারণ পরিষদের প্রস্তাবে স্পষ্টভাবে ফিলিস্তিনিদের সাধারণ পরিষদের সভাপতি পদ ধারণ করার অধিকার দেয়া হয়নি, তবে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস পরবর্তীতে এক ব্যাখ্যায় বলেছেন যে, ফিলিস্তিনি প্রতিনিধি দলের একজন সদস্য জেনারেল এসেম্বলির সভাপতির পদ ধারণ করতে আইনি বাধা নেই। এর আগে গত বছর এপ্রিলে, যুক্তরাষ্ট্র ফিলিস্তিনকে পূর্ণ সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের এক প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতে, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ রাষ্ট্রের মর্যাদা পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান পূরণ করতে পারেনি। ফিলিস্তিনকে পূর্ণ সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জাতিসংঘ পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়ায় মার্কিন কংগ্রেস এমন একটি আইন বিবেচনা করছে, যা বিদ্যমান তহবিল নিষেধাজ্ঞাগুলো আরও সম্প্রসারিত করে সেই সমস্ত জাতিসংঘ সংস্থাকে অন্তর্ভুক্ত করবে, যারা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ বা প্যালেস্টাইন মুক্তি সংস্থাকে পর্যবেক্ষক মর্যাদার বাইরে নতুন কোনো মর্যাদা, অধিকার বা সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে। অন্যদিকে, মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন মুখপাত্র বিগত ২৮ মার্চ ২০২৫ জানিয়েছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভাপতির পদে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রার্থিতার বিরোধিতা করে।’ এমতাবস্থায় ফিলিস্তিনের পক্ষে বাংলাদেশের প্রার্থিতা প্রত্যাহার হলেই যে ফিলিস্তিন সাধারণ পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হতে পারবে, তাঁর কোনো নিশ্চয়তা নেই। কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, বিগত ৪০ বছরে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে উদযাপন করার মতো বাংলাদেশের অনেক অর্জন রয়েছে। সে তুলনায় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতে বাংলাদেশের নেতৃত্ব অনেক কম। এখন সময় এসেছে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অবস্থান ‘রিক্লেইম’ করা। তারা বলছেন, ফিলিস্তিনি প্রার্থিতার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশ্য বিরোধিতার মুখে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভাপতি পদে নির্বাচনে বাংলাদেশের প্রার্থিতা প্রত্যাহার মানেই সাইপ্রাসের হাতে বিজয় তুলে দেওয়া।