রংপুরের গ্রাম্য ডাক্তার জাহাঙ্গীর আলম সিদ্দিকী। নিজে রোগী দেখার পাশাপাশি করতেন মেডিসিনের ব্যবসা। ১৯ জুলাই আন্দোলনকারীদের আশ্রয় দেওয়ার কারণে পুলিশ গুলী করে পঙ্গু করে দেয় তাকে। সে গল্প বলেছেন দৈনিক সংগ্রামকে। লিখেছেন ইবরাহীম খলিল ।
দৈনিক সংগ্রাম : জুলাই আন্দোলনে আপনার পায়ে গুলী করে পঙ্গু করে দেয় আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী। আপনার গল্পটা বলেন কিভাবে আপনি আহত হয়েছেন।
ডাক্তার জাহাঙ্গীর : রংপুর শহরের নিউ মার্কেটে আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ১৯৭৭ সাল থেকে আমরা মেডিসিন ব্যবসার সাথে জড়িত। ১৯৯৪ সালে বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে আমি এই প্রতিষ্ঠানের হাল ধরি। এই প্রতিষ্ঠানে আমি গ্রাম্য ডাক্তার হিসেবে সকাল বিকাল চেম্বার করি। ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই শুক্রবার আসরের নামাজ পড়ে চেম্বারে বসি। অর্ধেক সাটার খোলা রেখেই দোকানে বসি। দেখি আমার সামনের দোকানের ছোট ভাই বাইরে চেয়ার পেতে বসে আছে। আমরা কোথায় কোথায় গোলাগুলী হয়েছে তা নিয়ে কথা বলছিলাম। পাশে থেকে একটা ছেলে এসে বললেন ভাই অবস্থা ভাল না পারলে চলে যান। তার নাম রুহুল। আমার দোকানের সামনে ভাসমান কাপড়ের ব্যবসা করেন। রুহুল বললো আমি তিনজনের লাশ দেখেছি। বাকীদের লাশ পুলিশ নিয়ে গেছে। এই বলে চলে যাওয়ার পর আমি বাসায় ফোন দিলাম।
দৈনিক সংগ্রাম : তখন কয়টা বাজে ?
ডা. জাহাঙ্গীর : তখন অনুমান ৬টা বাজে। পূর্বদিকে মেইন রোডের দিকে ফিরে বসে আছি। বাসায় কথা বলে মোবাইল রাখতেই দেখলাম রোডে সাজোয়া যান এবং পুলিশ। আমরা চারজন ছিলাম। পুলিশ দেখে সবাই দোকানের ভেতর ঢুকলাম। এরমধ্যে একটা ছেলে আমার দোকানে ঢুকেই সাটারটা লাগিয়ে দিল। সাটার লাগানোর কারণে একটা শব্দ হয়েছে। পুলিশও ছেলেটাকে দেখেছে। দেখার পর পুলিশ বলছে দরজা খুলেন দরজা খুলেন। আমি বললাম যে এটা ওষুধের দোকান। আমি সাটার খুলছি। কিন্তু ওরা আমার কোন কথাই শুনলো না। তারা লাথি মেরে লাঠিসোটা দিয়ে দিয়ে খুঁচিয়ে সাটার ফুটো করে। যেন সাটার ওঠাতে পারে। আমি কিন্তু বলছি যে আমি ডাক্তার, এটা ওষুধের দোকান। আপানারা দেখেন। আমার কোন ক্ষতি করিয়েন না। এতোক্ষণে কিছু করতে না পেরে চলে যাওয়ার সময় বাইরে থেকে ফুটো দিয়ে আমার পায়ে অনেকগুলো গুলী করলো। গুলী করার সাথে সাথে আমার বাম পায়ের লিগামেন্ট ছিড়ে সঙ্গে সঙ্গে রক্তে পুরো চেম্বার ভেসে গেলো। আমি আমার দোকানে আশ্রয় নেওয়া ছেলেটাকে বললাম ভাই আমার রক্তটা তাড়াতাড়ি বন্ধ করো। কাপড় দিয়ে তিন বাঁধ দেওয়ার