নরসিংদীতে চাঁদা তুলতে বাধা, এএসপির ওপর হামলা

কিশোরগঞ্জে মহাসড়কে গাড়ি থামিয়ে দুর্ধর্ষ ডাকাতি

ঢাকায় চাঁদা না পেয়ে বাসে আগুন : ২ জন গ্রেফতার

দেশের সড়ক-মহাসড়কে ডাকাত ও চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক তৎপরতার মধ্যেও সড়কে থেমে নেই অপরাধীরা। এর মাঝেও সড়কে আতঙ্ক সৃষ্টি করে ডাকাতি-চাঁদাবাজি করছে অপরাধীচক্র। বিশেষ করে রাতে মহাড়কে দূরপাল্লার বাসের যাত্রীরা ডাকাত আতঙ্কে থাকেন। অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে বাস থামিয়ে যাত্রীদের সর্বস্ব কেড়ে নেয়ার ঘটনা ঘটছে। হাইওয়ে পুলিশ ও স্থানীয় থানা দীর্ঘ সড়ক পথের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন অধিকাংশ সময়।

৫ লাখ টাকা চাঁদার দাবিতে গত শুক্রবার সকালে রাজধানীর মিরপুরে আলিফ পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাসে গুলি ও অগ্নিসংযোগ করে দুর্বৃত্তরা। আগুনে বাসটি পুরোপুরি ভস্মীভূত হয়ে যায়। তবে কেউ হতাহত হয়নি। এর আগে গত ৩ সেপ্টেম্বর মিরপুর সেনপাড়া পর্বতা এলাকায় ৫ লাখ টাকা চাঁদার দাবিতে এই বাসের চেকারের গলায়, ঘাড়ে ও হাতে ছুরিকাঘাত করে সন্ত্রাসী নেছার উদ্দিন ও তার ৫/৬ জন সহযোগী। ওই ঘটনায় কাফরুল থানায় নেছার উদ্দিনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ৫/৬ জন সহযোগীকে আসামী করে মামলা করেন আলিফ পরিবহন কোম্পানির চেয়ারম্যান রিয়াজুল ইসলাম। এদিকে আলিফ পরিবহনের একটি বাসে আগুন দেওয়ার আগুনের ঘটনার হোতা নেছার ও তার সহযোগী দীপুকে গ্রেফতার করেছে যৌথবাহিনী। মিরপুর আর্মি ক্যাম্প সূত্রে জানা যায়, আগুনের ঘটনার পর গোয়েন্দা নজরদারি শুরু হয়। ঘটনাস্থলের সিসি ক্যামেরা বিশ্লেষণ করে ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করা হয়। পরে শুক্রবার রাতে রাজধানীর মিরপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয়।

গতকাল শনিবার দুপুরে নরসিংদীর পৌর শহরের আরশিনগর এলাকায় সড়কে চাঁদাবাজির প্রতিবাদ করায় অতিরিক্ত সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) শামিম আনোয়ারের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে তিনি গুরুতর আহত হন। তাকে উদ্ধার করে ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে পাঠানো হয়। আহত এএসপি শামিম আনোয়ার জানান, সকালে তিনি নরসিংদী পৌর শহরে নিয়মিত টহল দিচ্ছিলেন। আরশিনগর এলাকা অতিক্রম করার সময় তিনি দুজনকে যানবাহন থেকে টাকা তুলতে দেখেন। তিনি তাদের কাছে টাকা তোলার কারণ জানতে চান এবং হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি উল্লেখ করেন। এই সময় হঠাৎ করে ৩০ থেকে ৩৫ জন লোক অতর্কিতভাবে তার ওপর হামলা চালায়। এএসপি শামিম আনোয়ার বলেন, তারা আমাকে কিল-ঘুষি মারা শুরু করে। পরে আমাকে লাঠি দিয়ে মাথায় আঘাত করে। আমি সঙ্গে সঙ্গে অচেতন হয়ে যাই। পরে সঙ্গে থাকা পুলিশ সদস্যরা তাকে উদ্ধার করে সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে পাঠানো হয়। কয়েক দিন আগে নরসিংদীর সড়কে চাঁদাবাজি বন্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছিলেন শামিম আনোয়ার। এরপর থেকেই তিনি বিভিন্ন প্রতিকূলতার শিকার হচ্ছিলেন। এমনকি তিনি ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্টে স্ট্যাটাস দিয়ে যেকোনো সময় তার ওপর হামলার আশঙ্কার কথা জানিয়েছিলেন।

অন্যদিকে সিরাজগঞ্জের কড্ডার মোড়ে মহাসড়কে সামুরাইসহ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে চলন্ত প্রাইভেটকার থামিয়ে দুর্ধষ ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। শুক্রবার রাত আনুমানিক সোয়া এগারোটায় এই হামলায় গাড়িতে থাকা চালক ও দুই নারীসহ পাঁচজন আহত হন। ডাকাতির পুরো ঘটনাটি পেছন থেকে অন্য একটি গাড়ির যাত্রী ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিলে তা ভাইরাল হয়, যা নিয়ে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও ভিডিও ধারণকারী ঢাকার ধানমন্ডির বাসিন্দা ব্যবসায়ী ফজলে রাব্বি জানান, তারা বগুড়া থেকে ঢাকায় ফিরছিলেন। যমুনা সেতুর প্রায় এক কিলোমিটার আগে কড্ডার মোড়ে ঢাকাগামী লেনে দেখেন, ২৫-৩০ বছর বয়সী ১৪-১৫ জনের একটি দল একটি প্রাইভেটকারের গ্লাস ভাঙচুর করে লুটপাট চালাচ্ছে। ডাকাতদের পরনে হাঁটু পর্যন্ত ওঠানো লুঙ্গি থাকলেও গায়ে কোনো পোশাক ছিল না এবং প্রত্যেকের হাতে ছিল তিন-চার ফুট লম্বা রামদা বা সামুরাই। তারা যাত্রীদের সর্বস্ব লুটে নিয়ে সড়কের পাশের ধানক্ষেতের অন্ধকার দিয়ে পালিয়ে যায়। ভয়াবহ এ ঘটনার পর ক্ষতিগ্রস্ত প্রাইভেটকারটি যমুনা সেতুর টোল প্লাজায় পৌঁছালে আহতদের দেখা যায়। আহত পাঁচজনের মধ্যে মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়ে রক্তাক্ত এক বৃদ্ধও ছিলেন। ধারণা করা হচ্ছে, অস্ত্রের আঘাতে বা ভাঙা কাঁচের টুকরো লেগে তারা আহত হয়েছেন। এ বিষয়ে হাটিকুমরুল হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ইসমাইল হোসেন জানান, ঘটনাটি শুনেছেন তবে তা যমুনা সেতু পশ্চিম থানা এলাকার অধীনে। যমুনা সেতু পশ্চিম থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আব্দুল কাদের প্রথমে এটিকে ঢিল ছোড়ার ঘটনা বলে উল্লেখ করলেও বিস্তারিত তদন্তের আশ্বাস দেন। প্রকাশ্যে মহাসড়কে এমন দুধর্ষ ডাকাতির ঘটনায় চলাচলকারী যাত্রীদের মধ্যে তীব্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে এবং সড়কের নিরাপত্তা জোরদার করে দুষ্কৃতকারীদের কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের দাবি উঠেছে।

এছাড়াও এক সপ্তাহ আগে মাদারীপুরে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে ডাকাত দলের ১৩ সদস্যকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এসময় ডাকাতি হওয়া একটি পিকআপ উদ্ধার করা হয়। জেলার রাজৈর থানায় প্রেস ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান মাদারীপুরের সহকারী পুলিশ সুপার (শিবচর সার্কেল) সালাহ উদ্দিন কাদের। উদ্ধার পিকআপটির মালিক খুলনার রুপসা উপজেলার শিরগাতি গ্রামের সরদার জাহাঙ্গীর আলম (৬২)। তিনি দেশের বিভিন্ন জেলায় ফলের ব্যবসা করেন। পুলিশ জানায়, গত ২৩ সেপ্টেম্বর রাতে খুলনার তেরখাদা থেকে তরমুজ নিয়ে মাদারীপুরের মস্তফাপুর ফলের আড়ৎয়ে যাচ্ছিল একটি পিকআপ। পথিমধ্যে মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার আমগ্রাম ব্রিজ এলাকার গঙ্গাবর্দী স্থানে আসলে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের ওপর থেকে চালক-হেলপারকে মারধর করে তরমুজ ভর্তি পিকআপটি নিয়ে পালিয়ে যায় ডাকাত দল। ওইদিন রাতেই রাজৈর থানায় ডাকাতি মামলা করা হয়।

