২০১৪ সালের ১৩ জুন দিবাগত রাতটি ছিল পবিত্র শবে বরাতের রাত। রাজধানীর পল্লবীর কালশীতে নিউ কুর্মিটোলা বিহারী ক্যাম্পে চলছে মহিমান্বিত ওই রাতটি উদযাপনের যাবতীয় আয়োজন। এ সময় আতশবাজী পোড়ানো নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে ঝগড়া বাধে। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ আসে। এরপর এই ঝগড়া নিয়ে গভীর রাত থেকে পরদিন ১৪ জুন দুপুর পর্যন্ত বিহারী ক্যাম্পের দুই পক্ষের বাসিন্দা আটকে পড়া পাকিস্তানিদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ বাধে। ত্রিমুখী সংঘর্ষের একপর্যায়ে পাশের বাউনিয়া বাঁধের বাসিন্দা ও পল্লবী থানা যুবলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক জুয়েল রানার সমর্থকেরা পুলিশের সঙ্গে যোগ দেয়। ১৪ জুন সকালে জুয়েল রানা ও তাঁর সমর্থকেরা ক্যাম্পের আটটি ঘরে বাইরে থেকে অগ্নিসংযোগ করেন। জুয়েল ঢাকা-১৬ আসনের তৎকালীন আওয়ামীলীগ এমপি ইলিয়াস উদ্দীন মোল্লাহর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। সংঘর্ষের সময় পুলিশের গুলীতে নিহত হয় একজন। অন্যদিকে আগুনে পুড়ে মারা যান ক্যাম্পের ইয়াসিনের পরিবারের ৯ জন। এছাড়া এ ঘটনায় গুলীবিদ্ধ হয়ে নিহত হন শ্রমিক আজাদ। সবমিলে এ ঘটনায় নিহত হন ১০ জন বিহারী। এ ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ইয়াসিন বাদী হয়ে পল্লবী থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলার বছর দুয়েক পর পল্লবীতে এক রহস্যজনক সড়ক দুর্ঘটনায় ইয়াসিন নিহত হন। কালশীর এই মর্মান্তিক ঘটনার ১১ বছর পূর্তি হচ্ছে আজ শনিবার। দিনটি পালনে স্থানীয় একাধিক সংগঠনের পক্ষ থেকে দিনব্যাপী নানা কর্মসুচী গ্রহণ করা হয়েছে।

স্থানীয় একাধিক সুত্রে জানা গেছে, কালশী ট্রাজেডির ঘটনায় পল্লবী থানায় মোট ছয়টি মামলা হয়। মামলাগুলো শুরুতে পল্লøবী থানা পুলিশ তদন্ত করে। পরে ডিবি, সিআইডি ও পিবিআই মামলার তদন্ত করে। জানা গেছে, এর মধ্যে হত্যা মামলা তদন্ত করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

অন্য আরেকটি মামলায় বিহারি ক্যাম্পের বাসিন্দা. মো. বদরুল, সাব্বির, আজাদ, আরজু, আরিফ ও জুয়েলকে এজাহারভুক্ত করে অজ্ঞাত পরিচয় প্রায় ৩ হাজার জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা করে। মামলাটি এখন অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) তদন্ত করছে ।

কালশী ট্রাজেডির ১১ বছর পূর্তি হলেও দায়ের হওয়া মামলাগুলোর কোন ক’ল কিনারা হয়নি আজও। পুলিশ বাদী হয়ে যে কয়টি মামলা করেছে, তার প্রতিটিতেই আসামী হয়েছেন ক্যাম্পের বাসিন্দারা। তাদের অভিযোগ, বিহারীদের মুখ বন্ধ করতেই তাদেরকে মামলায় আসামী করা হয়েছে। তারা হয়রানীর শিকার।

