কেউ ছেলেকে খুঁজছেন। কেউবা মেয়েকে খুঁজছেন। সন্তান হারিয়ে কিংবা সন্তানের পুড়ে যাওয়া মুখ দেখে ভেঙে পড়ছেন স্বজনেরা। শোকে বিহবল রাজধানীর জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউট। গতকাল সোমবার বিকেলে হাসপাতালটিতে গিয়ে এমন চিত্র দেখা যায়।

মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজে বিমান দুর্ঘটনায় আরিয়ান আশরাফ নাফিসের শরীরের ৯৫ শতাংশ দ্বগ্ধ হয়েছে। আইসিইউর সামনে নাফিসের মা তাহমিনা বলেন, একই স্কুলে আমার ছেলে-মেয়ে লেখাপড়া করে। ছেলে নাফিস দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। মেয়ে তাহিয়া আশরাফ নাজিয়া পড়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে। আমার ছেলে এক বিল্ডিং থেকে আরেক বিল্ডিংয়ে গিয়ে বোনকে আনতে গিয়েছিল। কিন্তু তার বোনকে আর খুঁজে পাচ্ছি না বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তাহমিনা। নাজিয়ার মা বলেন, কয়েকটি হাসপাতালে খোঁজা হয়েছে, কিন্তু পাইনি। এখানে ছেলে ভর্তি। ৯০ শতাংশের বেশি পুড়ে গেছে।

জিজ্ঞেস করা হলে কেউ কেউ বলেছে, এখানে আনা হয়েছে। কিন্তু খুজে পাচ্ছি না। নাজিয়ার মামা সুইট তার ভাগ্নির সন্ধান চেয়েছেন। সন্তানকে খুঁজে পেতে গণমাধ্যমের সহযোগিতাও চেয়েছেন তিনি। একই অবস্থা অন্যান্য স্বজনদেরও। কারো চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছে, কেউ কাটিয়ে উঠতে পারছেন না সন্তান হারানোর শোক। কথা বলার ভাষাও হারিয়েছেন অনেকেই। সন্তান কিংবা আত্মীয় স্বজনদের জন্যে দোয়া প্রার্থনা করছেন সবাই।

‘আল্লাহ আমার সন্তানরে ফিরাইয়া দেও’ : রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনে বিমান বাহিনীর উড়োজাহাজ বিধ্বস্তের ঘটনায় দগ্ধ শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশের চিকিৎসা চলছে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। সেখানকার জরুরি বিভাগে চিকিৎসা চলছে ১১ বছর বয়সী চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী মাহিদ হাসান আরিয়ান, সপ্তম শ্রেণি পড়ুয়া শায়ান, তৃতীয় শ্রেণি পড়ুয়া জুনায়েদ হাসানসহ আরো বহু শিক্ষার্থীর। জরুরি বিভাগের বাইরে অপেক্ষায় আছেন এসব শিক্ষার্থীর অভিভাবকরা। যাদের আহাজারিতে ভারি ওঠে সেখানকার পরিবেশ।

বার্ন ইউনিটের সামনে এক মা চিৎকার করে বলছেন ‘ আল্লাহ আমার সন্তানকে ফিরিয়ে দাও’। সারা শরীর পুড়ে যাওয়া ১১ বছর বয়সী আরিয়ানের যখন জরুরি বিভাগের ভেতরে চিকিৎসা চলছিল, বাইরে বসে তার মা মনিকা আক্তার আঁখি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “আল্লাহ আমার সন্তানরে আমার কাছে ফিরাইয়া দেও। সকাল পৌনে আটটায় স্কুলে গেছে। দেড়টায় ছুটি হওয়ার কথা ছিল, এরপর দেড়টা থেকে সাড়ে তিনটা পর্যন্ত কোচিং। সকালে ছেলেরে খাবার দিয়া দিছি, এরমধ্যে এই ঘটনা ঘটল। স্কুলের কাছেই তাদের বাসা, দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ছেলের খোঁজে স্কুলে ছুটে যান বলে জানিয়েছেন আঁখি; এরপর গিয়ে ওই মা ছেলেকে দগ্ধ অবস্থায় পান। সেখান থেকে তাকে প্রথমে বাংলাদেশ মেডিকেলে নেওয়া হয়। ওই হাসপাতাল থেকে আরিয়ানকে বার্ন ইনস্টিটিউটে পাঠিয়ে দেয় উন্নত চিকিৎসার জন্য। সপ্তম শ্রেণির শায়ানের শরীরের বেশিরভাগ অংশ পুড়ে গিয়েছে বলে জানিয়েছেন তার ফুপু রুবিনা আক্তার।

উত্তরা ১০ নম্বর সেক্টরের এই বাসিন্দা বলেন, সকাল বেলা সুস্থ ছেলেটা বাসা থেকে বের হইল, আর এখন হাসপাতালে। তৃতীয় শ্রেণি পড়ুয়া জুনায়েদ হাসানের মা ঝর্না আক্তারও জরুরি বিভাগের সামনে কাঁদছিলেন। নয়া নগরের এই বাসিন্দা জানিয়েছেন, তার ছেলেকে আইসিউতে নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আর একটু পরেই ছুটি হইলে ছেলে বাসায় চলে যেত। আর এখন ছেলে আমার আইসিইউতে।

