* শেখ হাসিনা হুকুমের আসামী হতে পারেন
* ১৫০ নেতার তালিকা পুলিশের কাছে
* থানায় দুই মামলা, কার্ফিউর সময় বেড়েছে
* আরো একজনের মৃত্যু, গ্রেফতার ১৬৪
গোপালগঞ্জে হামলা সংঘর্ষ, অগ্নি সংযোগ এবং হত্যাকান্ডের ঘটনায় জড়িত নিষিদ্ধ সংগঠন আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগহসহ অঙ্গ সংগঠনের ১৫০ জন নেতা-কর্মীর তালিকা করেছে পুলিশ। এর মধ্যে সাবেক এমপি, কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতা ও স্থানীয় জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের নাম রয়েছে। এনসিপির পদযাত্রাকে কেন্দ্র করে তান্ডব চালিয়ে নেতাদেরকে হত্যা, সমাবেশ পন্ড করা এবং রণক্ষেত্র তৈরিতে তারা বিভিন্ন ভাবে জড়িত ছিল বলে গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য রয়েছে। হামলায় নির্দেশ দাতা হিসেবে শেখ হাসিনার অডিও বার্তা যাচাই করা হচ্ছে। ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সাদ্দামসহ পলাতক কয়েকজন নেতার মদত দেয়ার তথ্য রয়েছে গোয়েন্দাদের কাছে। আর হামলা-সংঘর্ষের ঘটনায় গোয়েন্দা ব্যর্থতার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছে সরকার। এতবড় ঘটনা ঘটেছে অথচ কোনো গোয়েন্দা সংস্থা সরকারকে আগাম তথ্য না দেয়া স্যাবোটাজ কিনা সেবিষয়টিও তা ক্ষতিয়ে দেখা হচ্ছে।
এদিকে স্থানীয় প্রশাসনের জারি করা কারফিউর মেয়াদ আবার বাড়ানো হয়েছে। গতকাল শুক্রবার বিকেল সাড়ে চারটার দিকে গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ কামরুজ্জামান এ তথ্য জানিয়ে বলেন, গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা ছয়টা থেকে নতুন করে শুরু হওয়া কারফিউ আজ শনিবার সকাল ছয়টা পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আলোচনা করে কারফিউর বিষয়ে পরবর্তী সময়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। হামলা ভাংচুরের ঘটনায় গতকাল পর্যন্ত পৃথক দু‘টি মামলা হয়েছে। এছাড়া গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে। এই নিয়ে হামলা-ষংঘর্ষের ঘটনায় পাঁচ জনের মৃত্যু হলো।
পুলিশ জানিয়েছে, গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জুলাই পদযাত্রা ঘিরে পুলিশের ওপর হামলা, গাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের জেলা সভাপতি নিউটন মোল্লা ও সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমানসহ ৭৫ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করা হয়েছে। মামলায় অজ্ঞাতনামা ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে আসামী করা হয়েছে। গোপালগঞ্জ গোপীনাথপুর পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক আহমদ বিশ্বাস বাদী হয়ে মামলাটি করেন। সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মীর মোহাম্মদ সাজেদুর রহমান গতকাল শুক্রবার বেলা তিনটার দিকে মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। এদিকে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ১৬৪ জনকে আটক করেছে যৌথ বাহিনী। তাদের মধ্যে কতজনকে এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে, তা জানাননি ওসি। ওসি সাজেদুর রহমান বলেন, সদর উপজেলার উলপুর ইউনিয়নের খাটিয়াগড় চরপাড়া এলাকায় পুলিশের ওপর হামলা করে গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় গোপীনাথপুর পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক আহমদ বিশ্বাস বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। মামলায় নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের জেলা শাখার সভাপতি নিউটন মোল্লা, সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমানসহ ৭৫ জনের নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাতনামা আরও ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে আসামী করা হয়েছে। সদর থানার পরিদর্শক তদন্ত আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, গত বুধবার রাতে যৌথ বাহিনী ১৪ জনকে আটক করে সদর থানায় হস্তান্তর করে। তাদের বুধবার বিকেলে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। ওই ১৪ জনসহ আজ সকাল পর্যন্ত ৪৫ জনকে আটক করেছে যৌথ বাহিনী। গোপালগঞ্জ আদালত পুলিশের পরিদর্শক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, বৃহস্পতিবার ১৬ আসামীকে আদালতে হাজির করা হয়। এর মধ্যে ১২ জনকে ৫৪ ধারায় আদালতে নেওয়া হয়। আদালত তাঁদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
জানা গেছে, মার্চ টু গোপালগঞ্জ কর্মসূচি পণ্ড করতে বুধবার বিভিন্ন স্থান থেকে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। আওয়ামী লীগের টার্গেট ছিল এনসিপিকে ঢুকতে দেওয়া হলেও তাদের জীবিত বের হতে দেওয়া হবে না। বিশেষ করে শীর্ষ নেতাদের হত্যা করা। এ মিশন সফল করতে স্বয়ং গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত থেকে মোবাইল ফোনে গোপালগঞ্জে একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলেন। এনসিপির বিরুদ্ধে জনগণকে উসকে দিতে বেশকিছু অডিও বার্তাও পাঠান। এর সঙ্গে ভারতে পলাতক নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেনও এই ঘটনার সাথে সরাসরি জড়িত বলে জানা গেছে। ফেসবুক লাইভে এসে তিনি সরাসরি হামলা চালানোর নির্দেশনা দেন। একটি অডিও বার্তায় শোনা যায়, শেখ হাসিনা নিষিদ্ধ ঘোষিত গোপালগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান পিয়ালকে বলেন, ‘ওরা (এনসিপি) নাকি গোপালগঞ্জে যাচ্ছে। টুঙ্গিপাড়ায় আমার বাবার কবর ভেঙে ফেলার ঘোষণা দিয়েছে। এর আগে ৩২ নম্বরের বাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়েছে। এবার টুঙ্গিপাড়ায় হামলা চালাবে। তোমরা বসে আছ কেন? যে যেভাবে পার প্রতিহত কর। গোপালগঞ্জে কোনোভাবেই যাতে ওরা ঢুকতে না পারে। কোনো ধরনের কর্মসূচি যাতে করতে না পারে। মনে রাখবা, গোপালগঞ্জের মাটি থেকে ওদের কেউ যাতে অক্ষত অবস্থায় ফিরে যেতে না পারে।’
আরেকটি অডিও বার্তায় শেখ হাসিনা নিষিদ্ধ ঘোষিত গোপালগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও শহরের বেদ গ্রামের বাসিন্দা নিউটন মোল্লাকে বলেন, ‘তোমরা ওখানে (গোপালগঞ্জে) বসে কী কর। ওরা (এনসিপি) বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন জড়ো করার চেষ্টা করছে। পিরোজপুর, বাগেরহাট, খুলনা ও ফরিদপুরসহ আশপাশের জেলা-উপজেলা থেকে লোকজন একত্রিত করে গোপালগঞ্জে ঢুকবে। এরপর টুঙ্গিপাড়ায় যাবে। যেভাবে পার ওদের প্রতিহত করতে হবে। টুঙ্গিপাড়ায় যাতে কোনোভাবেই ওরা ঢুকতে না পারে। আর যদি টুঙ্গিপাড়ায় ঢুকেই পড়ে, তাহলে একজনও যাতে জীবিত অবস্থায় ওখান থেকে ফিরে যেতে না পারে, সে ব্যবস্থা নিতে হবে।’ কেবল নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগই নয়, শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগসহ দলের বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে একাধিকবার টেলিফোনে কথা বলেন। গোপালগঞ্জের মাটিতে এনসিপি যাতে কোনোভাবেই তাদের কর্মসূচি পালন করতে না পারে, সেজন্য প্রত্যেককে তিনি নির্দেশনা দেন। শেখ হাসিনার নির্দেশের পর এনসিপির কর্মসূচি পণ্ড করাসহ দলটির শীর্ষ নেতাদের হত্যা করতে গোপালগঞ্জে থাকা দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা চতুর্দিক থেকে একযোগে হামলা চালান। পুলিশ প্রতিবেদনেও উল্লেখ করা হয়েছে, ঘটনারদিন বেলা ১১টায় গোপালগঞ্জ সদর থানার কংশুর বাসস্ট্যান্ডে গোপালগঞ্জ-টেকেরহাট সড়কে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের গোপালগঞ্জ পৌর শাখার যুগ্ম-আহ্বায়ক মো. ওমর ফারুক খান রিপনের নেতৃত্বে ৪০ থেকে ৫০ জন আওয়ামী লীগ সমর্থক সড়কে গাছ ফেলে এবং কাঠ দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এসময় গোপালগঞ্জ ইএনওর গাড়ি ওই স্থানে গেলে গাড়ি ভাঙচুর করে সড়ক অবরোধ করে রাখে। বেলা সাড়ে ১১টায় কোটালীপাড়া থানার অবদার হাট এলাকায় কোটালীপাড়া উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম দারিয়ার নেতৃত্বে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মিছিল করে কোটালীপাড়া-পয়সারহাট সড়কে গাছ ফেলে ব্যারিকেড দিয়ে ২ হাজার ৮০০ জন থেকে ৩ হাজার নেতাকর্মী রাস্তা অবরোধ করে রাখে। বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে সদর থানার কাঠিবাজার এলাকায় গোপালগঞ্জ-কোটালীপাড়া সড়কে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের গোপালগঞ্জ পৌরসভার মামুনের নেতৃত্বে ২০০ থেকে ৩০০ জন আওয়ামী লীগ সমর্থক দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সড়কে গাছ ফেলে ব্যারিকেড দিয়ে অবরোধ করে।
নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৫ : হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনায় আরেকজন মারা গেছেন। গত বুধবার আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের হামলা চলাকালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে হামলাকারীদের সংঘর্ষ হয়। এ সময় গুলিবিদ্ধ রমজান মুন্সী (৩২) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত দুইটার দিকে মারা গেছেন। গোপালগঞ্জে সহিংসতার ঘটনায় এ নিয়ে পাঁচজন মারা গেলেন। এর আগে এ ঘটনায় নিহত হন-গোপালগঞ্জ শহরের উদয়ন রোডের বাসিন্দা সন্তোষ সাহার ছেলে দীপ্ত সাহা (২৫), কোটালীপাড়ার রমজান কাজী (১৮), টুঙ্গিপাড়ার সোহেল মোল্লা (৪১) ও সদর উপজেলার ভেড়ার বাজার এলাকার ইমন (২৪)। এ ঘটনায় গুলিবিদ্ধ আরও দুজন ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তারা হলেন, সুমন বিশ্বাস (৩০) ও আব্বাস আলী (৩০)। পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে রমজান আলী মুন্সীর বাড়ি গোপালগঞ্জ সদর থানাপাড়ায়। তিনি মৃত আকবর মুন্সীর ছেলে। রমজান আলী রিকশাচালক ছিলেন। আহত অবস্থায় রমজান মুন্সীকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসেন তার ভাই হীরা মুন্সী। তিনি বলেন, তার ভাই রিকশাচালক। ঘটনার দিন গত বুধবার দুপুরে গোপালগঞ্জ সদর এলাকায় সিনেমা হলের পাশেই রিকশা থেকে যাত্রী নামিয়ে ফেরার পথে তিনি সহিংসতার মধ্যে পড়েন এবং গুলিবিদ্ধ হন। তাকে প্রথমে স্থানীয় একটি হাসপাতালে এবং পরে অবস্থার অবনতি হলে ওই দিনই দিবাগত রাত ২ টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুলিশ ক্যাম্পের উপপরিদর্শক (এসআই) মাসুদ আলম বলেন, রমজান মুন্সীর লাশ ঢাকা মেডিকেলের মর্গে রাখা হয়েছে। গত বুধবার দিনভর দফায় দফায় গোপালগঞ্জে হামলা, ভাঙচুর, সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে অন্তত নয়জন গুলিবিদ্ধসহ কয়েকশ ব্যক্তি আহত হন।