# ভারত কখনো চায়নি আমাদের সেনাবাহিনী-বিজিবি সক্রিয় থাকুক
ভারতে পলাতক স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা সরকারের আয়না ঘরে বন্দী থাকা সেনা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্ণেল (অব.) হাসিনুর রহমান বীরপ্রতীক বলেছেন, আমি কখনো ভারতের আধিপত্যবাদকে সহ্য করতে পারতাম না। ভারত কখনো চায়নি আমাদের সেনাবাহিনী, বর্ডার গার্ড (বিজিবি) সক্রিয় থাকুক। পাশর্^বর্তী এই দেশটি সবসময় বাংলাদেশের সার্ভভৌমত্বের জন্য হুমকি ছিল। ভারত সব সময় চেয়েছে বাংলাদেশ একটি নতজানু রাষ্ট্র হিসেবে থাকুক। আমি সবসময় এসব ব্যাপারে সোচ্চার ছিলাম। আমার চাকরি জীবনে ওরা আমাকে ভারতপন্থী করতে নানা প্রলোভন দেখিয়ে ব্যর্থ হয়ে গুম করেছে। আয়নাঘর থেকে ফিরে আসা সাবেক সেনা কর্মকর্তা হাসিনুর রহমান দৈনিক সংগ্রামকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন।
লেফটেন্যান্ট কর্ণেল (অব.) হাসিনুর রহমান বলেন, আমাকে দুইবার গুম করে আয়নাঘরে রাখা হয়েছিল। প্রথমবার কারাগারে নেয়া হলেও দ্বিতীয়বার রাখা হয় গোপন বন্দীশালা আয়না ঘরে। ২০১৮ সালে কেন ভয়াবহ আয়নাঘরে গুম করে রাখা হয়েছিল এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি একমাত্র অফিসার যাকে সার্ভিসে থাকা অবস্থায় গুম করা হয়। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখালেখি করার জন্য আমাকে টার্গেট করা হয়। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’, তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ ও স্বৈরাচারী আমলে গুমের প্রধান কারিগর মেজর জেনারেল জিয়াউলের (গ্রেফতার) নির্দেশনায় কুখ্যাত আয়নাঘরে বন্দী জীবন কাটাতে হয়েছে আমাকে। তিনি বলেন, র্যাবে থাকার সময় আমাকে প্রতিবেশী একটি দেশের গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে কাজ করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু আমি তাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলাম। এসব কারণেই মূলত আমাকে টার্গেট করা হয়েছিল। তিনি বলেন, বিডিআর (বিজিবি) ইস্যুতে আমি কথা বলতাম। বিডিআর হত্যাকাণ্ডের ইস্যুতে শেখ হাসিনা নিজে জড়িত। তার সঙ্গে থাকা লোকজনও দায়ী। বিডিআরের ঘটনার পর সেনাবাহিনীর ৯০-৯৫ শতাংশ লোক শেখ হাসিনা সরকারকে ঘৃণা করত। বাকি ৫ শতাংশ যারা তাকে চাইত, তারা হলো অসৎ জেনারেল।
হাসিনুর রহমান বলেন, ২০১১ সালে প্রথমবার ক্যু করব বলে ধারণা থেকে গুম করে, যা মিথ্যা ছিল। তিনি বলেন, সার্ভিসে থাকা অবস্থায় আমাকে টানা ৪৩ দিন জিজ্ঞাসাবাদের নামে চরম নির্যাতন করা হয়েছে। পরে সাবেক এক সেনাপ্রধানের সমালোচনা করে দেওয়া এক নেতিবাচক পোস্ট শেয়ার করার শাস্তি হিসেবে আমাকে ২০১৮ সালের ৮ অক্টোবর মিরপুর ডিওএইচএস থেকে তুলে নেয়া হয়। এর আগে ২০১৮ সালের ৫ সেপ্টেম্বর আমাকে সেনাবাহিনী থেকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে চিঠি দেওয়া হয়।
সাবেক সেনা কর্মকর্তা হাসিনুর রহমান বলেন, আয়নাঘরে কোনো কোনো বন্দীকে বিভিন্ন প্রস্তাব দেওয়া হতো। যারা কথা শুনত না তাদের ওপর নেমে আসত নির্যাতনের খড়গ। আমাকেও অমানবিক নির্যাতন করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমি এক বছর ৬ মাস ১৪ দিন আয়নাঘরে ছিলাম। এ সময় আমার পরিবার কেমন আছেন, মারা গেছে না জীবিত, আমার বৃদ্ধা মা কেমন আছেন কিছুই জানতাম না। পরিবার আমার অবস্থান জানত না। আয়নাঘরের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের কাছে অনেক মিনতি করেছি আমাকে মুক্তি দেওয়ার জন্য। কিন্তু তারা আমার কাকুতি-মিনতি শোনেনি। একপর্যায়ে তাদের কাছে মুক্তি চাওয়ার আবেদন করা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। কারণ, তাদের কাছে আবেদন করা ছিল অরণ্যে রোদন।
বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি অন্যায় সহ্য করতে পারতাম না। আমি দেখলাম বেগম খালেদা জিয়া যিনি একাধিকবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, একজন সেনা প্রধানের স্ত্রী তাকে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে এক কাপড়ে বের করে দেয়া হলো। আমি সামাজিক মাধ্যমে এর প্রতিবাদ করেছি। শেখ হাসিনা শান্তিচুক্তির নামে প্রহসন করলো। এছাড়া প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে নির্মমভাবে শহীদ করা হয় যা আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারিনি। এসব কারণে আমি দীর্ঘদিন ধরেই তাদের টার্গেটে ছিলাম। তিনি বলেন, প্রথমবার গুম করার পর আমাকে কারাগারে শায়খ আব্দুর রহমানের ছেলে নাবিলের সেলে রাখা হয়। র্যাবে থাকাকালে বড় বড় জঙ্গী অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিলাম আমি। ওরা কৌশলে আমাকে জঙ্গী সেলে রাখে। সেখানে আব্দুর রহমানের ছেলেকে আমার ব্যাপারে পরোক্ষভাবে লেলিয়ে দেয়া হয়। শায়খ আব্দুর রহমানের ছেলে জানতো জঙ্গী বিরোধী অভিযানে আমার ভূমিকার কথা। কারাগারে আব্দুর রহমানের ছেলে আমাকে বলেছিল ‘আপনাকে হত্যা করা হবে’। তিনি বলেন, কারাগারের ভেতরে জঙ্গী সেলে যদি এভাবে হত্যার হুমকি দেয়া হয় তখন স্বভাবতই আতঙ্কিত হওয়ার কথা। তিনি বলেন, আমি মৃত্যুকে ভয় করি না। হাসিনুর রহমান বলেন, কারাগারে আমি ডিভিশন পাওয়ার কথা থাকলেও তা দেয়া হয়নি। আমাকে প্রথমবার কারাগারে কন্ডেম সেল, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সেল ও পরবর্তীতে হাই সিকিউরিটি সেলে রেখে শাস্তি দেয়া হয়।
লেফটেন্যান্ট কর্ণেল (অব.) হাসিনুর রহমান বলেন, ২০১৮ সালের ৮ আগস্ট মিরপুরের বাসার সামনে থেকে আমাকে তুলে নিয়ে একটি কক্ষে বন্দী রেখে পরিহিত কাপড় খুলে একটা লুঙ্গি ও ছেঁড়া গেঞ্জি পরিয়ে দেয়। তার আগে আমাকে অনেক মারধর করে। এরপর তারা ১০ বাই ৮ ফুট একটি কক্ষে ঢুকিয়ে দেয়। আমি ওই কক্ষে একা ছিলাম। জানালা ও ফ্যান ছাড়া ভ্যাপসা একটি কক্ষ। আশপাশের রুম থেকে আসছে টর্চারের কান্নার শব্দ। মাথার ওপর উচ্চ পাওয়ারের বাতি জ্বালানো। ভীতিকর পরিবেশ। যারা আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে তাদের কথা শুনে মনে হয়েছে তারা বিএমএতে (বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি) প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। বাসা থেকে সেখানে যেতে মাত্র ৩০ মিনিট লেগেছে। ধারণা করেছিলাম যে, আমাকে ডিজিএফআইয়ের অফিসে নিয়ে আসা হয়েছে। তিনি বলেন, আমাকে যেখানে আটকে রাখা হয়েছিল সেই স্থানটি মিরপুরে ডিজিএফআইয়ের সদর দপ্তরের দক্ষিণ দিকে। গুম ঘরে ছিল মেশিন্যাবল সিস্টেম। পিন কোড থাকত। পিন দিলে সেটি খুলত। গুম ঘর থেকে মাঝে মাঝে হেলিকপ্টারের শব্দ ও রেলের হুইসেল শোনা যেত। নতুন ও পুরোনো ব্লকে ২০ থেকে ২৫ জন বন্দী থাকত। কক্ষ ছিল অন্ধকার। ২৪ ঘণ্টা লাইট জ্বালানো থাকত। যদি কোনো বন্দীকে ছেড়ে দেওয়া হতো তাহলে রুমগুলো অন্ধকার থাকত। প্রতি রুমে বড় ফ্যান ছিল, যা খুব আওয়াজ করত। বাইরে থেকে নির্যাতনের বিষয় যাতে বুঝতে না পারে এজন্য ফ্যান লাগিয়েছিল। মাত্র দুটি বাথরুম। একজন ব্যবহার করার পর অন্যজনকে নিয়ে যাওয়া হতো। সেখানে মশার উপদ্রব ছিল, কিন্তু মশারি দেওয়া হতো না। সিলভার কার্প, তেলাপিয়াসহ পচা মাছ দেওয়া হতো। আমাদের বিভ্রান্ত করার জন্য উচ্চস্বরের সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহার করে বৃষ্টির শব্দ, স্কুলের ঘণ্টা ও ভীতিকর শব্দ শোনানো হতো।
