মিয়া হোসেন: আকাশে মেঘের ছায়া, না বৃষ্টি, না রোদ। মাঝে মাঝে বইছে হালকা বাতাস। সূর্য কখনো মেঘের আড়ালে লুকায়, আবার কখনো আলো ছড়ায়। টানা কয়েকদিন বৃষ্টির পর ঢাকার আকাশে এমনই এক আবহাওয়া বিরাজ করছিল ১৯ জুলাই বৃহস্পতিবার। আর এদিনই অনুষ্ঠিত হয়েছে জামায়াতে ইসলামীর ডাকা জাতীয় সমাবেশ। লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতির এ দিনে আবহাওয়া অনুকূলে থাকা সরাসরি আল্লাহর রহমত ছাড়া আর কিছুই নয়। আর এ জন্য বক্তব্যের শুরুতেই আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেছেন আমীরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমান। তিনি বক্তব্য দিতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পর আবার সুস্থ হয়ে বক্তব্য সম্পন্ন করেছেন এটাও আল্লাহর রহমত। এ জন্যও তিনি একাধিকবার আলহামদুলিল্লাহ বলে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেছেন। অল্প সময়ে ছোট বক্তব্যে সবচেয়ে বড় নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। আগামীর বাংলাদেশ সঠিক পথ নির্দেশনা পেয়েছে। পুরনো বস্তাপচা ব্যবস্থা থেকে সংস্কারের মাধ্যমে দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে আরেকটি লড়াইয়ের জন্য মানুষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। সমাবেশের পর থেকে মানুষের মুখে মুখে এ নিয়েই আলোচনা।

জামায়াতের ইতিহাস সৃষ্টি করা সমাবেশ গোটা জাতিকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। সকল গণমাধ্যমে ভালোভাবে কাভারেজ দিয়েছে। অনেক বিজ্ঞজন ফেসবুকে সমাবেশ নিয়ে স্ট্যাসাস দিয়ে লিখেছেন, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের পর এই প্রথম এত বড় আকারের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। সকল প্রকার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দিনভর জামায়াতের সমাবেশের ছবি, ভিডিও ও রিল প্রচার করা হচ্ছে। প্রত্যেকে যার যার মতো করে প্রচার করে যাচ্ছেন। মানুষের মধ্যে একটাই আলোচনা, নতুন বাংলাদেশ গড়তে তারাই পারবে।

সাধারণত রাজধানীতে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হলে যানজটের কারণে মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। কিন্তু জামায়াতের সমাবেশে শৃংখলা বিভাগের স্বেচ্ছাসেবকদের দায়িত্বপালন সবার নজর কেড়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় ছাত্ররা যেভাবে ঢাকায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের কাজ করেছিল, ঠিক সেভাবেই রাস্তার একপাশ দিয়ে গাড়ি চলাচলের জন্য ব্যবস্থা করেছে। নগরবাসী দুর্ভোগ থেকে কিছুটা রেহাই পাওয়ায় জামায়াতের প্রতি মানুষের সমর্থন আরো বেড়েছে।

সমাবেশে বেশকিছু বিষয় মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। সাধারণত এ ধরনের সমাবেশে যিনি প্রধান আকর্ষণ থাকেন তার চেয়ার থাকে অন্যদের থেকে বড় বা আলাদা। কিন্তু জামায়াতের সমাবেশে অন্যান্য সাধারণ অতিথিদের চেয়ারের মতো করেই আমীরে জামায়াতের চেয়ার ছিল। তিনি সবার সাথে এক সারিতে বসেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি নিজেকে সাধারণ মানুষের মতোই উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, আমি এখানে জামায়াতের আমীর হিসেবে নয়, ১৮ কোটি মানুষের একজন প্রতিনিধি হিসেবে এসেছি। শিশুদের বন্ধু, যুবকদের ভাই, প্রবীণদের সহযোদ্ধা হয়ে এসেছি, এই জাতির মুক্তির প্রত্যয়ে।

শনিবারে জামায়াতের সমাবেশ ইতিহাস সৃষ্টির পাশাপাশি একটি আদর্শে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রতীক হয়ে থাকবে। সকল ইসলামী দল এবং দেশপ্রেমে উজ্জীবিত অন্যান্য রাজনৈতিক দলসহ সকল পেশাজীবী নেতৃবৃন্দ সেখানে উপস্থিত হয়ে জামায়াতের সাতদফা দাবির প্রতি সমর্থন দিয়েছেন। আমীরে জামায়াতের সাথে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরেকটি লড়াইয়ে অংশ নেয়ার জন্যও প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।

