ডা. আল কায়েস সরকার। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক। জুলাই আন্দোলনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সেবা দিয়েছেন আহতদের। সেই ঘটনা জানিয়েছেন দৈনিক সংগ্রামকে। লিখেছেন ইবরাহীম খলিল।
দৈনিক সংগ্রাম : জুলাই আন্দোলনে আপনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করেছেন। আপনারা কিভাবে সমন্বয় করেছেন সেই সময়কার পরিস্থিতি?
ডা. আল কায়েস সরকার : আমাদের একটা ক্রিটিকেল ইমারজেন্সি সেকশন আছে। ওয়ান স্টপ ক্রিটিকেল সেকশন। এর বাইরে কেজোয়ালিটি বিভাগ ছিল। যাদের ভাঙাচোরা নিয়ে আসতো তাদের অর্থোপেডিক বিভাগ দেখতো। এর বাইরে যারা মাথায় আঘাত প্রাপ্ত তারা নিউরো সার্জারি বিভাগ দেখতো। আমরা টিমে প্রায় অর্ধশত চিকিৎসক ছিলাম। এই মুহুর্তে যাদের নাম স্মরণে আসছে ডা: আলী আফতাব, আনোয়ার হোসাইন,মিতুল,আফসারুজ্জামান বুলবুল মেহেদী, ফয়েজ উল্লাহ, আব্দুল্লাহ আল মামুন, হাসান আল মামুন,মিনহাজুল আবেদীন।ইন্টার্ণ চিকিৎসক সাব্বির, সমন্বয়ক সুহাস,নিউরোসার্জারী বিভাগের আব্দুল আহাদ,শাখাওয়াত হোসাইন,তানভীর সিদ্দিকী, ইমাম হোসেন,হাসানুজ্জামান, আবুল বাশাপর,এনেস্থেসিয়া বিভাগের জাবেদ মোর্শেদ, মানজুর সহ আরও অনেক চিকিৎসক।
দৈনিক সংগ্রাম : আপনারা কি শুরু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডাক্তাররাই সেবা দিয়েছেন নাকি অন্যদেরও যুক্ত করেছেন ?
ডা. আল কায়েস সরকার : আমাদের সাথে যুক্ত হয়েছেন বিএসএমএমইউ বর্তমানে বিএমইউ থেকে ডাক্তাররা এসে ঢাকা মেডিকেলে যুক্ত হয়েছেন। এছাড়া বিভিন্ন ইন্সটিটিউট থেকেও ডাক্তাররা এসেছেন। কারণ ওইসব ইন্সটিটিউটে রোগীর চাপ কম ছিল। তারা স্বর্তস্ফুর্তভাবেই ঢামেকে এসেছেন। আমরা সবাই দায়িত্ব ভাগ করে নেই যে ২৪ ঘন্টা সার্ভিস দেবো। তাই আমরা রোস্টার করে নেই। আমরা চিন্তা করলাম রোগী প্রথমে প্রবেশ করেই যেন একটা ইমারর্জেন্সি সার্ভিসটা পায়। এরপর রোগী ওয়ার্ডে যায়। সেটা ফলো আপ করা। তখন ডাক্তার সংখ্যা খুবই কম ছিল। অনেকে ভয়ে মেডিকেলে আসেনি। সেই চিন্তা থেকে আমরা বললাম যে আমাদের একটা গ্রুপ ওয়ার্ডে থাকবে। এর বাইরে একটা গ্রুপ ছিল যেসব ইমার্জেন্সি অপারেশন লাগবে তাদের পাশে থাকা। অপারেশন থিয়েটারে কিছু স্বল্পতা ছিল। অধিকাংশ জিনিস সাপ্লাই ছিল, তারপরও ক্যানোলা ব্রেইন ইনজুরি রোগীদের জন্য বিশেষ গজ লাগে। ইমার্জেন্সি অপারেশনের সময় পেনডারিন নামের একটা ইনজেকশন লাগে। সে সময় ছিল না। আমাদের আরেকটা গ্রুপ ছিল তারা দেখতো কোথায় এগুলোর অভাব আছে তা খতিয়ে দেখা।
দৈনিক সংগ্রাম : যাদের ডিউটি ছিল তার বাইরে আপনার কাজ করেছেন ?
