যৌথবাহিনীর লাঠিপেটায় আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) চিকিৎসাধীন গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি সাবেক ভিপি নূরুল হক নূরের শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল এবং তিনি কথা বলছেন বলে জানিয়েছেন হাসপাতালটির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, তবে শরীরে ব্যথা আছে। নূরের যে ফ্র্যাকচার সেটি ঠিক হতে হাসপাতালে থাকা জরুরি নয়। হয়তো এক সপ্তাহের মধ্যে হাসপাতাল ত্যাগ করতে পারবেন। গতকাল রোববার সকালে সাংবাদিকদের তিনি এ তথ্য জানান।

ঢামেক পরিচালক বলেন, বর্তমানে নূরের শারীরিক অবস্থা স্ট্যাবল আছে এবং কথাবার্তা বলছেন। তিনি তরল খাবার খেতে পারছেন। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান জানান, তার মূলত চারটা সমস্যা ছিল। নাকের হাড় ভেঙে গিয়েছিল, মুখে একটা ক্র্যাক্স আছে, ডান চোখে ইঞ্জুরি এবং মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হওয়া। আমরা মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ নিয়ে কনসার্ন ছিলাম। তবে সিটি স্ক্যান করার পর দেখেছি এটা মোটামুটি রিসলভ হয়ে গেছে। তিনি জানান, নূরুল হক নূর এখন ভালো আছেন, তবে এখনও কিছুটা ট্রমায় আছেন। যেহেতু ফ্র্যাকচার হয়েছে তাই ব্যথা আছে, একটু ঘুমের সমস্যা হচ্ছে। তিনি আমাকে এটা জানিয়েছেন। ঢামেক পরিচালক বলেন, আসলে ফ্র্যাকচারের কোনও ওষুধ লাগে না। সময় দিলে অটোমেটাক্যালি ঠিক হয়ে যায়, চার থেকে ছয় সপ্তাহ সময় লাগে। এ জন্য হাসপাতালে থাকা জরুরি নয়। হয়তো এক সপ্তাহের মধ্যে হাসপাতাল থেকে চলে যেতে পারবেন। তারপর বাসায় বিশ্রাম নিলে ঠিক হয়ে যাবে। তার চিকিৎসায় ছয় সদস্যের মেডিকেল বোর্ডে নাক কান গলা বিশেষজ্ঞ, চক্ষু বিশেষজ্ঞ, নিউরো সার্জন, আইসিইউর প্রধান আছেন বলে জানান তিনি। ঢাকা মেডিকেলের পরিচালক বলেন, সকল বিভাগের প্রধানরা ওইদিন রাতে এবং আমি নিজে উপস্থিত থেকে এই বোর্ডটা পরিচালনা করি। ওখানে তার অ্যাসেসমেন্ট হয় এবং পরবর্তী ম্যানেজমেন্ট সম্পর্কে সিদ্ধান্ত হয়। উনি আগে যে হাসপাতালে ছিলেন, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে একটা সিটিস্ক্যান করেছিলেন। পরদিন সকালে আমরা আবার একটা সিটি স্ক্যান করি। নূরকে আইসিইউতে রেখেই প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেন তিনি।

গত শুক্রবার সন্ধ্যায় কাকরাইলে জাতীয় পার্টি ও গণঅধিকার পরিষদের নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে গণঅধিকারের নেতাকর্মীরা বক্সকালভার্ট সড়কে তাদের দলীয় কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেন। সেখানে নূর গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এমন সময় সেনা ও পুলিশ সদস্যরা নূর ও তার সহকর্মীদের লাঠিপেটা শুরু করে। হামলায় নূরসহ অন্তত ৫০ জন নেতাকর্মী আহত হন। ঘটনার পর নূরকে প্রথমে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে নেওয়া হয়, পরে রাতেই সেখান থেকে নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেলে। রাত ১১টার সময় নূরকে ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয় জানিয়ে পরিচালক আসাদুজ্জামন বলেন, প্রথমে উনাকে আমরা ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে নিয়ে যাই। ইনিশিয়ালি অ্যাসেসমেন্ট করার পরে তাকে আমরা আইসিউইতে শিফট করি। ওইদিন রাতেই আমরা একটা মেডিকেল বোর্ড গঠন করি।

আ.লীগের আমলেও এমন হামলা হয়নি: গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নূরুল হক নুূরের ওপর হামলা প্রসঙ্গে যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেছেন, আওয়ামী লীগের আমলেও একটা রাজনৈতিক দলের প্রধানের ওপর হামলা হয়নি। নূরের ওপর হামলার ঘটনায় একটি শক্তিশালী তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। যারা এর সঙ্গে জড়িত তাদের বিচার হবে। গতকাল রোববার নূরুল হক নূরকে দেখতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে যাওয়ার পর সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি এমন মন্তব্য করেন। ক্রীড়া উপদেষ্টা বলেন, ফ্যাসিবাদী শক্তি জুলাই অভ্যুত্থানের শক্তির ওপর ক্ষোভ মেটানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। আমরা সেটা বরদাস্ত করবো না। সরকারের দিক থেকেও এসব কার্যক্রম সহ্য করা হবে না। একটি শক্তিশালী তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, যারা এর সঙ্গে জড়িত তাদের বিচার হবে। কোন কোন ইনস্টিটিউশন রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে থেকে ফ্যাসিবাদের পক্ষে কাজ করে যাচ্ছে সেগুলো খতিয়ে দেখা হবে।