হাইওয়ে পুলিশ জানায়, সারা দেশে বিচ্ছিন্নভাবে ডাকাতির ঘটনা ঘটলেও মহাসড়কে ডাকাতদলের মাস্টার মাইন্ড বড় তিনটি গ্রুপ। এ গ্রুপের সদস্যরা খুব ধূর্ত প্রকৃতির। তাদের দেখলে বোঝার কোনো উপায় নেই, তারা ডাকাতদলের সদস্য। চক্রের সদস্যদের অনেকেই বিভিন্ন যানবাহনের চালকদের সঙ্গে লিয়াজোঁ করে ডাকাতি করে থাকে। বড় তিনটি গ্রুপের নাম হলোÑআরজু ডাকাতদল, কৃষ্ণকলি ডাকাতদল ও মারদাঙ্গা ডাকাতদল। প্রত্যেক গ্রুপে সাত থেকে আটজন করে সক্রিয় ডাকাত রয়েছে। পুলিশের একটি সূত্র জানায়, দেশের মহাসড়কগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে এক হাজার ৪৩ জনের ডাকাতদল। এরা তিনটি গ্রুপে বিভক্ত। তবে এরা সমন্বয় করে ডাকাতির কাজ করে। মহাসড়কের নির্জন এলাকাগুলোয় ঘটছে দুর্ধষ ডাকাতি। যানবাহনের যাত্রীদের অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে সর্বস্ব কেড়ে নিচ্ছে এই ডাকাতচক্র। পুলিশের ডেটাবেসে ডাকাতচক্রের সদস্যদের নাম, স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা, আগের পেশা, ডাকাতির মামলার সংখ্যা, পুলিশের হাতে এর আগে গ্রেপ্তার হয়েছিল কি না এবং কোন ডাকাতদলের সদস্যÑএর বিস্তারিত উল্লেখ আছে। এ কর্মকাণ্ডে যারা বাধা হয়ে দাঁড়ান, তাদের খুন করতেও দ্বিধা করছে না দুর্বৃত্তরা। শুধু তা-ই নয়, মহাসড়কে বাসের মধ্যে নারীদের ধর্ষণের ঘটনায়ও জড়িত এসব চক্র। তাদের চিহ্নিত করতে দেশব্যাপী হাইওয়ে পুলিশ ডাকাতদের একটি ডেটাবেস তৈরি করেছে। পুলিশ জানিয়েছে, বিগত সরকারের আমলে এসব ডাকাতদল ব্যাপকভাবে সক্রিয় ছিল। তবে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এ চক্রের সদস্যরা গাঢাকা ধেয়। প্রযুক্তির মাধ্যমে এ চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে পুলিশ। হাইওয়ে পুলিশ জানিয়েছে, ২০২৫ সালের আট মাসে দেশের হাইওয়ে থানাগুলোয় ডাকাতির ঘটনায় ৫৭টি মামলা হয়েছে। এ বিষয়ে অতিরিক্ত আইজিপি এবং হাইওয়ে পুলিশের প্রধান দেলোয়ার হোসেন মিঞা জানান, মহাসড়কে আমাদের টহল বেড়েছে। হাইওয়েকে নিরাপদ করতে দিনরাত কাজ করছি। সূত্র জানায়, গত ২০ সেপ্টেম্বর রাতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বাস ডাকাতির সময় দুই যুবককে হাতেনাতে আটক করে পুলিশ। চট্টগ্রামগামী আল আরাফাত পরিবহনের একটি বাসে এ ঘটনা ঘটে। যাত্রী নিয়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাচ্ছিল বাসটি। পথে রাত সাড়ে ১১টার দিকে কুমিল্লার জগনাথ দীঘি এলাকায় দুজন যাত্রী নামার জন্য গাড়ি থামালে সাত-আটজনের ডাকাতদল গাড়িতে উঠে ধারালো অস্ত্রের মুখে বাসটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করে। চালক বাসটি না থামিয়ে সামনে এগোতে চেষ্টা করলে ডাকাতদলের সদস্যরা বাস থেকে লাফ দিয়ে নেমে যায়। এ সময় যাত্রীরা দুজনকে আটক করে ৯৯৯-এ ফোন দিলে সীতাকুণ্ডের কুমিরা হাইওয়ে থানা পুলিশ গতিরোধক বসিয়ে বাসটিতে থাকা ৪২ যাত্রীকে উদ্ধার করে।