মহামারি আকার ধারণ করেছে অসংক্রামক রোগ ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই রোগটি সব বয়সের মানুষের কর্মক্ষমতাকে কাহিল করে দিচ্ছে। ভোগান্তিতে পড়ছে সব বয়সের মানুষ। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ায় হুমকির মধ্যে পড়ছে দেশের ভবিষৎ। উদ্বেগ বাড়াচ্ছে সচেতনমহলকে।
একটা সময় বলা হতো ডায়াবেটিস বড়লোকের বা ধনীদের রোগ। শহরে অলস জীবনযাপন করার কারণে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন। কিন্তু বর্তমানে সেকথা ছাপিয়ে শহর থেকে গ্রামÑসব জায়গায় এই ‘নীরব ঘাতক’ ডায়াবেটিস দ্রুত বিস্তার লাভ করছে। চিকিৎসকরা বলছেন, পরিবর্তিত জীবনধারা, অস্বাস্থ্যকর খাবার এবং শারীরিক পরিশ্রমের অভাবই এই রোগের দ্রুত বিস্তারের মূল কারণ। আশঙ্কার বিষয় হলো, জনসচেতনতা না থাকায় অনেকেই জানেন না যে, তারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। সময়মতো চিকিৎসানা হওয়ায় জটিলতা আরও বেড়ে যায়। বিশেষজ্ঞদের মত, আধুনিক নগরজীবনের ব্যস্ততা, ফাস্টফুড নির্ভরতা এবং অনিয়মিত ঘুম ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। আগে যেখানে বয়সভিত্তিক রোগ হিসেবে ধরা হতো, এখন কিশোর যুবকরাও এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। জাতীয় পুষ্টি ইনস্টিটিউটের সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, ২৫ বছর বয়সের পর থেকেই ডায়াবেটিসের প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দিচ্ছে অনেকের শরীরে। বিশেষ করে যারা অফিসকেন্দ্রিক স্থির জীবনযাপন করেন, তাদের মধ্যে ঝুঁকি তুলনামূলক বেশি।
প্রাপ্ত তথ্য বলছে, বাংলাদেশে প্রায় এক কোটি ৩৯ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসে ভুগছেন। রোগটিতে ২০ থেকে ৮০ বছর বয়সি ১৪ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ ভুগছেন। উদ্বেগের কারণ হলো, দেশের শতকরা ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ মানুষ জানেই না তারা রোগটিতে আক্রান্ত। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে অষ্টম। দেশে ১০ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয় ডায়াবেটিসে। এই রোগ প্রতিরোধে এখনই কার্যকর উদ্যোগ না নিলে ২০৪৫ সালে দেশে রোগীর সংখ্যা দুই কোটি ২০ লাখ ছাড়িয়ে যাবে।
বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির প্রকাশিত এক সাময়িকীতে বারডেম জেনারেল হাসপাতালের অ্যাকাডেমি পরিচালক ফারুক পাঠান লিখেছেন, দেশে বর্তমানে প্রতি চারজন প্রাপ্তবয়স্কর একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারেন। এই হিসাব সঠিক হলে দেশে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা তিন কোটিরও বেশি হতে পারে বলে উল্লেখ করেন তিনি। তিনি সতর্ক করে বলেন, বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকলে পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যাবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে কর্মক্ষম মানুষের মধ্যে ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। গত দুই যুগে ডায়াবেটিক রোগী হয়েছে প্রায় আট গুণ। ২০ থেকে ৭৯ বছর বয়সি প্রতি ১০ জনের মধ্যে সাতজনই কোনো না কোনোভাবে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, অর্থাৎ কর্মক্ষম ৭০ শতাংশ মানুষ এই রোগে ভুগছেন। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক এ কে আজাদ বলেন, সাম্প্রতিক কোনো জাতীয় পর্যায়ের তথ্য না থাকলেও স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছেÑ ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। তার মতে, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষই নিজের অবস্থা সম্পর্কে জানেন নাÑ যার অর্থ প্রকৃত রোগীর সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতে পারে।
আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৪৩ দশমিক ৫ শতাংশ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের রোগ নির্ণয় হচ্ছে না। এই সংস্থার যে চিত্র, তাতে দেখা যায়, রোগটি বাংলাদেশে ঊর্ধ্বমুখী। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি জানিয়েছে, বাংলাদেশে গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের হার ৬ থেকে ১৪ শতাংশ। এছাড়া গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নারীদের টাইপ–২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি, প্রায় ৫০ শতাংশ। গর্ভকালে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে শিশুদেরও আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