জানতে চাইলে বাংলাদেশী বিহারী পুনর্বাসন সংসদ (বিবিআরএ) এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক নেয়াজ আহমেদ খান দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, আতশবাজি নিয়ে দুপক্ষের ঝগড়া-বিবাদ সামলাতে ব্যর্থ হয়ে ও পক্ষপাতমূলক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে পুলিশ ঘুমন্ত বিহারিদের উপরে নির্বিচারে গুলী চালিয়েছে। এই ঘটনায় ১২ জন মারা যাওয়ার অভিযোগ করে তিনি বলেন, আক্রমণকারী ও অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের গ্রেফতার না করে উল্টো নিরীহ বিহারীদের মামলার আসামী করেছে পুলিশ। আজও একাধিক মামলা চলছে। তদন্ত শেষ করতে পারেনি পুলিশ। নিরীহ বিহাবীরা আদালতে বছরের পর বছর হাজিরা দিচ্ছেন। তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ ও প্রকৃত খুনিদের গ্রেফতারের দাবিতে বিহারী নেতৃবৃন্দ একের পর এক কর্মসূচি গ্রহণ করলেও পলাতক আওয়ামী লীগ সরকার কোন কর্ণপাত করেনি। কালশি গণহত্যার খুনিদের শাস্তির দাবিতে আজ শনিবার বাংলাদেশী বিহারী পুনর্বাসন সংসদ (বিবিআরএ) বিক্ষোভ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। তারা দলীয় কার্যালয়ে কোরআনখানি ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করেছে।

জানতে চাইলে উর্দু স্পিকিং ইয়ুথ পিপলস রিহ্যাবিলিটেশন মুভমেন্টের দপ্তর সম্পাদক ইমরান খান বলেন, বিহারি ক্যাম্পের জায়গা দখল করতেই ঐ হামলা চালানো হয়। আগুনে পুড়ে ও গুলীতে মারা গেছে বিহারিরা, অথচ মামলায় আসামী করা হয়েছে বিহারিদেরই।

উর্দু স্পিকিং পিপলস ইয়ুথ রিহ্যাবিলিটিশন মুভমেন্টের (ইউএসপিওয়াইআরএম) সাধারণ সম্পাদক মইন উদ্দিন মুন্না বলেন, ‘পরিকল্পিতভাবে ক্যাম্পে আগুন দিয়ে নিরাপরাধ বিহারিদের পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। ঘটনার নেপথ্যে অনেক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে আইনগত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।’

তবে ঘটনার ওই সময় পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে দুই ধরনের বক্তব্য পাওয়া গিয়েছিল। পুলিশ বলেছিল, বিহারিদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে আগুনের ঘটনা ঘটে। অন্যদিকে প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছিল, আতশবাজি পোড়ানো নিয়ে স্থানীয় বাঙালিদের সঙ্গে বিহারিদের সংঘর্ষ বাধে। এছাড়া বিদ্যুৎ সংযোগ নিয়েও এলাকায় দুই পক্ষের মধ্যে আগে থেকে বিরোধ ছিল।

সিআইডির মামলা তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ত্রিমুখী সংঘর্ষে গুলীবিদ্ধ হয়ে একজনের মৃত্যু, এক যুবককে গলা কেটে হত্যার চেষ্টা, গাড়ি ভাঙচুর, লুটপাট, মারধর, চুরি, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও শ্লীলতাহানির চেষ্টার অভিযোগে চারটি মামলা করেন বিহারি ক্যাম্পের বাসিন্দারা। এসব মামলায় ৩২ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত পরিচয় আরো অন্তত ৩ হাজার ২২০ জনকে আসামী করা হয়। এরমধ্যে পাঁচ মামলার এজাহারে বর্ণিত আসামী ও তদন্তে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ মিলেছে, তাদের বিরুদ্ধে দেওয়া হয়েছে অভিযোগপত্র। তবে এ ঘটনায় আলোচনার কেন্দ্রে থাকা ইয়াসিনের দায়ের করা হত্যা মামলাটির তদন্তে গতি আসেনি।