ডা. আল কায়েস সরকার : জি¦। এমনিতেতো ওভারলোডেড রোগী ছিল। নিয়মিত দায়িত্বরতরাতো দায়িত্ব পালন করছিলেন। এর বাইরে আমরা বহু রোগী সেবা পাচ্ছিল না। বারান্দাতে পড়ে আছে, তাদের সেবা দিচ্ছিলাম।
দৈনিক সংগ্রাম : আপনারা যখন কাজগুলো করেছেন তখন কি কেউ বাধা দিচ্ছিল ?
ডা. আল কায়েস সরকার : ওই সময় প্রকাশ্যে কেউ বাধা তৈরি করেনি। ওই সময় ছাত্রলীগের ডক্টররা স্বাচিবের ডাক্তাররা উপস্থিত ছিল। আমি ঢাকা মেডিকেলের ছাত্র হওয়ার কারণে আমাকে সরাসরি কেউ বাধা দেয়নি। আমি দেখা গেছে একটা কাজ করছি তখন অতুল এসে বললো আপনি এখানে ? আমার এক ফ্রেন্ড ছিল ছাত্রলীগের সভাপতি। এসে বলে যে এই তুই যা আমি দেখবো। তোর এখানে থাকা লাগবে না। আরেকজন এসে বললো যে আপনি এখানে কেন এসেছেন ? আরেকজন নোমান ভাই নামের সিনিয়র ভাই এসে বললেন যে হাসিনা পালাইছে। ক্রিটিকেল কেয়ার সেন্টারে একজন করে ডাক্তার পোস্টেট থাকতো। সেদিন রোগী বেশি থাকায় আমাকে একসেস দেয়।
দৈনিক সংগ্রাম : ওভার লোডেড হতাহত কোনদিন পেলেন ?
ডা. আল কায়েস সরকার : শুক্রবার থেকে শুরু হয়। এরপর টানা কয়েকদিন চলে।
দৈনিক সংগ্রাম : ৫ আগস্টেও পরিস্থিতি কেমন ছিল ঢাকা মেডিকেলে ?
ডা. আল কায়েস সরকার : সেদিন পরিস্থিতি ভয়াবহ ছিলো। ঢাকা মেডিকেলের তিনটা গেইট। নতুন ভবনে দুইটা গেইট। তিনটার মধ্যে দুইট গেইট বন্ধ ছিল। সেদিন গায়ে অ্যাপ্রোন দিয়ে বের হয়ে উকি দিয়ে দেখতাম বাইরের পরিবেশ। সেদিন যারা শহীদ মিনারে যেতে চেয়েছেন গুলী করা হয়েছে। ডেডবডি দেখেছেন অনেকে।
দৈনিক সংগ্রাম : ঢাকা মেডিকেলের সিনারিওটা কেমন ছিল আপনি যদি বলেন।
ডা. আল কায়েস সরকার : ১৫/১৬ জুলাই থেকেই ম্যাসাকারটা আসতেছিল। এরমধ্যে কোনদিক কম ছিল কোনদিন বেশি ছিল। আমাকে যদি বলতে হয়, আগস্টে সবচেয়ে বেশি লাশ দেখেছি। ৫ আগস্টে হাসিনার পতনের পর সবাই আনন্দ মিছিল করছিল। এমনকি ডাক্তাররাও মেডিকেলের বাইরে চলে যায়। সেদিন যাত্রাবাড়ী থেকে বিপুল সংখ্যক হতাহত হয়ে ঢাকা মেডিকেল আসছিল। মূলত ৩,৪,৫ আগস্ট সবচেয়ে বেশি এসেছে।
দৈনিক সংগ্রাম : কোন স্মৃতি যদি বলেন।
ডা. আল কায়েস সরকার : আমি একটা রোগী দেখলাম গুলী লেগেছে গলার সাইডে। লেগে পেছন দিক দিয়ে বের হয়ে গেছে। ওনার শ^াসনালি ফুটো হয়ে গেছে। আমরা পাওয়ার পর লাইফ সাপোর্টে দেওয়া হয়। তিনি যাত্রাবাড়িতে মে বি আহত হন। আরেকজন দেখেছিলাম ওনারও গলায় গুলী লেগেছিল। আমরা গরু জবাই দিলে রক্ত যেভাবে বের হয় ওনারও সেরকম হয়েছিল। গলায় গামছা দিয়ে পেচিয়ে আনা হয়েছিল। আমরা দেখার জন্য গামছাটা খুললাম আর রক্ত বের হওয়া শুরু করলো ফিনকি দিয়ে। এমনিতেও মাথার খুলি বের হয়ে গেছে, মগজ বের হয়ে গেছে। মানুষের রক্ত যে এতো গরম হয়, সেদিন টের পেয়েছি। ওই রুমটাতে থাকা যাচ্ছিল না যে এতো বিভৎস দৃশ্য। দৃশ্যগুলো সহ্য হচ্ছিল না। এজন্য বার বার বাইরে যাচ্ছিলাম।
দৈনিক সংগ্রাম : তখন প্রশাসনিক কোন বাধা পেয়েছিলেন কি-না ?