ল্যানসেট জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী প্রায় ৮০ কোটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ বর্তমানে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। গত ৩০ বছরে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের হার দ্বিগুণ হয়েেেছ। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, ইনসুলিন নামক এক প্রকার হরমোনের অভাব হলে কিংবা উৎপাদিত ইনসুলিনের কার্যকারিতা কমে গলে রক্তের গ্লুকোজ দেহের বিভিন্ন কোষে প্রয়োজনমতো ঢুকতে পারে না। ফলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায়। এ পরিস্থিতিকেই ডায়াবেটিস বলে। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস অন্ধত্ব, হৃদরোগ, কিডনি রোগ, স্ট্রোক, মাড়ির রোগ ও পঙ্গুত্বের মতো কঠিন রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। এ রোগের চিকিৎসা না নেওয়া হলে হৃৎপিণ্ড, রক্তনালি, স্নায়ু ও অন্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্ষতি হতে পারে। এই রোগটিতে যেকোনো বয়সী আক্রান্ত হতে পারে। বর্তমান সময়ে ব্যাপক হারে তরুণরাও আক্রান্ত হচ্ছে। ডায়াবেটিস প্রতিরোধে মানসিক চাপমুক্ত থাকা ও অতিভোজন এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেন।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা মনে করেন, জীবনে যেকোনো সময়ে, যেকোনো বয়সি মানুষই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারেন। মাঝে মাঝে রক্তের সুগার পরীক্ষার পাশাপাশি নিয়ন্ত্রিত জীবন-যাপন করতে হবে। চিকিৎসকরা বলেন, উন্নত বিশ্বস্বাস্থ্যের জন্য ডায়াবেটিসের কারণে সৃষ্ট পঙ্গুত্বসহ অন্যান্য সম্ভাব্য পরিণতির কথা মাথায় রেখে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং ব্যায়ামের মাধ্যমে এটিকে প্রতিরোধ করতে হবে। এজন্য নিম্ন-আয়ের দেশগুলোতে স্বাস্থ্যকর খাবার সহজলভ্য করে এবং ব্যায়ামের সুযোগ বাড়াতে হবে।
আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের (আইডিএফ) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় এক কোটি ৩৯ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসে ভুগছেন। তবে প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশিÑযা দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও অর্থনীতির ওপর গুরুতর চাপ সৃষ্টি করছে।
বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস উপলক্ষে বৃহস্পতিবার ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বিশেষজ্ঞরা ডায়াবেটিস বৃদ্ধির কারণ ও প্রতিরোধের উপায় নিয়ে আলোচনা করেন।
বারডেমের মহাপরিচালক অধ্যাপক মির্জা মাহবুবুল হাসান বলেন, দীর্ঘসময় বসে থাকা 'ধূমপানের মতোই ক্ষতিকর', আর ডায়াবেটিস প্রতিরোধে নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম অত্যন্ত জরুরি। তিনি বলেন, জীবনযাপনের পরিবর্তন এখন অত্যাবশ্যক। ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা প্রফেসর সাহেলা নাসরিন বলেন, সপ্তাহে কমপক্ষে ১৫০ মিনিট হাঁটা এবং সপ্তাহে তিন দিন হালকা ব্যায়াম ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে।
আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিক ফেডারেশনের তথ্য বলছে, ২০০০ সালে দেশে ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১৮ লাখ। ২০১১ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৪ লাখে। ২০২৪ সালে এই রোগে ভোগা মানুষের সংখ্যা ছাড়িয়েছে এক কোটি ৩৯ লাখ। বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটির তথ্য অনুযায়ী, কর্মস্থলে দীর্ঘ সময় বসে থাকা, অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস, মানসিক চাপ এবং পর্যাপ্ত বিশ্রামের অভাব ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বহু গুণ বাড়াচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, শহুরে কর্মজীবী জনগোষ্ঠীর প্রায় ২০-২৫ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে ডায়াবেটিস বা প্রি-ডায়াবেটিসে ভুগছেন।
বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস উপলক্ষে গতকাল শুক্রবার সকাল সাড়ে ৮টায় শাহবাগে প্ল্যাকার্ড হাতে সড়কে অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হয়। বারডেম কার পার্কিং থেকে টেনিস ক্লাবের গেট পর্যন্ত প্ল্যাকার্ড হাতে সড়কের এক পাশে দাঁড়িয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালিত হয়। ১৫ নভেম্বর আজ শনিবার সকাল ৮টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত বারডেমে বিনা মূল্যে ডায়াবেটিস নির্ণয়; এনএইচএন ও বিআইএইচএসের বিভিন্ন কেন্দ্রে। এদিন সকাল ১০টায়, বারডেম অডিটোরিয়ামে আলোচনাসভা হবে। গতকাল ১৪ নভেম্বর সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৪টা, ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালের চতুর্থ তলায় হ্রাসকৃত মূল্যে হার্ট, নিউরো ও ভাসকুলার ক্যাম্প। ১৪ ও ১৫ নভেম্বর সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা, বারডেমে, ট্রান্সফিউশন মেডিসিন অ্যান্ড ক্লিনিক্যাল হেমাটলজি বিভাগের ৩২৬ নম্বর রুমে স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি কর্মসূচি পালিত হয়।