দুর্নীতির অভিযোগে যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রতিমন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে করা মামলাটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয় বলে মন্তব্য করেছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মোমেন। তিনি বলেছেন, এটি কাউকে ছোট করার জন্য করা মামলা নয়, বরং সুনির্দিষ্ট তথ্য ও প্রমাণের ভিত্তিতে মামলা করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদক কার্যালয়ে এক অনানুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে দুদক চেয়ারম্যান এসব কথা বলেন।

টিউলিপ সিদ্দিকের আইনজীবীর পাঠানো চিঠির প্রসঙ্গে আবদুল মোমেন বলেন, চিঠিপত্র চালাচালির মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তি সম্ভব নয়। আদালতে গিয়ে আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই তাকে মামলা মোকাবিলা করতে হবে।

টিউলিপের আইনজীবীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে যে দুদক ব্রিটেনের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করছে, তা নাকচ করে দিয়ে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমার সহজ প্রশ্ন, টিউলিপ সিদ্দিকের মামলা কি এমন কোনো বিষয় যে ব্রিটেনের রাজনীতি ধসে পড়বে? এটা তো আমরা অন্যভাবেও দেখতে পারি। মামলাটি সম্পূর্ণ আইনি প্রক্রিয়ায় পরিচালিত হচ্ছে, এখানে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই।’

আবদুল মোমেন আরও বলেন, ‘টিউলিপ আমাদের কাছে একজন বাংলাদেশি নাগরিক। তার জাতীয় পরিচয়পত্র ও টিআইএন নম্বর রয়েছে। তাই বাংলাদেশে তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, তিনি দেশের আইন মেনে আদালতে উপস্থিত হবেন।’

চেয়ারম্যান জানান, টিউলিপের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে তিনটি মামলা হয়েছে এবং তিনি উপস্থিত না হলে তার অনুপস্থিতিতেই মামলার বিচার চলবে।

ব্রিটেনের রাজনীতিতে দুদকের কোনো হস্তক্ষেপ নেই, দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমাদের কার্যপরিধিতে বিদেশি রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। টিউলিপ যদি আইন না মানেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবেÍযেমনটি অন্য অভিযুক্তদের ক্ষেত্রেও হয়।’

টিউলিপের আইনজীবীকে ‘শব্দচয়নে সচেতন’ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে আবদুল মোমেন বলেন, ‘ওই সব বক্তব্যে নিজেদের দেশ ও রাজনীতিকেই ছোট করা হচ্ছে। যুক্তরাজ্যের রাজনীতি কি এতাই ভঙ্গুর যে একটি মামলার কারণে তা নড়বড়ে হয়ে যাবে।’

চেয়ারম্যান আরও জানান, ২০১৩, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের বিতর্কিত ঘটনাগুলো নিয়েও বর্তমানে কাজ করছে দুদক।

সোমাবার প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ও দুদক ব্রিটিশ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ তুলে পাঠানো এক উকিল নোটিসে টিউলিপ বলেছেন, তার সুনাম ক্ষুন্ন করাই তাদের উদ্দেশ্য। সেই সঙ্গে যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করা, বিশেষ করে তার নিজ নির্বাচনী এলাকা, তার রাজনৈতিক দল এবং দেশসেবার কাজে বিঘœ ঘটাতে তারা এসব অভিযোগ তুলেছেন, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। যুক্তরাজ্যভিত্তিক আইনি প্রতিষ্ঠান স্টেফেনসন হারউড এলএলপির মাধ্যমে এ নোটিস পাঠিয়েছেন টিউলিপ, যেখানে আগের কোনো চিঠির জবাব না পাওয়ায় অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনাও করা হয়েছে।

গত ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার পতনের পর শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা করে দুদক। কোনো কোনো মামলায় তার ভাগ্নি ব্রিটিশ এমপি টিউলিপের নামও রয়েছে। এসব মামলার বিষয়ে দুদক ও টিউলিপের মধ্যে শুরু থেকেই ‘চিঠি চালাচালি’ চলছে। তবে টিউলিপের অভিযোগ, মুহাম্মদ ইউনূস বা দুদক এখন পর্যন্ত তার কোনো চিঠির জবাব দেয়নি।