মানুষ শান্তি চায়। নিরাপত্তা চায়। রাষ্ট্রের কাছ থেকে সহজে সেবা চায়। দুর্নীতির কারণে মানুষ সহজে কাক্সিক্ষত সেবা পায় না। স্বাধীনতার পর বিগত ৫৪ বছরে নির্বাচন ব্যবস্থা ঠিক হয়নি। মানুষ প্রতি ৫ বছর পর পর একবার ভোট প্রদান করবে সেই অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কারচুপি ও কেন্দ্র দখল করে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে রাজনৈতিক দলগুলো। এ জন্য মারামারি, হত্যা, খুন, লুটতরাজসহ নানা ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকে। নির্বাচন ব্যবস্থা ঠিক না হলে কোন কিছুই ঠিক হবে না। মানুষের ভোটে সংসদ প্রতিষ্ঠা না হলে দেশ থেকে দুর্নীতি দূর করা সম্ভব হবে না। আর এ কারণে পিআর পদ্ধতির দাবি জানানো হয়েছে। এ পদ্ধতির মাধ্যমে নির্বাচন ব্যবস্থায় একটি শৃংখলা আসবে। ভোট কারচুপি ও কেন্দ্র দখলের মহোৎসব বন্ধ হবে। এ জন্যই সংস্কারের প্রতি জোর দিয়েছেন আমীরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমান। তিনি পরিস্কারভাবে বলেছেন, এখন থেকে বাংলাদেশে পুরোনো কোন কিছুই থাকবে না। পুরোনো এই বস্তাপচা জিনিস যদি এই দেশে থাকে তাহলে কেন এত লোক জীবন দিলো? নতুন পদ্ধতিতে বাংলাদেশ চলবে। এছাড়া এদেশ চলবে না।

দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে প্রয়োজনীয় সংস্কারের বিকল্প নেই। সংসদ সদস্যগণ যাতে ন্যূনতম দুনীর্তিতে জড়াতে না পারেন সেজন্য নির্বাচনের অনেক আগেই এ ঘোষণা দিয়েছেন আমীরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমান। এমন কী আইনগত বৈধ সুবিধা নেয়া থেকেও জামায়াতের সংসদ সদস্যগণ দূরে থাকবে বলে তিনি ঘোষনা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, জামায়াত যদি আল্লাহর ইচ্ছা এবং জনগণের ভালোবাসায় দেশের মানুষের সেবা করার সুযোগ পায়, তাহলে মালিক হবে না, সেবক হবে, ইনশা আল্লাহ। আজ আমি ঘোষণা দিচ্ছি, যদি আল্লাহর ইচ্ছায় ও জনগণের ভালোবাসায় জামায়াত থেকে সংসদ সদস্যরা নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করেন, তাহলে কোনো এমপি-মন্ত্রী আগামী দিনে সরকারি কোনো প্লট গ্রহণ করবেন না। কোনো এমপি ও কোনো মন্ত্রী ট্যাক্সবিহীন কোনো গাড়ি চড়বেন না। কোনো এমপি ও কোনো মন্ত্রী নিজের হাতে কোনো টাকা চালাচালি করবেন না। কোনো এমপি ও কোনো মন্ত্রী যদি তাঁর নির্দিষ্ট কোনো কাজের জন্য বরাদ্দ পেয়ে থাকেন, কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের কাছে তাঁরা তার প্রতিবেদন তুলে ধরতে বাধ্য থাকবেন।

আমীরে জামায়াতের প্রতি মানুষের প্রত্যাশা অনেক। তিনি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সম্মুখসারিতে থেকে আন্দোলন করেছেন। পরবর্তী সময়েও জাতির ক্রান্তিকালে তিনি ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন। সমাবেশে হঠাৎ করে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ায় গোটা জাতি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। অসুস্থ হয়ে পড়ে যাওয়ার সাথে সাথে সমাবেশে উপস্থিত মানুষজন হাউ মাউ করে কাদঁতে থাকেন। ছেলে বুড়ো সবাই চোখের পানি ফেলতে থাকেন। আর আল্লাহর কাছে দোয়া করতে থাকেন। আল্লাহ উনাকে সুস্থ করেছেন। জাতির মুক্তির জন্য দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে শান্তির বাংলাদেশ গড়বেন, এটাই প্রত্যাশা।