সমানতালে চলছে শিল্পে ও আবাসিকে গ্যাস সংকট। শিল্প মালিকরা বহুগুন বেশি দামে গ্যাস ক্রয়ের পর নিয়মিত বিল পরিশোধ করে কাক্সিক্ষত গ্যাস পাচ্ছে না অপরদিকে বাসাবাড়িতে গ্যাস সংকট বেড়েই চলছে। সব মিলে গ্যাস সংকটে চরম দুর্ভোগে রয়েছে মানুষ। গ্যাস সংকটে খবর শিল্পাঞ্চলগুলোতে সরেজমিনে পরিদর্শনে যাচ্ছেন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান। পরিদর্শনকালে শিল্পখাতে গ্যাস সংকটের কথা স্বীকার করেছেন তিনি।

জানা গেছে, গত এক বছরের ব্যবধানে দৈনিক গ্যাসের উৎপাদন কমেছে ৬০ কোটি ঘনফুট। গত ২৮ মে খনি থেকে প্রাপ্ত গ্যাস এবং বিদেশ থেকে আমদানি মিলিয়ে গ্যাসের প্রাপ্তি ২০০ কোটি ৪৮ লাখ ঘনফুট । গতবছর তা ছিল ২৬১ কোটি ২৭ লাখ ঘনফুট। গ্যাসের উৎপাদন কমে যাওয়ায় বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ কমেছে। এই অবস্থায় লোডশেডিং কমাতে তেলভিত্তিক কেন্দ্র চালু করেছে সরকার। শিল্পে গ্যাস নেই, বাসাবাড়ির চুলাও জ্বলছে না।

পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, গত ৩০ মে ২৪০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করেছে পেট্রোবাংলা। এর মধ্যে বিদেশ থেকে আমদানি করা এলএনজি ৫৯ কোটি ঘনফুট। গত বছর ঠিক একই দিনে গ্যাসের সরবরাহ ছিল ২৭৩ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে আমদানি করা এলএনজির পরিমাণ ৭৭ কোটি ঘনফুট। ৩১ মে ২০২৪ সালে গ্যাস সরবরাহ করা হয় ২৬১ কোটি ৭০ লাখ ঘনফুট এর মধ্যে আমদানি করা এলএনজি ছিল ৬০ কোটি ঘনফুট। ঠিক এক বছর পরে এসে গত ৩১ মে গ্যাসের সরবরাহ ছিল ২৪৬ কোটি ৬৫ লাখ ঘনফুট। এর মধ্যে আমদানি করা এলএনজির পরিমাণ ৬১ কোটি ৭০ লাখ ঘনফুট।

ব্যবসায়ী নেতারা বলেছেন, শিল্প-কলকারখানায় গ্যাস সংকটের জন্য ৭০ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবেন তারা। এ সংকট জিইয়ে রেখে প্রকারান্তরে তাদের প্রাণে মারা হচ্ছে। শিল্পে গ্যাসের সমস্যা দিন দিন বাড়ছে, একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কিছু নীতিনির্ধারক এখনো উটপাখির মতো বালুর মধ্যে মাথা গুঁজে বসে আছেন, বাস্তবতা দেখতে পারছেন না।

তারা বলেন, গ্যাসের কারণে বন্ধ রয়েছে বস্ত্র খাতের ৫০ শতাংশ কারখানা। শিল্প বাঁচানো না গেলে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি ধ্বংস হতে পারে, যা দুর্ভিক্ষ ও বিশৃঙ্খলার কারণ হবে। শিল্পবিরোধী কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশের শিল্প-কলকারখানাগুলো প্রায় ধ্বংস হয়ে পড়েছে। গ্যাস সংকটের কারণে শিল্পোদ্যোক্তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকেছে, মূলধন কমে গেছে। শিল্পমালিকেরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শিল্পে গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করার দাবি করেন। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত স্থগিত, শিল্প খাতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহে মধ্য-দীর্ঘমেয়াদি কৌশলের আহ্বান জানান তাঁরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের শিল্পাঞ্চলেও গ্যাসের চাপ কম। সাধারণত ১০ থেকে ১৫ পিএসআই (প্রতি বর্গইঞ্চি) চাপে গ্যাস সরবরাহ করা হয় শিল্পকারখানায়। এবার গ্যাসের সরবরাহ কম থাকায় কারখানা গ্যাস পাচ্ছে ১ থেকে ২ পিএসআই চাপে। রপ্তানিশিল্প এলাকা হিসেবে পরিচিত নারায়গঞ্জ ও গাজীপুরের কারখানাগুলোর উৎপাদনও কমে গেছে। কোথাও কোথাও রেশনিং করে কারখানা চালু রাখতে হচ্ছে। সামনে সংকট আরও বাড়তে পারে এমন আশংকা ভুক্তভোগীদের।