গুমের আগমুহূর্তের বর্ণনা দিতে গিয়ে র্যাব-৭ এর সাবেক অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল হাসিনুর রহমান জানিয়েছেন, গুম হওয়ার আগেই তিনি আশঙ্কা করেছিলেন যে, তাকে তুলে নেওয়া হতে পারে। তবে তিনি সবসময় সতর্ক ছিলেন এবং নিজেকে গোপন রাখার চেষ্টা করতেন। আমি বুঝতে পারছিলাম, আমাকে সুযোগ পেলে নিয়ে যাবে। তাই আমি মোবাইল ফোন ব্যবহার করতাম না, চলাফেরাও করতাম গোপনে। তিনি আরও বলেন, তুলে নেওয়ার মুহূর্তেও আমি প্রতিরোধের চেষ্টা করেছিলাম। আমার কাছে লাইসেন্স করা অস্ত্র ছিল, আমি ১০ মিনিট পর্যন্ত তাদের কন্টেইন করে রাখি। কিন্তু একজন অফিসারের পক্ষে নিজের সৈনিকের ওপর গুলী চালানো সম্ভব নয়।
হাসিনুর রহমান বলেন, ২০২০ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি আমাকে তারা আমার বাড়ির সামনে ফেলে রেখে যায়। এ সময় আমি আমার মেয়েকে ও স্ত্রীকে দেখতে পাই। ডিজিএফআইয়ের কর্মকর্তারা আগে থেকেই যোগাযোগ করেছিল আমার স্ত্রী ও মেয়েদের সঙ্গে। আমি যে মুক্তি পাচ্ছি সেটি তারা জানত। কোন মনোবল নিয়ে তিনি আয়নাঘরে বন্দী জীবন কাটিয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, সৃষ্টিকর্তার প্রতি আস্থা রেখেছি। সৃষ্টিকর্তা যদি কাউকে রক্ষা করেন তাহলে পৃথিবীর কেউ তার ক্ষতি করতে পারে না। আমি দেশের মানুষের জন্য কাজ করতে চাই। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য প্রয়োজনে নিজের জীবন বিসর্জন দিতে রাজি আছি। মুক্তির পর অসংখ্য মামলা হয় জানিয়ে হাসিনুর রহমান বলেন, আয়নাঘর থেকে মুক্তি পাওয়ার পর একপর্যায়ে আমার বিরুদ্ধে ১০টি মামলা করে। সে সময় প্রতিদিনই পুলিশের লোক এসে সন্ধান করত। ফলে দুই বছর কোনো ফোন ব্যবহার ছাড়া বাইরে বাইরে থাকতাম। আমাকে রাখা হয়েছিল তখন গোয়েন্দা নজরদারিতে। তখন যারা আয়নাঘর থেকে মুক্তি পেয়েছিল, অন্যরা কথা বলেনি। আমিই একমাত্র কথা বলতাম।
লেফটেন্যান্ট কর্ণেল (অব.) হাসিনুর রহমান বলেন, আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে আমি বেঁচে আছি। ওরা আমাকে ছেড়ে দেয়ার জন্য গুম করেনি, চেয়েছিল হত্যা করতে। বিভিন্ন কারণে আমাকে তা সম্ভব হয়নি। আমাকে গুম করার আগে ব্যারিস্টার আরমান ও আব্দুল্লাহিল আমান আজমিকেও গুম করা হয়। তিনি বলেন, জুলাই বিপ্লবের পরে আমি আয়নাঘর পরিদর্শন করে সেই স্থানগুলো চিহ্নিত করতে পেরেছি। যেখানে আমাকে রাখা হয়েছিল সেই স্থানটিও চিহ্নিত করতে পেরেছি। তিনি আয়না ঘরের করুণ দৃশ্যের কথা বর্ণনা করে বলেন, দেখলাম দেয়ালে কারো মোবাইল নম্বর, ছোপ ছোপ দাগ।
হাসিনুর রহমান বীরপ্রতীক ১৯৮২ সালে ১০ বিএমএ লং কোর্সের মাধ্যমে সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। তিনি প্রেষণে র্যাবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৮৪ সালের জুনে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির ১০ম দীর্ঘ কোর্সে কমিশন লাভ করেন। ২০০৬ সালের এপ্রিল মাসে তিনি জামাত-উল-মুজাহিদিন বাংলাদেশের সদস্যদের গ্রেপ্তারের জন্য পাহাড়তলী অপারেশনের নেতৃত্ব দেন। সেনাবাহিনী থেকে যখন তাকে বরখাস্ত করা হয় তখন তিনি আর্মি ট্রেনিং অ্যান্ড ডকট্রিন কমান্ডে নিযুক্ত ছিলেন।