কোনটা মব আর কোনটা রাজনৈতিক কর্মসূচি তার পার্থক্য আগে বুঝতে হবে। এমন মন্তব্য করে আসিফ মাহমুদ বলেন, একটা নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল কীভাবে মব করে? জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে প্রথম হামলা হয়েছে। জাতীয় পার্টি চিহ্নিত ফ্যাসিবাদী দল। জাতীয় পার্টির মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগকে ফেরানো পরিকল্পনা চলছে। ইনক্লুসিভ নির্বাচনের নামে অনেকে চাইবে না আওয়ামী লীগকে ছাড়া জাতীয় নির্বাচন হয়ে যাক। আওয়ামী লীগকে আনতে অনেকে নির্বাচন পেছানোর চেষ্টা করবে। জাতীয় পার্টির নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত এখনো সরকারের পক্ষ থেকে হয়নি। এরইমধ্যে প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার আহ্বান জানিয়েছেন। সেখানে এ বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ করা হবে।

আইএসপিআরের বিবৃতি প্রত্যাখ্যান: আইএসপিআরের দেওয়া বিবৃতি প্রত্যাখ্যান করে গণঅধিকার পরিষদের সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খাঁন অভিযোগ করে বলেন, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নূরুল হক নূরসহ শতাধিক নেতাকর্মীর ওপর রক্তাক্ত হামলা চালিয়েছে সেনাবাহিনী এবং পুলিশ। গতকাল রোববার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি এমন অভিযোগ করেন। রাশেদ খাঁন বলেন, বিভিন্ন মিডিয়ায় এসেছে কীভাবে গণঅধিকার পরিষদের কার্যালয়ে সেনাবাহিনী ভাঙচুর চালিয়েছে। সে সময় আতঙ্কে নেতাকর্মীরা বাথরুমে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেনা সদস্যরা বাথরুমের দরজা ভেঙে তাদের বের করে রক্তাক্ত করে। আমার নিজের কাছে লজ্জা লাগছে সেনাবাহিনীর নাম মুখে নিতে হচ্ছে। সেনাবাহিনী আমাদের গর্বের প্রতিষ্ঠান। গণঅভ্যুত্থানে ভূমিকা রয়েছে এই বাহিনীর। অথচ কতিপয় ব্যক্তিকে রক্ষার জন্য পুরো বাহিনীকে কলুষিত করা হচ্ছে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, সেনাপ্রধানকে ২৪ ঘণ্টার সময়সীমা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এখনো তিনি তার অবস্থান স্পষ্ট করেননি। কেন তিনি তার অবস্থান স্পষ্ট করছেন না, সেটি আমাদের কাছে উদ্বেগজনক।

সাংবাদিক সম্মেলনে রাশেদ খান জানান, নূরুল হক নূর এখনো ঢামেকের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন। গতকাল (শনিবার) রাতে আমি তার সঙ্গে দেখা করেছি। পুলিশ তাকে আঘাত করেছে এমন খবর এলেও সেটি সঠিক নয়। মূলত সেনাবাহিনীর কয়েকজন সদস্য তাকে চিনতে পেরেই একের পর এক আঘাত করেছে। আপনারা দেখেছেন, একজন সেনা সদস্য লাঠি দিয়ে নুরের বুকে আঘাত করেছে। তিনি বলেন, জুলাই মাসে গণঅভ্যুত্থানের সময় নূরুল হক নূর বলেছিলেন, হাসিনার ৯০ শতাংশ পতন হয়েছে, ১০ শতাংশ বাকি। সেই ঘোষণার প্রতিশোধ হিসেবেই এই হামলা চালানো হয়েছে। সেখানে কয়েকজন সেনা সদস্য বলেছেন, জুলাই ভরে দেওয়া হবে। আমরা জানতে চাই, এরা কারা? এরা ছাত্রলীগ-যুবলীগ ক্যাডারের চেয়েও ভয়ংকর। রাশেদ খাঁন বলেন, দেশপ্রেমিক বাহিনী সেনাবাহিনীতে তাদের চাকরি করার সুযোগ নেই। তাদের গ্রেফতার করে শাস্তি দিতে হবে। আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, নূরুল হক নুরের চিকিৎসা বাংলাদেশে নিরাপদ নাও হতে পারে। হাসিনার আমলে নূর ২২ বার হামলার শিকার হয়েছে, শরীর ক্ষতবিক্ষত। এখন তার উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন। আমরা মনে করি তাকে সিঙ্গাপুর অথবা যুক্তরাজ্যে নিতে হবে। তিনি জানান, সরকারের পক্ষ থেকে নূরকে বিদেশে পাঠানোর ঘোষণা এসেছে। রাষ্ট্রপতিও নূরকে ফোন করে বলেছেন, বিদেশে নেওয়া হবে। গণঅধিকার পরিষদ আশঙ্কা করছে দেশে চিকিৎসা চললে নুরের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে। রাশেদ খাঁন বলেন, আগেও দেখা গেছে, ইনজেকশন পুশ করে জনপ্রিয় নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। তাই মনে হচ্ছে নুরের ওপর টার্গেট করে হামলা করা হয়েছে।