এদিকে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআই এর এক তদন্তের পর এক মামলায় দেয়া হয়েছে চূড়ান্ত প্রতিবেদন। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের শেষ দিকে দেয়া ওই প্রতিবেদনে কুর্মিটোলা বিহারি ক্যাম্পে একই পরিবারের নয়জনকে পুড়িয়ে হত্যা ও অপর একজন গুলীতে নিহত হওয়ার ঘটনায় জড়িত কাউকে শনাক্ত করা যায়নি। পুলিশের দেওয়া চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঘটনাস্থল থেকে সংগ্রহ করা ভিডিওর সিডি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে গেছে। এ ছাড়া ঘটনাস্থলের বেশ দূরে এক পক্ষের সঙ্গে অপর পক্ষের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার অস্পষ্ট ভিডিও পর্যবেক্ষণ করেও জড়িত কাউকে শনাক্ত করা যায়নি। ঢাকা চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে প্রতিবেদনটি জমা দেয় পিবিআই। তদন্তকারী কর্মকর্তা ও পিবিআইয়ের পরিদর্শক কবির হোসেন প্রতিবেদনটি দাখিল করেন।

পরিকল্পিতভাবে ইলিয়াস মোল্লা এ ঘটনা ঘটিয়েছেন : কালশীর কুর্মিটোলা বিহারি ক্যাম্পের ঘটনাটি ঘটার পর থেকেই স্থানীয়রা জোরেসোরেই অভিযোগ করে আসছেন, স্থানীয় সংসদ সদস্য ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লা এ ঘটনার জন্মদাতা। তারা দাবি করেন, ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লা দীর্ঘদিন ধরেই এ ক্যাম্পটি দখলের পায়তারা করে আসছিলেন। কিন্তু বিহারিরা ক্যাম্প না ছাড়ায় তিনি পরিকল্পিতভাবে এ ঘটনা ঘটিয়েছেন।

ক্যাম্পের বিহারিদের অভিযোগ, পরিকল্পিতভাবেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লা। এই ক্যাম্পটি মিরপুরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে হওয়ায় তার নজর ছিল এ জায়গার ওপর। বিভিন্ন সময় তিনি এখানকার নেতাদের অন্যত্র স্থানান্তরিত করার বিষয়ে প্রস্তাবও দিয়েছেন। কিন্তু বিহারিরা ক্যাম্প ছাড়তে রাজি হননি।

ওয়েলফেয়ার মিশন অব বিহারিদের সভাপতি মোস্তাক আহমেদ বলেন, ‘এখানে অনেক স্বার্থগত বিষয় জড়িত। আতশবাজি তো ইস্যু। এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লা এখানে এ ঘটনা ঘটিয়েছেন। নির্মম এ ঘটনার পেছনে তার পূর্ব ক্ষোভ রয়েছে।’

পূর্ব ক্ষোভের বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের এই ক্যাম্পের দিকে ইলিয়াস উদ্দিনের নজর ছিল। কিন্তু ক্যাম্প ছেড়ে দেওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। তাই তিনি পরিকল্পিতভাবে এ ঘটনা ঘটিয়েছেন।’

ক্যাম্পের সুমন মিয়া বলেন, ‘কুর্মিটোলা ক্যাম্প ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লা দখল করার চেষ্টা করছেন। এ নিয়ে ডেভেলপারদের সঙ্গেও তিনি কথা বলে রেখেছেন। ঘটনার কয়েকদিন আগে তিনি আমাদের স্থানান্তরিত হওয়ার প্রস্তাব দেন। এমনকি তিনি আমাদের আরও ভালো স্থান দিবেন বলেও আশ্বাস দেন। কিন্তু আমরা তাতে রাজি হইনি। এ জন্য তিনি আমাদের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন।’

ওই সময়কার পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে স্থানীয়রা বলেন, ‘আমরা একটি ঘরের ছাদ থেকে দেখেছি, ঘরে আগুন জ্বলছে। কিন্তু ঘরের আশপাশে কেউ যেতে পারছি না। আর ভেতরে তারা আটকা পড়া অবস্থায় চিৎকার করছিল। পরে যখন পরিস্থিতি শান্ত হয় ততক্ষণে সব শেষ। আমাদের চোখের সামনে এমন ঘটনা ঘটলো কিছুই করতে পারিনি।’ ইলিয়াস আলী মোল্লার সঙ্গে কথা বলার জন্য তাকে ফোন করা হলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। এমনকি তিনি স্থানীয় সংসদ সদস্য হলেও এ ঘটনার পর ঘটনাস্থলে যাননি বলে তাদের অভিযোগ।