১৯ জুলাই রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী আয়োজিত জাতীয় সমাবেশে এসেছিলেন জুলাইযুদ্ধে আহত আফজাল হোসেন ও মো. আমিরুল ইসলাম। দু'জনই রাজধানীর যাত্রাবাড়ি এলাকায় আন্দোলনকালে গুলীবিদ্ধ হয়েছিলেন। গতকাল সমাবেশস্থলে বসে তারা দৈনিক সংগ্রামকে বলেন তাদের আহত হওয়ার দিনের ঘটনা। লিখেছেন ইবরাহীম খলিল।
দৈনিক সংগ্রাম : আফজাল সাহেব, আপনি কবে গুলীবিদ্ধ হন ?
আফজাল হোসেন : ৫ই আগস্ট। আমরা দুইদিন আন্দোলন করেছি। এরপর শুনি শেখ হাসিনা পালিয়েছে। তখন মনের আনন্দে উল্লাস করছিলাম। আমরা মিছিল করছিলাম যাত্রাবাড়ি মাছের আড়তের সামনে। হঠাৎ পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলী শুরু করে। ওই সময়ে আমি গুলীবিদ্ধ হই।
দৈনিক সংগ্রাম : গুলীবিদ্ধ হওয়ার পর কোথায় চিকিৎসা নিলেন ?
আফজাল হোসেন : ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। প্রথমে আমি ভাল চিকিৎসা পাইনি। তিনি প্যান্ট টেনে দেখিয়ে বলেন, আমার উরুর মাংস খসে পড়ে গেছে। ঢাকা মেডিকেল আমার চিকিৎসা করেই ছেড়ে দেয়। বলে দেয় যে, হাড্ডি ভাল আছে তিনটা রগ ছিঁড়ে গেছে। এরপর আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যে ঘরে লাশ রাখে সেখানে পড়েছিলাম। পরে আমার মামা-মামির পাশে থাকে একলোক তিনি আমাকে দেখে চিনে কাছে আসেন। এরপর আমার মামা শ^শুর আমাকে নিয়ে যান যাত্রাবাড়িতে এক হাসপাতালে। সেখানে অর্থোপেডিকের সার্জিক্যাল ডাক্তার ছিল না। পরে আবার আমাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসা হয়। সেখানে যাওয়ার পর বলা হয় যে, আওয়ামী ডাক্তার যারা তারা নাই। পরে আমার শ্যালক, যে জামায়াত কর্মী ছিল, আসার পর আমি কাকরাইলে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে প্রথম চিকিৎসা নেই। এক মাস পর আবার ঢাকা মেডিকেলে য্ইা এক বন্ধুর মাধ্যমে। এরপর আবার ঢাকা মেডিকেলে যাই। পরবর্তীতে ৭ মাস দুইদিন ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নেই।
দৈনিক সংগ্রাম : এখন আপনার শরীরের অবস্থা কি? পেশাগত কাজ করতে পারেন?
আফজাল হোসেন : এখনো কোন কাজ করতে পারি না। কারণ আমার পায়ের ভিতর শতাধিক ইস্পাতের স্পিøন্টার রয়ে গেছে। যেটা মশুর ডালের দানার মতো। এজন্য আমি ঠিকমতো বসতেই পারি না। মাঝে মাঝে প্রচন্ড ব্যথা হয়।
অপর আহত জুলাইযোদ্ধা পেশায় গাড়ি চালক আমিরুল ইসলাম জানান, ২০ জুলাই যাত্রাবাড়ির কাজলা ধনিয়া এলাকায় তিনি গুলীবিদ্ধ হন। তিনি দৈনিক সংগ্রামকে জানান, সেখানে ফুটওভার ব্রীজের কাছে পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার সময় পুলিশের অতর্কিত গুলীবর্ষণে তার ডান পায়ে গুলী লাগে। এতে ডান পায়ের হাড্ডি কয়েক টুকরা হয়ে যায়। আহত হয়ে তিনি পঙ্গু হাসপাতালে ৫ সপ্তাহ চিকিৎসা নেন।
দৈনিক সংগ্রাম : আপনি কখন এবং কেন আন্দোলনে অংশ নেন।
আমিরুল ইসলাম : আন্দোলনে যোগ দেই যখন দেখি ছাত্রদের ওপর হামলা হলো। ১৫ জুলাই সাথে সাথেই ছাত্র ভাইদের সাথে আমরাও নামলাম আন্দোলনে। তাদের পাশে দাড়ানোই উদ্দেশ্য ছিল।
দৈনিক সংগ্রাম : আপনি কোনদিন গুলীবিদ্ধ হলেন?