পর কিছুটা বন্ধ হলো। তারপর বাসায় ফোন করে বললাম আমার পায়ে পুলিশ গুলী করেছে। আমাকে ব্লাড দিতে হবে। যেভাবেই হউক ব্লাড ম্যানেজ করো। পুলিশ চলে যাওয়ার পর বেশ কিছু ছেলেরা আমার দোকান ভাঙ্চুর করে। আমার মোটর সাইকেল ভাঙ্চুর করে। ততক্ষণে দোকানের সাটার খুলে বাইরে বের হলাম। আর বললাম তাড়াতাড়ি আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাও। প্রথমে আমি আমার ছোট ভাইয়ের ক্লিনিকে ভর্তি হ্ই। আমাকে সেদিন একজন সাংবাদিক আমাকে নিয়ে আসে। যখন আমি পরিচয় দিলাম যে আমি ডাক্তার। তারপর আমার ছোটভাই বড়ভাই মিলে নিয়ে গেলো প্রাইম মেডিকেল হাসপাতালে। প্রথমে হাসপাতাল ভর্তি নিতে চাইলো না কারণ পুলিশের গুলী খাওয়া লোক। তখন আমার পরিচয় দিলাম আমার ছোট ভাই উকিল পরিচয় দিলো। আমি বললাম আমাকে বাঁচাতে হলে এই মুহুর্তে রক্ত দিতে হবে। সাথে সাথে ওটিতে নিয়ে ব্লাড দেওয়া হলো আধা ঘন্টার মধ্যে। প্রথম ব্লাড দেন আমার মেয়ের জামাই। পরে দেয় ছোট ভাইয়ের ছেলে। সেখানে তিন দিন থাকার পর আমাকে আরেক মেডিকেলে নিয়ে যায়।
দৈনিক সংগ্রাম : কোথায় নিয়ে গেল ?
ডা. জাহাঙ্গীর : সেটাকে হাব মেডিকেল বলে। ওখানে নিয়ে যাওয়ার পর দেখি শুধু ওয়াশ করে। আমার লেগামেন্ট ছিড়ে গেছে, মাংস রিপ্লেসমেন্ট করা লাগবে। কিন্তু সেখানে তা করা হলো না। পরে রংপুর মেডিকেলের হেড ডাক্তার শফিকুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। সেখানে ২৫জুলাই দেখা করি। এরপর ওনার পরামর্শে সেদিনই ঢাকায় যাই।
দৈনিক সংগ্রাম : ঢাকা কোথায়, পঙ্গুতে ?
ডা. জাহাঙ্গীর : না। ঢাকায় প্রথম একটা প্রাইভেট ক্লিনিকে ভর্তি হই। রাত সাড়ে তিনটায় ভর্তি হই। কিন্তু সকাল সাড়ে দশটার সময় আউট করে দিলো। বিল বাবদ আমার ২৩ হাজার টাকা নিলো। আমাকে বললো আপনার চিকিৎসা হবে না। কারণ হাসিনার নিষেধ। সরকারের নিষেধ। গুলী খাওয়া লোকের কোন চিকিৎসা হবে না।
দৈনিক সংগ্রাম : আমি ওই ক্লিনিকের নামটা জানতে চাচ্ছি।
ডা. জাহাঙ্গীর : নাম বলা যাবে না। পরে সেদিন এক ডাক্তারের সাথে কথা বলে আরেকটা ক্লিনিকে গিয়ে ভর্তি হই। ওখানে দুই দিন থাকার পর সেখানে এক ধরণের কন্টাক্টে অপারেশন করে। ২৬ তারিখ থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ওই ক্লিনিকে ছিলাম। মোটামুটি তখন সুস্থ হওয়ার মতো। রংপুর চলে আসি। এরপর ২১ দিন পর আমার ঢাকাতে যাওয়া লাগে। এখন সব সময় মনে হয় আমার পায়ে আগুন জ¦ালিয়ে রাখা হয়েছে। অসহ্য যন্ত্রণা হয়। হাটা চলায় ভীষণ অসুবিধা হয়।
দৈনিক সংগ্রাম : আপনাকে যে, পুলিশ গুলী করলো ওই পুলিশকে কি দেখেছেন বা চিনেন ? নাম জানেন?
ডা. জাহাঙ্গীর : ১০/১২ ফুট দূরে থেকে দেখেছি। কিন্তু তাকে দেখলে চিনবো না। তার নামও বলতে পারবো না।
দৈনিক সংগ্রাম : আপনাকে কি শর্টগান থেকে গুলী করেছে , নাকি পিস্তল থেকে ?
ডা. জাহাঙ্গীর : ওই গুলির কার্টিজটা আমার কাছে আছে। প্লাস্টিকের কার্টিজ, স্পেনের তৈরি। ওর মধ্যে চার পাঁচটা সরিষার দানা থাকে স্টিলের। ওটা দিয়ে কোর্টে মামলা করা হয়েছে। কোর্টে জমা দেওয়া হয়েছে। মামলা তদন্ত করা হচ্ছে। পুলিশ মামলার সাক্ষী চাচ্ছে।
দৈনিক সংগ্রাম : পুলিশ যে গুলী করেছে আপনার কি অপরাধ ছিল ?
ডা. জাহাঙ্গীর : আমারতো কোন অপরাধ দেখি না। আমি ডাক্তার মানুষ। প্রাইভেট প্র্যাকটিস করি। ওদিন আন্দোলনকারীদের আমার দোকানে জায়গা দিয়েছি সেটাই আমার অপরাধ।
দৈনিক সংগ্রাম : পুলিশ কি তাদের গ্রেফতার করেছিল ?
ডা. জাহাঙ্গীর : না। পুলিশ গুলী করেতো চলে গেছে। আমাদের তিনজনকে গুলী করেছে। আমরা তিনজন আহত হয়েছি। আমি বেশি আহত হয়েছি। তারাতো একটু কম হয়েছে। তাদের একজনের নাম মিঠু আরেকজনের নাম আলাল। তাদেরকে রংপুর মেডিকেল কোন চিকিৎসা দেয়নি। পুলিশ তাদের পিটিয়েছে। সেদিন আমাদের সাটার খুলতে পারেনি। তাই তাদের গ্রেফতারও করতে পারেনি।
দৈনিক সংগ্রাম : পুলিশ কি বুঝতে পারে যে আপনি আহত হয়েছেন ?
ডা. জাহাঙ্গীর : গুলী করার পরতো আমি চিৎকার করে বলছিলাম যে আমাকে মেরে ফেলে গেলেন! একথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে ফেলে চলে গেছে।
দৈনিক সংগ্রাম : আপনার চিকিৎসা কি এখনো চলে ?
ডা. জাহাঙ্গীর : জি¦। ওষুধ খাওয়া লাগে। নিয়মিত। শুয়ে থাকলে প্রচন্ড ব্যাথা হয়। অস্বস্থি লাগে।
দৈনিক সংগ্রাম : আপনি সরকারের কাছে কি চান ?
ডা. জাহাঙ্গীর : আমি দেশের সর্বোচ্চ চিকিৎসা করে এসেছি। বিদেশে চিকিৎসা করা হলে ভাল হয়।
সংশোধনী
গতকাল ১২ জুলাই শনিবার ‘জুলাই আগস্টের সাক্ষ্য’ শিরোনামে নাঈমুর রহমান আশিকের সাক্ষাতকার ছাপা হয়েছে। ভুল বশত তার নাম নাঈমুর রহমানের স্থলে মাইদুর রহমান আশিক ছাপা হয়েছে। অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য দু:খিত।