সবশেষ উকিল নোটিসে টিউলিপ বলেন, গত ১৮ মার্চ ও ১৫ এপ্রিল দুদক চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের চিঠি পাঠানো হয়। এরপর ৪ জুন একটি চিঠি পাঠানো হয় প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসকে। নোটিশে স্টেফেনসন হারউড বলছে, এখনও আমরা কিংবা টিউলিপ সিদ্দিক কোনো চিঠির জবাব পাইনি। আমরা চিঠিতে স্পষ্ট বলেছি, টিউলিপ সিদ্দিক একটি পরিকল্পিত প্রচারণার শিকার, যার নেপথ্যে রয়েছে প্রধান উপদেষ্টা ও দুদক। আমাদের চিঠিপত্রে এটা দেখিয়েছি, কেন টিউলিপের বিরুদ্ধে ওঠা প্রতিটি অভিযোগ অসত্য। ৯ জুন চার দিনের সফরে যুক্তরাজ্যে যান প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস। সেই সফরের আগে ইউনূসের সাক্ষাৎ চেয়ে একটি চিঠি পাঠানোর কথা জানান টিউলিপ। চিঠিতে তিনি ইউনূসকে হাউস অব কমন্সে মধ্যাহ্নভোজ বা বিকালের চা পানের আমন্ত্রণ জানান। প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর সেই চিঠি পাওয়ার কথা স্বীকার করলেও টিউলিপকে সাক্ষাৎ দেননি ইউনূস। সোমবারের উকিল নোটিসে ইউনূসের সাক্ষাৎ না দেওয়ার সিদ্ধান্তের সমালোচনাও করা হয়। ইউনূসের লন্ডন সফরের কথা শুনে টিউলিপ তার সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্যোগ নেন। তিনি দুদকের অভিযোগের বিষয়ে ইউনূসের সঙ্গে আলোচনা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টা দুঃখজনকভাবে টিউলিপের সেই প্রস্তাব গ্রহণে ব্যর্থ হন। বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে টিউলিপের সঙ্গে দেখা না করার যে কারণ ইউনূস তুলে ধরেছেন, তার সমালোচনাও করা হয়েছে নোটিশে। বলা হয়, বিবিসি রেডিওর সাক্ষাৎকারে ইউনূসের কাছে সুনির্দিষ্টভাবে দুটি বিষয় জানতে চাওয়া হয়। প্রথমত, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ না পেয়ে তিনি হতাশ কিনা। দ্বিতীয়ত, টিউলিপের সঙ্গে তিনি কেন সাক্ষাত করেননি। এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা অবাক করার মত অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি সেদিন বলেছিলেন যে এটি একটি আইনি প্রক্রিয়া এবং তিনি তাতে হস্তক্ষেপ করতে চান না। টিউলিপ মনে করেন, তার সঙ্গে বসার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার দুটি কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, টিউলিপের বিরুদ্ধে প্রধান উপদেষ্টা যেসব অভিযোগ তুলেছেন, সেগুলো মিথ্যা। দ্বিতীয় কারণ তুলে ধরতে গিয়ে অধ্যাপক ইউনূসের একাধিক সাক্ষাৎকারকে উদ্ধৃত করা হয়েছে, যেগুলোতে তিনি টিউলিপের বিরুদ্ধে দুর্নীতির নানা অভিযোগ তুলেছিলেন। নোটিসে বলা হয়, আমাদের প্রত্যাশা ছিল, যুক্তরাজ্যের নির্বাচিত একজন জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলার আগে প্রধান উপদেষ্টা সঠিকভাবে তথ্য যাচাই করবেন। তার এটাও মাথায় নেওয়া উচিত ছিল, দুদকের পক্ষ থেকে যখন তদন্ত চলছে বলে দাবি করা হচ্ছে, তখন টিউলিপকে নিয়ে প্রকাশ্যে সমালোচনা করাটা সমীচীন নয়। টিউলিপ বলছেন, তার সঙ্গে বসে এসব মিথ্যা অভিযোগ নিয়ে খোলামেলা আলোচনার সুযোগ পেয়েছিলেন ইউনূস। কিন্তু তিনি সেই সুযোগ গ্রহণ না করে দুদকের আড়ালে থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন, যা আমাদের কাছে টিউলিপের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের দ্বিতীয় কারণ বলে মনে হয়েছে।

দুদক চেয়ারম্যান বরাবর পাঠানো এ নোটিসের একটি অনুলিপি প্রধান উপদেষ্টাকেও পাঠানোর কথা বলা হয়েছে। নোটিসে টিউলিপ বলেন, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এখন প্রধান উপদেষ্টা ও দুদকের এসব মিথ্যা প্রচারণা থেকে সরে দাঁড়ানোর সময় এসেছে। দয়া করে এখন এটা নিশ্চিত করুন, যে দুদকের তদন্ত কার্যক্রম বন্ধ হয়েছে। আমরা স্পষ্ট করে বলছি, যদি এই চিঠি এবং আমাদের আগের চিঠিগুলোর যথাযথ জবাব ৩০ জুনের মধ্যে না দেন, তবে টিউলিপ সিদ্দিক যুক্তিসঙ্গতভাবেই বিষয়টির ইতি ঘটেছে বলে ধরে নেবেন।