তিন দফা দাবিতে প্রকৌশলের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনা অভিমুখে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তি হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনতে একপর্যায়ে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে। জলকামান দিয়ে পানি ছোড়ে। এরপরও পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এসময় দুই পুলিশসহ অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন। তবে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে আহতের সংখ্যা অর্ধশতাধিক। গতকাল বুধবার দুপুরে এ ঘটনা ঘটে।

প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, দুপুর দেড়টার পর আন্দোলনরত প্রকৌশল শিক্ষার্থীরা যমুনা অভিমুখে যাওয়ার চেষ্টা করলে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে তাদের বাধা দেয় পুলিশ। এসময় পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ধস্তাধস্তি শুরু হয়। একপর্যায়ে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড, কাঁদানেগ্যাস ও জলকামান দিয়ে পানি ছোড়ে। পরে পুলিশ লাঠিচার্জ করলে একপর্যায়ে শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। ঢামেক হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আহতদের মধ্যে দুজনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। চারজন জরুরি বিভাগে চিকিৎসাধীন। ঢামেক হাসপাতাল পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ (পরিদর্শক) মো. ফারুক জানান, এ পর্যন্ত সাংবাদিকসহ ছয়জন ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে আহত হয়ে এসেছেন। তাদের মধ্যে দুজনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। অন্যরা চিকিৎসাধীন।

আহতরা হলেন-বুয়েট শিক্ষার্থী নাবিদ (২১), শাহাদাৎ (২২), নাভিদ (২১), রিজন (২৩) ও হাসান (২২) এবং নিউ নেশন পত্রিকার সাংবাদিক আলম শরীফ শিমুল (৩২)। পরে আহত অবস্থায় তাদের উদ্ধার করে গতকাল বুধবার দুপুর আড়াইটার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়। আহত আহসান উল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাইম মির্জা জানান, ‘মিছিলের সামনে ছিলাম। হঠাৎ বিকট শব্দের সঙ্গে কিছু একটা এসে আমার বাঁ পায়ে আঘাত করে। পুলিশের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সহ (বুয়েট) বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের একদল শিক্ষার্থী সকাল ১০টার দিকে পূর্বঘোষিত ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি পালনের উদ্দেশ্যে সড়কে অবস্থান নেন। এতে শাহবাগ দিয়ে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

এদিকে তিন দফা দাবির পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্তে গঠিত কমিটি প্রত্যাখ্যান করেছে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। গতকাল বিকেলে রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনে সাংবাদিক সম্মেলনে শিক্ষার্থী প্রতিনিধি জুবায়ের আহমেদ এ কথা জানান। এসময় তিনি পাঁচটি দাবি ঘোষণা করেন। সাংবাদিক সম্মেলনে শিক্ষার্থী প্রতিনিধি জুবায়ের আহমেদ বলেন, প্রকৌশল অধিকার আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে আন্দোলনকারীদের সামনে এসে ওই ঘটনার জন্য ক্ষমা চাইতে হবে এবং জবাবদিহি করতে হবে। তিনি আরও বলেন, প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে গঠিত কমিটিতে আমাদের প্রতিনিধিত্বের অনুপস্থিতি থাকায় আমরা সেটিকে প্রত্যাখ্যান করলাম। তিনি বলেন, অনতিবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রতিনিধিসহ প্রকৌশল অধিকার আন্দোলনের স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে কমিটি সংস্কার করতে হবে। পেশ করা তিন দফা দাবিকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে মেনে নিয়ে নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে। উপদেষ্টা মোহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, আদিলুর রহমান এবং সৈয়দ রিজওয়ানা হাসানকে আজকেই এর নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে। সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি আরও বলেন, পুলিশের হামলায় আহত সব শিক্ষার্থীর চিকিৎসার ব্যয় সরকারকে বহন করতে হবে। আন্দোলন চলাকালীন সময়ে সব শিক্ষার্থীর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। পুলিশ দিয়ে এই যৌক্তিক আন্দোলনে আর কোনো প্রকার হামলা করা যাবে না। শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকারীদের অনতিবিলম্বে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনতে হবে এবং চাকরিচ্যুত করতে হবে। এছাড়া আন্দোলনে অংশ নেওয়া রোকনের ওপর হামলায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া ও হামলায় জড়িত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান বুয়েটের এ শিক্ষার্থী। সাংবাদিক সম্মেলনে জানানো হয়, পুলিশের হামলায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের অন্তত ৬০ জন আহত হয়েছেন। এর আগে পূর্বঘোষিত ‘লংমার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে বেলা ১১টার দিকে শিক্ষার্থীরা শাহবাগের মূল সড়কে অবস্থান নেন। এতে বন্ধ হয়ে যায় শাহবাগ ও আশপাশের সড়ক। বেলা দেড়টার দিকে শিক্ষার্থীরা যমুনা অভিমুখে রওনা দেন। তারা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড় পেরোনোর চেষ্টা করেন। তখন পুলিশ তাদের বাধা দেয়। এই ঘটনায় কয়েকজন শিক্ষার্থী ও পুলিশ আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে পাঁচজন বুয়েট শিক্ষার্থী।

একই দাবিতে মঙ্গলবার পাঁচ ঘণ্টা শাহবাগ অবরোধ করেছিলেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের দাবির মধ্যে রয়েছে-ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের নামের আগে প্রকৌশলী লিখতে না দেওয়া। ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের কাউকে পদোন্নতি দিয়ে ৯ম গ্রেডে উন্নীত না করা। ১০ম গ্রেডের চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে স্নাতক প্রকৌশলীদের সুযোগ দেওয়া।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগের উপকমিশনারের (ডিসি) মাসুদ আলম বলেন, সমাধান নিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা চলছিল। সচিবালয়ে তিনজন উপদেষ্টা এটা নিয়ে কাজ করছেন। শিক্ষার্থীদের বলা হয়েছিল, শাহবাগে অবস্থান করতে। আধঘণ্টার ভেতরে তাদের সমস্যার সমাধান হবে। আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা শিক্ষার্থীরা বেলা তিনটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে রাজিও হয়েছিলেন। কিন্তু আলোচনা চলাকালীন হঠাৎ শিক্ষার্থীরা যমুনা অভিমুখে রওনা হন। পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে যমুনার দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তখন তাদের ছত্রভঙ্গ করা হয়। এ সময় পুলিশকে লক্ষ করে ইট-পাটকেল ছোড়া হয়। এই ঘটনায় কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। এদিন বিকেল ৪টার দিকে শিক্ষার্থীরা ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড়ে অবস্থান করছিলেন। সেখানে থাকা বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাইয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশের হামলায় আমাদের ৩৫ জনের বেশি আহত হয়েছেন। দাবি না মানা পর্যন্ত আমরা সড়ক ছাড়ব না।