সূত্র জানায়, গ্যাসের উৎপাদন কমে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন শিল্পমালিকেরা। চলছে না কলকারখানা। গত বছরের ৩০ মে শিল্পকারখানায় নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্রে যা ক্যাপটিভ পাওয়ার নামে পরিচিত, সেখানে গ্যাস সরবরাহ ছিল ১০ কোটি ১১ লাখ ঘনফুট। আর গত ৩০ মে ক্যাপটিভ পাওয়ারে গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে ৮ কোটি ৩৭ লাখ ঘনফুট। শিল্পকারখানার নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্র, যা জেনারেটরের মাধ্যমে উৎপাদিত হয়, সেখানে গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ায় অনেক কারখানা উৎপাদন কমিয়ে এনেছে।

মিথিলা গ্রুপের চেয়ারম্যান আজহার খান জানান, গত বছরের অক্টোবরের পর থেকে গ্যাসের চাপ দিনের বেলায় শূন্য দশমিক ৫ থেকে ১ পিএসআই, আর রাতের বেলায় দেড় থেকে ২ পিএসআইয়ে নেমে আসায় কারখানা চালু রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে উৎপাদনের পরিমাণ ৩০ শতাংশে নেমে এসেছে। কেবল গ্যাসের অভাবে অনেক বায়ারের অর্ডার নিতে পারছি না। যে কয়টা অর্ডার রয়েছে লোকসান হলেও বায়ারদের সঠিক সময়ে পণ্য সরবরাহের জন্য তিনগুণ বেশি ব্যয়ে গ্যাসের বদলে তুষচালিত বয়লার ব্যবহার করা হয়। যদি স্বাভাবিক গ্যাস সরবরাহ থাকতো তাহলে প্রতি বছরে মিথিলা গ্রুপে প্রায় একশ’ মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা যেত।

দেশের সব থেকে বড় গ্যাস বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিসন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন পিএলসি। তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহনেওয়াজ পারভেজ বলেন, ‘আমরা শিল্পে গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে চেষ্টা করছি। তিতাসে যতখানি গ্যাস দেওয়া হচ্ছে, তার সর্বোত্তম ব্যবহারের চেষ্টা করা হচ্ছে। উৎসে গ্যাস সরবরাহ বাড়লে আমরা আরও ভালো সেবা দিতে পারব।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, বিগত সরকারের মধ্যে দুটি পক্ষ ছিল। একটি ছিল এলএনজি আমদানি করার পক্ষে, অন্যটি দেশীয় গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধির পক্ষে। আর এ সরকারের আমলে কোনো পক্ষ নেই। এলএনজি আমদানিই তাদের মূলনীতি।

তিনি বলেন, এই সরকার দেশের স্থলভাগের গ্যাসও বিদেশি কোম্পানির হাতে ছেড়ে দিতে চায়। অথচ এ কাজে বাপেক্সের চেয়ে দক্ষ কেউ নেই। সরকারের উচিত ছিল বাপেক্সকে দিয়ে বড় আকারে স্থলভাগের গ্যাস উত্তোলনে ব্যবস্থা নেওয়া, পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় গ্যাস উত্তোলনে জোর দেওয়া, তারা সেটা করছে না। আগামীতে জ্বালানি সংকট ভয়াবহ হবে, এটা অনেকে ভাবতে পারছে না।

এদিকে গ্যাস সংকট সরেজমিনে দেখতে গত শনিবার নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে যান পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান। সেখানে তীব্র গ্যাস সংকটে পড়েছে দেড় শতাধিক শিল্প কারখানাগুলো। এতে ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন। বন্ধ হয়ে গেছে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। তিন মাস ধরে গ্যাস সংকট থাকায় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন কারখানার মালিকরা।

কম্প্রেসড ন্যাচারাল গ্যাস (সিএনজি) ও ডিজেলচালিত জেনারেটরে খরচ বাড়ার কারণে বাড়ছে উৎপাদন ব্যয়, কমছে উৎপাদন সক্ষমতা। এ পরিস্থিতিতে শনিবার সকালে আড়াইহাজারের দুপ্তারা ইউনিয়নের খানপাড়া এলাকায় অবস্থিত লিড প্লাটিনাম সনদপ্রাপ্ত সবুজ কারখানার স্বীকৃতি পাওয়া মিথিলা টেক্সটাইলের ওভেন ডাইং কারখানা পরিদর্শন করেন বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ কর্পোরেশনের (পেট্রোবাংলা) চেয়ারম্যান মো. রেজানুর রহমান ও তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিসন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শাহনেওয়াজ পারভেজ।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানমো. রেজানুর রহমান বলেন, আমি সরেজমিনে গ্যাস সরবরাহ দেখতে এসে গ্যাস সংকটের সত্যতা পেয়েছি। আমরা এই সংকট উত্তরণের জন্য কাজ করছি।’

তিতাসের এমডির কাছে গ্যাসের অস্বাভাবিক উঠানামার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন। এ বিষয়টি দ্রুত সমাধানের পদক্ষেপ নেবেন বলে জানান তিনি বলেন, সারাদেশেই গ্যাসের সরবরাহ কম। অন্যদিকে যেখান থেকে গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে, আড়াইহাজার উপজেলা হচ্ছে সর্বশেষ প্রান্ত। ফলে অন্য মিল কারখানাগুলো গ্যাস টানার পরে আড়াইহাজার এলাকায় এসে গ্যাসের চাপ তেমন থাকে না। সরকার এ সমস্যার উত্তরণে কাজ করছে।