ডা. আল কায়েস সরকার : না। পরিচালক স্যার বেশ হেল্পফুল ছিলেন। আইসিইউ ম্যানেজ করা শিফট করা ছিল। তা ওনি করেছেন। তবে স্বাচিবের ডাক্তাররা প্রকাশ্যে কিছু না করলেও গোপনে কিছু করেছেন কি-না তা আমরা আসলে বলতে পারি না।
দৈনিক সংগ্রাম : পুলিশি কোন ঝামেলা হয়েছিল কি না ?
ডা. আল কায়েস সরকার : ৫ আগস্ট চানখার পুলে যে ম্যাসাকার হয়, সেখানকার গোলাবারুদ ও সেল এসে মেডিকেলে পড়েছিল। তবে আক্রমণ করেনি।
দৈনিক সংগ্রাম : বাইরে থেকে ঠিক কতজন ডাক্তার ডিউটি করেন ?
ডা. আল কায়েস সরকার : আমরা ৫০/৬০ জনের বেশি শুধু মাত্র বাই রুটেশনে কাজ করেছি।
দৈনিক সংগ্রাম : এসব কাজ করতে গিয়ে কি নিরাপত্তা হীনতায় ভূগেছেন ?
ডা. আল কায়েস সরকার : ১৮/১৯ জুলাই মূলত নিজেদের নিরাপদ মনে করিনি। তখন আমরা হাসপাতালের মধ্যেই আমাদের অ্যাসিস্ট্যান্ড রেজিস্ট্রার ভাই আছেন, তাদের এখানে আমরা থেকে যাই। ওই সময়টাতে যাকে তাকে শুট করা হচ্ছিল। তখন আমরা ডাক্তারা হয়েও বাইরে বের হতে ভয় পেয়েছিলাম। টানা তিনদিনই আমরা মেডিকেলে থেকে যাই।
দৈনিক সংগ্রাম : এই তিনদিনের পরিবেশ কেমন ছিল ?
ডা. আল কায়েস সরকার : এই তিনদিন সারাক্ষণ হতাহতরা আসতে ছিল। রাত দুইটা তিনটার দিকে একটু কমতো। আবার সকাল থেকে শুরু হতো।
দৈনিক সংগ্রাম : যারা আহত হয়ে আসতো তারা কি রাবার বুলেটে আহত নাকি মারণাস্ত্র ?
ডা. আল কায়েস সরকার : এরা সব মারণাস্ত্রতে আহত ছিল। ওই সময় রাবার বুলেটে আহতরা হাসপাতাল পর্যন্ত আসেনি। ওই সব ছোটখাটো ইনজুরিওয়ালারা রাস্তায় গুলী খাওয়ার ভয়ে ঢাকা মেডিকেলে আসে-ই নি। অধিকাংশই ছিল বিভৎস ইনজুরি। বুলেট থেকে ইনজুরি। দেখা গেছে ইনজুরির কারণে হাড্ডি ভেঙে গেছে। আরেকটা রোগী দেখেছিলাম বুকের বাম পাশটা গুলী লেগেছে। এতে তার ফুসফুস বাইরে বেরিয়ে যায়। দেখলাম রোগী শ^াস নিচ্ছে আর বুকের বাইরে ফুসফুস স্পাঞ্জ হচ্ছে। অনেকে এসেছে পেটে গুলী নিয়ে। দেখা গেছে গুলীতে মাথার খুলি পর্যন্ত উড়ে গেছে। কিছ্ইু করার নেই। অনেকে আনার পর বোঝাই যাচ্ছিল যে এই রোগী কিছুক্ষণ পর আর থাকবে না। তাকে ডেডবডি রাখার রুমে রেখে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। কারণ অল্প সময়ের মধ্যে মারা যাবে তা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল।