পুলিশের ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট‘র (সিআইডি) শুধু নেই আর নেই। নানা সীমাবদ্ধতা নিয়ে পুলিশের এই গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটটিকে একবিংশ শতাব্দীর জটিল অপরাধসমূহ মোকাবেলায় কাজ করতে হচ্ছে। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে দেশের অপরাধ দমনে সিআইডিকে আধুনিক ও প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে যেখানে অপরাধ তদন্ত ও তদন্ত সহায়ক কার্যক্রম পরিচালনা করার কথা, সেখানে সিআইডি প্রতিটি ক্ষেত্রে নানা সীমাবদ্ধতায় হোঁচট খাচ্ছে। ফলে কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের অভাব, দক্ষতার ঘাটতি, অনিয়মিত বদলির আতঙ্ক, দক্ষ কর্মকর্তাদের পদায়নে সীমাবদ্ধতা, মাঠপর্যায়ে ফরেনসিক ল্যাব না থাকায় অনেক সময় প্রয়োজনীয় আলামত বিশ্লেষণ বিলম্বিত হয়। পুলিশ সপ্তাহ ২০২৫ উপলক্ষে আয়োজিত উপস্থাপনায় গতকাল বুধবার ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত তাদের নানা কার্যক্রম, সাফল্য এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তুলে ধরেছে এভাবেই। রাজারবাগ পুলিশ অডিটোরিয়ামে সিআইডি প্রধান গাজী জসীম এসব উপস্থাপন করেন।
সিআইডি প্রধান তার উপস্থাপনায় জানান, অসাধারণ সাফল্য সত্ত্বেও লোকবল, ইকুইপমেন্ট এবং অর্থের সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি, সিআইডিতে রয়েছে নানা কাঠামোগত ও প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জ, যা তদন্তের গতি মন্থর করে বা অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ শুরু করাও কষ্টসাধ্য হয়। প্রথমত যানবাহনের সংকট। দেশের বিভিন্ন ইউনিটে যানবাহনের অপ্রতুলতা, কোনো কোনো জেলা ইউনিটে একটিও অপারেশনাল গাড়ি নেই। নিজস্ব স্থাপনায় অফিসের অভাব রয়েছে। সারাদেশে সিআইডির অধিকাংশ ইউনিটের অফিসই ভাড়া অফিস অথবা জেলা এসপি অফিসের উপরে পরিচালিত হয়। পাশাপাশি রয়েছে কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের অভাব, এতে তাদের দক্ষতার ঘাটতি হচ্ছে। এছাড়াও অনিয়মিত বদলির আতঙ্ক নিবেদিত কর্মকর্তা- কর্মচারীদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা তৈরি করে। দক্ষ কর্মকর্তাদের পদায়নে সীমাবদ্ধতা, মাঠ পর্যায়ে ফরেনসিক ল্যাব না থাকায় অনেক সময় প্রয়োজনীয় আলামত বিশ্লেষণ বিলম্বিত হয়। সাইবার পুলিশ সেন্টার (সিপিসি) এ রয়েছে প্রাযুক্তিক সরঞ্জামের অভাব। অনেক ক্ষেত্রেই প্রয়োজনীয় সাইবার টুলস ও সফটওয়্যার এর অভাব পরিলক্ষিত হয়। কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য যুগোপযোগী প্রশিক্ষণেরও অভাব রয়েছে। এছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট ফরেনসিক ল্যাবে রয়েছে সফটওয়্যারের জন্য উপযুক্ত বাজেটের স্বল্পতা। তিনি জানান, সিআইডি এখন শুধু একটি তদন্ত সংস্থা নয়, বরং নতুন বাংলাদেশে আইন ও বিচারব্যবস্থায় প্রযুক্তির মেরুদ- হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সিআইডি বিদ্যমান প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে অপরাধ দমনে কার্যকর প্রভাবক হিসেবে দেশের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে।
উপস্থাপনায় আরও জানা যায় যে, জুলাই ২০২৪-এর রাজনৈতিক অভ্যুত্থান-পরবর্তী অনুসন্ধানের জন্য সিআইডি গঠন করেছে বিশেষ তদন্ত কমিটি। সাবেক মন্ত্রী ও সমাজে প্রভাবশালীদের সন্দেহজনক সম্পদের উৎস ও প্রকৃতি নিয়ে নিবিড় অনুসন্ধান চালানো হয়। এছাড়াও এস আলম, বেক্সিমকো, বসুন্ধরা, নাবিল, ইউনিক, সিকদার গ্রুপসহ একাধিক বড় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা ও অনুসন্ধান শুরু হয়। অনুসন্ধানকালীন প্রায় ৫.৮০০ শতাংশ জমি ও হাজার কোটি টাকা মূল্যের সম্পদ শনাক্ত করা হয়েছে।
ফাইন্যান্সিয়াল ইউনিটের কার্যক্রম গতিশীল করার জন্য যাচাই বাছাই কমিটি বিভিন্ন উৎস যথা-বিএফআইইউ (বাংলাদেশ ব্যাংক), মেট্রোপলিটন ও জেলা পুলিশ, পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স ও অন্যান্য ইউনিটসমূহ, সিআইডি জেলা ইউনিটসমূহ, গণমাধ্যম (পত্রিকা, অনলাইন, পোর্টাল, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইত্যাদি) হতে প্রাপ্ত তথ্যাদি বিশ্লেষণ করে মানিলন্ডারিং এর মাধ্যমে অর্থপাচার, ও অবৈধ সম্পদ অর্জন ইত্যাদির উপর অনুসন্ধান পরিচালনা করে। স্বর্ণ চোরাচালান ও মাদক ব্যবসার মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দ্বারা কেনা জমি, বাড়ি, হোটেল ও গাড়ি চিহ্নিত করে আইন অনুযায়ী ক্রোক করা চলমান। রাজধানীর বাড্ডা, যশোর, লালমনিরহাটসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের আওতায় বহু মামলা রুজু হয়েছে এবং এসব মামলায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। কক্সবাজারের টেকনাফে একটি মামলায় প্রায় ১০ কোটি টাকার সম্পদ (২৯৫ শতাংশ জমি, বাড়ি, ৫টি প্রাইভেট কার) জব্দ করা হয়।
সিআইডি প্রধান তার উপস্থাপনায় উল্লেখ করেন, ফরেনসিক শাখা দিনে দিনে পরিণত হচ্ছে অপরাধ বিশ্লেষণের নির্ভরযোগ্য কেন্দ্র হিসেবে। এর প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানভিত্তিক ফরেনসিক প্রতিবেদন আপাত ক্লুলেস মামলার রহস্য উদঘাটনে ভূমিকা রেখে চলেছে। ফিঙ্গারপ্রিন্ট শনাক্তকরণ, ডিএনএ ল্যাব, ডিজিটাল ফরেনসিক ও কেমিক্যাল ল্যাব-এই চারটি ল্যাব অপরাধ বিশ্লেষণে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। শত শত মামলার আলামত পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে অপরাধীদের শনাক্ত ও বিচার প্রক্রিয়ায় সহায়তা প্রদান করা সম্ভব হয়েছে। ফিঙ্গারপ্রিন্ট শনাক্তকরণ, ডিএনএ ল্যাব, ডিজিটাল ফরেনসিক ও কেমিক্যাল ল্যাব- এই চারটি ল্যাব অপরাধ বিশ্লেষণে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। শত শত মামলার আলামত পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে অপরাধীদের শনাক্ত ও বিচার প্রক্রিয়ায় সহায়তা প্রদান করা সম্ভব হয়েছে। সম্প্রতি চাঁদপুরের মেঘনায় ৭ খুন, আসকাঠিতে যুবক হত্যা, বাড্ডায় চুরি প্রতিটি ঘটনার রহস্য উদঘাটনে সিআইডির বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ভূমিকা রেখেছে।
উপস্থাপনায় বর্তমান যুগের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ সাইবার ক্রাইম মোকাবেলায় সিআইডির অগ্রণী ভূমিকার বিষয়টি উঠে এসেছে। সংস্থাটির সাইবার পুলিশ সেন্টার (সিপিসি) এই অপরাধ দমন ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সক্রিয়। আন্তর্জাতিক শিশু পর্নোগ্রাফি চক্রের সদস্য গ্রেফতার, বাংলাদেশী হ্যাকার কর্তৃক নেপালী কিশোরীদের ব্ল্যাকমেইল, ইভেন্ট কোম্পানির ওয়েবসাইট হ্যাক ও গ্রাহকদের তথ্য ফাঁস, আতিফ আসলামের কনসার্ট টিকিট জালিয়াতি ও ডেটা চুরির মতো আলোচিত ঘটনার রহস্য উদঘাটন এর পাশাপাশি ফেসবুক ও ইউটিউব এর সাথে সমন্বয়ে বিভ্রান্তিকর পোস্ট বা প্রশ্নপত্র ফাঁসের গুজব দমনে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয়েছে।