সরকার বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনের কথা বললেও তারা সেটি করবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছি, জুলাই অভ্যুত্থানেও ভূমিকা রেখেছি। কিন্তু সরকার বৈঠকে তিনটি দলকে আমন্ত্রণ জানিয়ে আমাদের প্রতি বৈষম্য করেছে। ফলে সরকারের প্রতি পূর্ণ আস্থা রাখতে পারছি না। আইএসপিআরের বিবৃতির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তারা বলেছে ‘মব’ হামলা হয়েছে। কিন্তু মব করেছে কারা? আমরা আমাদের কার্যালয়ের সামনে প্রেস ব্রিফিং করছিলাম, তখন সেনাবাহিনীর কয়েকজন সদস্য হামলা চালায়। এটিকে মব বলা যায় না। যদি মব হয়েই থাকে, তাহলে সেই মব সৃষ্টি করেছে সেনাবাহিনীর কয়েকজন সদস্য। তিনি স্পষ্টভাবে জানান, সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে যে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে আমরা সেটি প্রত্যাখ্যান করছি। আমাদের কার্যালয়ে ভাঙচুর করা হয়েছে, ভেতরে ঢুকে নেতাকর্মীদের রক্তাক্ত করা হয়েছে। এটাকে যদি মব বলা হয়, তবে সেই মব করেছে সেনাবাহিনী।

স্বামীকে বিদেশে নিতে চান নূরের স্ত্রী : গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি ও সাবেক ডাকসু ভিপি নূরুল হক নূরের স্ত্রী মারিয়া নূর বলেছেন, বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আট বছরেও আমার স্বামীর ওপর এত নৃশংস ও ন্যক্কারজনক হামলা হয়নি। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও ডাকসু নির্বাচনসহ নুরের ওপর হামলা হয়েছে, তবে বর্তমানে ফ্যাসিস্টমুক্ত দেশে প্রশাসনের সময়ে এ ধরনের ভয়ঙ্কর হামলা হবে তা ছিল কল্পনাতীত। গতকাল রোববার দুপুর একটার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে এসে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে কান্নাজড়িত কণ্ঠে এসব কথা বলেন তিনি। এ সময় তিনি স্বামীকে চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়ার দাবি জানান। তিনি বলেন, আমার লাইফটা সম্পূর্ণ আলাদা। তারপরও মিডিয়ার সামনে আসতে বাধ্য হলাম। ৩০ তারিখ ঘটনাটি যখন ঘটে, তখন আমি লাইভ দেখছিলাম। আমি কখনো কল্পনাও করতে পারিনি। স্তব্ধ হয়ে গেছি। কিছু বর্ণনা করার মতো ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না।

তিনি আরও করেন, এই বাংলাদেশে নূরের ওপর গত ৮ বছরে ফ্যাসিস্ট আমলেও এতটা নৃশংসভাবে হামলা হয়নি। ডাকসু নির্বাচনে তার ওপরে হামলা হয়েছিল আওয়ামী ফ্যাসিস্ট ছাত্রলীগ-যুবলীগদের দ্বারা। কিন্তু বর্তমানে প্রশাসনের এই সময়ে এসে এমন হামলা আমার কাছে কল্পনাতীত। মারিয়া নূর বলেন, ওর(নূর) শারীরিক অবস্থা এখনো ভালো নয়। শারীরিকভাবে এত আঘাত করা হয়েছে যে, ব্রেন, নাক ও চোয়ালে আঘাত পেয়েছে। ভেতর থেকে মেরুদ-সহ বিভিন্ন জায়গায় আঘাত লেগেছে। ডাক্তাররা বলছিলেন, ৩৬ ঘণ্টা অবজারভেশনের পর কিছু বলা যাবে। তার জ্ঞান ফিরেছে, কিন্তু শারীরিক অবস্থা ভালো নয়। এখনো ডাক্তাররা বলছেন, ৭২ ঘণ্টা না গেলে কিছু বলা সম্ভব নয়। তার মানে তিনি এখনো আশঙ্কামুক্ত নন। তিনি আরও বলেন, এই শঙ্কার মধ্যে মিডিয়ার সামনে আসা সহজ নয়। কিন্তু ওর অবস্থা জানার জন্য আমি হাসপাতালে এসেছি। আমি আপনাদের মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে তার জন্য দোয়া চাইছি। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে দেশের বাইরে নেওয়ার ব্যবস্থা যেন করা হয়।