কেউ খুঁজছেন সন্তান ॥ কারও অভিভাবককে খুঁজছেন স্বেচ্ছাসেবকরা : জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে কেউ খুঁজছেন সন্তান-স্বজন। কারও প্রয়োজন অভিভাবক। রক্ত দেওয়ার জন্য ছুটে এসেছেন অনেকেই। কিছুক্ষণ পর পর সাইরেন বাজিয়ে ঢুকছে অ্যাম্বুলেন্স। তখন প্রতিটি মানুষ হয়ে উঠছেন স্বেচ্ছাসেবক। একটা প্রাণ বাঁচানোর সে কী আকুতি! গতকাল সোমবার বিকেলে ভারী হয়ে উঠেছে রাজধানীর চাঁনখারপুলের আকাশ। বার্ন ইনস্টিটিউট ঘিরে মানুষের অস্বাভাবিক দৌড়ঝাঁপ। সবার চোখে মুখে শোকের ছায়া।

এরই মধ্যে একটু পর পর সাইরেন বাজিয়ে আসছে অ্যাম্বুলেন্স। রাস্তা ক্লিয়ার করতে সবাই কাজ করছেন। ইমারজেন্সি ওয়ার্ডে নেওয়া, সেখান থেকে বেডে দেওয়ার পুরো প্রক্রিয়ায় স্বতঃস্ফূর্ত সহায়তা করছে স্বেচ্ছাসেবক টিম। মাঝেমধ্যে মাইকে প্রয়োজনীয় ঘোষণা আসছে। একবার বলা হলো, ‘আরিয়ান নাফিজ আইসিইউতে ভর্তি। তার অভিভাবক প্রয়োজন।’ পরক্ষণেই আবার রক্ত দিতে ডোনারদের অনুরোধ জানানো হচ্ছে। অন্যদিকে দেখা গেল মেয়ের খোঁজে আব্দুল কাদের তার ভাইসহ এসেছেন জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে। তার মেয়ে আফিয়া তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। তার খোঁজ পাচ্ছেন না। তৃতীয় শ্রেণির সায়মা, পড়তো বাংলা ভার্সনে। তার খোঁজে এসেছেন তার বাবার এক সহকর্মী।

মানবিকতার এক নজিরও দেখা গেলো জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে। সিরিয়াল পড়ে গেছে রক্তদানের লাইনে। স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন পেশার মানুষ এসেছেন স্বেচ্ছায় রক্ত দিতে। এরই মধ্যে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট পরিদর্শন করেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান, আদিলুর রহমান খান, আসিফ নজরুল, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক সায়েদুর রহমান ও প্রেস সচিব শফিকুল আলম। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান, সেক্রেটারি জেনারেল সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া মো. গোলাম পরওয়ার, গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি, ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয় শাখা শিবির সভাপতি এস এম ফরহাদসহ রাজনৈতিক নেতারাও এসেছেন খোঁজ নিতে। এরই মধ্যে এ দুর্ঘটনায় ১৯ জন নিহতের তথ্য দিয়েছে আইএসপিআর ও ফায়ার সার্ভিস। তবে আহতদের সংখ্যা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

মেয়ে বলে-মা আমার পুরো শরীর জ্বলে : জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের ৫২০ নম্বর কক্ষের মেঝেতে মেয়েকে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছিলেন ইয়াসমিন আক্তার। তার ১১ বছর বয়সী পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ে নুরে জান্নাত ইউশা বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় পুড়ে গেছে।

ইয়াসমিন আক্তার বলেন, আমার মেয়ের কপাল পুড়ে গেছে, মুখ ঝলসে গেছে, মাথা ফেটে গেছে, পিঠও পুড়ে গেছে। আমার মেয়ে আমার সঙ্গে কথা বলেছে। মেয়ে বলে যে মা, আমার পুরো শরীর জ্বলে। এই মা জানান, তার দুই ছেলে-মেয়ে। মেয়ে মাইলস্টোনে পড়ে।

এদিকে ৫২০ নম্বর কক্ষের সামনে বিলাপ করতে থাকা নাসিমা বেগমকে সান্ত¡না দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন আত্মীয়-স্বজনেরা। তার ছেলে রবিউল হাসান রোহান সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী। বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় রবিউলের শরীর পুড়ে গেছে। নাসিমা বেগম বলছিলেন, এমন দশা ক্যামনে হইছে রে। কত মায়ের বুক খালি হইছে রে। আমার রোহান যন্ত্রণায় কাতরাইতাছে রে। রোহানের বাবা মো. নিজাম উদ্দিন বলেন, তার ছেলের পুরো শরীর পুড়ে গেছে। তার ছেলে ইংরেজি মাধ্যমে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে।

রাজধানীর উত্তরায় বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় বেলা সাড়ে তিনটা পর্যন্ত ২৮ জন জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগই শিক্ষার্থী। এখন পর্যন্ত দুজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, সোমবার বেলা ১টা ৬ মিনিটে বিমানটি উড্ডয়ন করে। পরে বিধ্বস্ত হয়।