আমিরুল ইসলাম : ২০ জুলাই।
দৈনিক সংগ্রাম : প্রথম দিনই আপনি গুলীবিদ্ধ হলেন?
আমিরুল ইসলাম : না, না, ১৫ জুলাই থেকেই রাস্তায় নামি। ৬ দিনের মাথায় আমি গুলীবিদ্ধ হই।
দৈনিক সংগ্রাম : ৬ দিনের আন্দোলনের গল্পটা বলেন, কিভাবে আন্দোলনে সম্পৃক্ত হলেন।
আমিরুল ইসলাম : শনির আখড়া থেকে যখন আমরা কুতুবখালীর কাছাকাছি যাই, তখনই পুলিশ আমাদের ওপর অতর্কিত হামলা করে। গুলী করে। আবার আমাদের ধাওয়া দেয় আমরা পিছু হটি। আবার যখন পুলিশ চলে যায় আমরা সামনে যাই। এভাবেই ২০ তারিখ পর্যন্ত চলতে থাকে। ২০ তারিখে আমি আর পুলিশকে ফাঁকি দিতে পারি নাই। আমার পায়ে গুলী করে দেয়।
দৈনিক সংগ্রাম : এটা দিনের কয়টার সময়?
আমিরুল ইসলাম : এটা শনিবার দিনের ১২টার পরে।
দৈনিক সংগ্রাম : আপনারা কয়টার দিকে রাস্তায় নেমেছিলেন?
আমিরুল ইসলাম : আমরা নামার সাথে সাথেই গুলী করে। তখন আমি গুলীবিদ্ধ হই।
দৈনিক সংগ্রাম : আপনাদের নেতৃত্বে কারা ছিল।
আমিরুল ইসলাম : আমাদের নেতৃত্বে ধনিয়া বিশ^বিদ্যালয় কলেজের শিক্ষার্থীরা ছিল।
দৈনিক সংগ্রাম : আপনাদের উদ্দেশ্য কি ছিল ?
আমিরুল ইসলাম : আমাদের উদ্দেশ্য ছিল ছাত্র-ছাত্রীদের সাহায্য করা।
দৈনিক সংগ্রাম : চিকিৎসায় কোন সমস্যা হয়েছে কি-না।
আমিরুল ইসলাম : ২০ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত তেমন কোনো চিকিৎসা পাইনি। অনেক কিছু কিনে দিতে হয়েছে। এরপরও চিকিৎসা পাইনি। ৫ তারিখের পর আমাদের ভাল এবং উন্নত মানের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
দৈনিক সংগ্রাম : আহত হওয়ার পর পুলিশী কোন হয়রানির শিকার হয়েছেন কি-না ?
আমিরুল ইসলাম : হাসপাতালে যাওয়ার পর পুলিশ অনেক বাধা দিয়েছে। হয়রানিও করেছে। দুপুরের ঘটনা। কিন্তু হাসপাতালে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। গুলীস্তান থেকে শুরু করে পঙ্গু হাসপাতাল পর্যন্ত প্রতিটি জায়গায় আমাকে আটকানো হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। অবশ্য কোন কোন পুলিশ রাস্তাও দেখিয়ে দিয়ে বলেছে যে, আপনারা এইভাবে চলে যান।
দৈনিক সংগ্রাম : হাসপাতালে যাওয়ার পর কোন সমস্যা হয়েছে কি-না।
আমিরুল ইসলাম : পঙ্গুতে যাওয়ার পর ডাক্তাররা আমাকে শিখিয়ে দেয় যে কোনভাবেই বলবেন না যে জুলাই আন্দোলনে আপনি আহত হয়েছেন। আপনি বলবেন যে আপনি পথচারী।
দৈনিক সংগ্রাম : আপনাকে কি চিকিৎসা দিয়েছে।
আমিরুল ইসলাম : প্রথমেই অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে ছিদ্র করে রড ঢুকিয়ে দিয়েছে। ২৮ দিনের মতো পা টানা দিয়ে রাখে। এই ২৮ দিনে একটার পর একটা করে মোট তিনটা অপারেশন করা হয়েছে।
দৈনিক সংগ্রাম : এখন আপনার কি অবস্থা ?
আমিরুল ইসলাম : এখনো আমার পা স্বাভাবিক না। পায়ের মধ্যে এখনো রড ঢুকানোই আছে। ডাক্তার বলেছেন ২ বছর পর রড খোলা হবে। তারপরও আগের মতো পা আর স্বাভাবিক হবে না।