চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু ১০৫ জনের

‘অফ সিজন’ বা ‘পিক সিজন’, বৃষ্টি হোক বা না হোক গোটা বছরজুড়েই থাকে মশার দাপট কমবেশি। এই দাপটের কাছে নগরবাসী কাবু। মশার দাপট আর নগরবাসীর কাবু হওয়াকে পুজিঁ করে বছরের পর বছর মশা নিধনের নামে বাড়ে বাজেট। এক খাতের সাথে নানা উপখাত সৃষ্টি করে বাজেটের অর্থ খরচ হওয়ার পর তহবিল শূণ্য হলেও মশার দাপট কমে না, আগের মতই। ফলে নগরবাসী মশার যন্ত্রণা নিয়ে যে অবস্থায় ছিল, সে অবস্থাতেই দিনপার। পরিবর্তন আর ঘটে না। এই চিত্র হচ্ছে ঢাকা মহানগরবাসীর, যার দেখভাল করার দায়িত্ব দুই সিটি কর্পোরেশনের।

মশার দাপটের কারণে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। তার সাথে বাড়ছে মৃত্যুও। এই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব আরও বাড়বে সামনের দু’মাসে। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরকে ধরা হয় ডেঙ্গুর পিক সিজন। আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যার আকারও হতে পারে ভয়াবহ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবার ডেঙ্গুর যে প্রভাব দেখা যাচ্ছে, তাতে ডিসেম্বর পর্যন্ত এই রোগের ভয়াবহতার চিত্র দেখা যেতে পারে।

গতকাল সোমবার স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, সারা দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৩৮০ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এই সময়ের মধ্যে কেউ মারা যায়নি। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ১০৫ জনের এবং হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৬ হাজার ৭৫৮ জন।

স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, আগস্টে এখন পর্যন্ত ৫ হাজার ৭৭৮ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এবং মারা গেছেন ২২ জন। সারা দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে ১ হাজার ২৭৭ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছেন। যার মধ্যে ঢাকায় ৪২১ জন, বাকি ৮৫৬ জন ঢাকার বাইরে বিভিন্ন বিভাগে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, এই বছরের জানুয়ারিতে ১ হাজার ১৬১ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭৪ জন, মার্চে ৩৩৬ জন, এপ্রিলে ৭০১ জন, মে-তে ১ হাজার ৭৭৩ জন, জুনে ৫ হাজার ৯৫১ জন এবং জুলাইয়ে ১০ হাজার ৬৮৪ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ১০, ফেব্রুয়ারিতে ৩, এপ্রিলে ৭, মে-তে ৩, জুনে ১৯ এবং জুলাইয়ে ৪১ জন মারা গেছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এডিস মশার বিস্তার প্রতিরোধ করে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আনা সময়সাপেক্ষ; নিতে হবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। তাই এই মুহূর্তে আক্রান্তদের মৃত্যুরোধে বেশি জোর দেওয়া দরকার। সে জন্য প্রয়োজন চিকিৎসাব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ। স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, সারা দেশেই চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। নতুন গাইডলাইন অনুযায়ী চিকিৎসা হচ্ছে।

খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেছে, দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় মশার উপদ্রব না কমলেও প্রতিবছর বেড়েই চলেছে মশক নিধনের বাজেট। ক্ষুব্ধ নগরবাসীরা বলছেন, প্রতিবছর মশক নিধনে কোটি কোটি টাকা খরচ করলেও আদতে মশা কমছে না।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বাজেট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত ১০ অর্থবছরে শুধু মশক নিধনের জন্য ২৬৫ কোটি ২২ লাখ টাকা বাজেট বরাদ্দ করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। এরমধ্যে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মশক নিধনের জন্য বাজেট ধরা হয় ১২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে কিছুটা কমিয়ে বাজেট ধরা হয় ১১ কোটি ৫০ লাখ টাকা, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এ খাতে দক্ষিণ সিটিতে বরাদ্দ হয় ২৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মশক নিধন খাতে ২৬ কোটি টাকা এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে খরচ হয়েছে ৩২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে ২০ কোটি ২ লাখ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩১ কোটি ২ লাখ, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২৭ কোটি টাকা, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৩৮ কোটি ৮৩ লাখ ও ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৪০ কোটি টাকা বাজেট ধরা হয়।

মশার উপদ্রব কমাতে এবছর ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ৪৫ কোটি টাকা বাজেট ঘোষণা করেছে ডিএসসিসি। সিটি করপোরেশন বলছে, বিশেষ অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে এবার মশক নিধন এবং বিশেষজ্ঞ টিমের নির্দেশনায় মশার ঔষধ কেনা হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চার বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২১ সালের জুলাইয়ে ডেঙ্গু রোগী বাড়া শুরু করে, আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে বেড়ে অক্টোবরে কমতে শুরু করে। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে রোগী বাড়তে শুরু করেছিল, অক্টোবর ছিল পিক সিজন। নভেম্বরে কমতে থাকে। ২০২৩ সালের জুলাই থেকে বাড়তে শুরু করেছিল। আগস্ট-সেপ্টেম্বরে বেড়ে অক্টোবরে গিয়ে রোগী কমতে শুরু করে। সেবার পিক সিজন ছিল আগস্ট-সেপ্টেম্বর। ২০২৪ সালের আগস্টে রোগী একইভাবে বাড়তে শুরু করে, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর পর্যন্ত বেড়ে নভেম্বরে আবার কমতে থাকে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে জানা গেছে, ২০২৪ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন। মারা গেছেন ৫৭৫ জন। ২০২৩ সালে আক্রান্ত হন ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন। মৃত্যু হয় ১ হাজার ৭০৫ জনের। ২০২২ সালে ৬২ হাজার ৩৮২ জন আক্রান্ত হন। মৃত্যু হয় ২৮১ জনের। ২০২১ সালে আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন। মৃত্যু হয় ১০৫ জনের। ২০২০ সালে করোনার কারণে ডেঙ্গুর দিকে নজর ছিল না। ২০১৯ সালের ১ লাখ ১ হাজার ৩৭৪ জন আক্রান্তের মধ্যে ১৬৪ জনের মৃত্যু হয়।