প্লট আর বরাদ্দ দেবে না রাজধানী উন্নয়ন কতৃপক্ষ-রাজউক। ইতোমধ্যে সংস্থাটি এ ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এবার রাজধানীর উত্তরা ও পূর্বাচলে দেশী-বিদেশী অর্থায়ন বা ঋনে স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য সহনশীল মূল্যে ৬শ’ বর্গফুটের ১০ হাজার ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজউক। মাসিক ভাড়ার ভিত্তিতে ফ্ল্যাটের মূল্য পরিশোধ হবে।
এদিকে, রাজউকের লক্ষ্য হচ্ছে তাদের অনেক জমি অবৈধভাবে দখল করে নিয়েছে বিভিন্ন গোষ্ঠী। এসব জমি উদ্ধারে অভিযান অব্যাহ রাখা হবে। উদ্ধারের পর সেসব জমিতে স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য ফ্ল্যাট তৈরি করে বরাদ্দ দেয়া হবে।
জানতে চাইলে রাজউকের চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মো: রিয়াজুল ইসলাম দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, আমরা পারতপক্ষে এখন থেকে আর কোনভাবে প্লট বরাদ্দ দেবো না। এজন্য রাজউক নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইতিপূর্বে প্লট বরাদ্দ নিয়ে নানা পর্যায়ে নয়ছয় হয়েছে, যার কারণে রাজউকের বদনাম হয়েছে। এখন থেকে ফ্ল্যাট নির্মাণ করে বরাদ্দ দেয়া হবে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর উত্তরা তৃতীয় প্রকল্প এলাকায় ১০ একর ও পূর্বাচলের দুটি সেক্টরে ২০ একর জায়গা নিয়ে বহুতল এপার্টমেন্ট ভবন তৈরী করা হবে। এসব এপার্টমেন্টে ৬শ’ বর্গফুটের ১০ হাজার ফ্ল্যাট তৈরি করা হবে। এসব ফ্ল্যাটই স্বল্প আয়ের মানুষের মধ্যে বরাদ্দ দেয়া হবে। প্রতিটি ফ্ল্যাটে থাকবে দুটি বেডরুম, ড্রয়িং কাম ডাইনিংসহ কিচেন ও ওয়াশরুম।
রাজউক সূত্র জানায়, নতুন একটি প্রকল্পের আওতায় এই এপার্টমেন্ট নির্মাণ করতে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (আইএফসি) এর সাথে আলোচনা হয়েছে। তারা যৌথভাবে এই প্রকল্পে অর্থায়ন করবে। এজন্য ফিজিবিলিটি যাচাই বাছাই করা হচ্ছে। আগামী জানুয়ারি থেকে এই প্রকল্পের কাজ শুরু করার চিন্তাভাবনা রয়েছে বলে সুত্রটি জানায়। এই দুটি প্রতিষ্ঠানই সহজ শর্তে রাজউককে এই এপার্টমেন্ট প্রকল্প তৈরির জন্য ঋন দেবে।
সূত্রমতে, রাজউকের নিয়ম অনুসারে বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে স্বল্প আয়ের মানুষের কাছ থেকে আবেদন গ্রহণ করা হবে। এরপর লটারী করে নির্মিত ফ্ল্যাটগুলো বরাদ্দ চূড়ান্ত হবে। এর আগে যাচাই বাছাইও চলবে। মাসিক ভাড়ার টাকায় স্বল্প আয়ের মানুষেরা কিভাবে এসব ফ্ল্যাটের মালিক হতে পারেন, সে চিন্তাভাবনা করছে রাজউক। মাসিক কিস্তি হবে সহনীয় এবং দীর্ঘ মেয়াদী।
সূত্র জানায়, এপার্টমেন্ট তৈরির জন্য প্রাথমিক একটা ডিজাইন করার পর এখন সেটি পর্যালোচনা চলছে। ফ্ল্যাটগুলো কত টাকা কিস্তিতে, কতো মাসে-বছরে মূল্য পরিশোধ করা হবে- এজন্য ফিনান্সিয়াল মডেল কি হবে, তা চিন্তাভাবনা করছে রাজউক। সূত্রমতে, ভাড়ার টাকায় মাসিক কিস্তি দিয়েই ফ্ল্যাটের মালিক হওয়া যাবে।
দেশের সর্ববৃহৎ অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্প ব্যর্থ: আশুলিয়া-মিরপুর বেড়িবাঁধ রোড এলাকায় বেশ কিছু আকাশচুম্বী ভবনই রাজউকের উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্প নামে পরিচিত, যেটি দেশের সবচেয়ে বড় সরকারি অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্প। ২০১১ সালে এই অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পটি হাতে নেয় রাজউক। ২০১৬ সালের মধ্যে এ প্রকল্প শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করে তারা। ২১৪ একর জমিতে তিনটি ব্লকে ২৪০টি ১৬ তলা ভবনে ১৮ হাজার ৭৩২টি অ্যাপার্টমেন্ট তৈরির পরিকল্পনা করে তারা। সেসময় এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৯ হাজার ৩০ কোটি টাকা। তিনটি বেডরুম, একটি ডাইনিং রুম, সংযুক্ত বাথরুম সহ দুটি ড্রয়িং রুম রয়েছে এই ফ্ল্যাটগুলোতে। তবে, ২০১১ সালে নির্ধারিত পরিকল্পনার অনেক সুযোগ-সুবিধাই এখানে অনুপস্থিত। এই প্রকল্পে পাবলিক স্কুল, হাসপাতাল এবং বাজারের মতো মৌলিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত হয়নি। সেসাথে রয়েছে ফ্ল্যাট মালিকদের নানা অভিযোগ। এমনকি এখানে যারা ফ্ল্যাট পেয়েছেন তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ফ্ল্যাটগুলো ভাড়া দিয়ে রেখেছেন। উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল নিম্ন ও মধ্যম আয়ের লোকদের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে আবাসিক ফ্ল্যাট নিশ্চিত করা। কিন্তু, চিত্র ভিন্ন। ২০১৯ সালে প্রকল্পটির উপর একটি পর্যবেক্ষণকাজ চালায় ইমপ্লিমেন্টেশন অ্যান্ড ইভালুয়েশন ডিভিশন (আইএমইডি)। সরকারি প্রকল্প পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়নের জন্য সরকারের শীর্ষ সংস্থা এটি। ফ্ল্যাট মালিকদের আয় এবং আর্থিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৬৮ শতাংশ ফ্ল্যাট মালিক রয়েছেন মধ্যম আয়ের তালিকায়। অবশিষ্ট ৩২ শতাংশ ফ্ল্যাট মালিক রয়েছেন উচ্চ-আয়ের তালিকায়। প্রতিবেদনে দেখা যায়, নিম্ন আয়ের কোনো ব্যক্তি এই প্রকল্পের কোনো ফ্ল্যাটের মালিক নয়। প্রকল্পের ফ্ল্যাটের দাম নিম্নআয়ের লোকদের নাগালেরও বাইরে। শুরুতে এই প্রকল্পের প্রতি বর্গফুট ফ্ল্যাটের দাম ছিল সাড়ে তিন হাজার টাকা। অর্থাৎ, ১ হাজার ৬২০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাটের মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ৫৬ লাখ ৭০ হাজার টাকা। পরে রাজউক ফ্ল্যাটের দাম বাড়িয়ে প্রতি বর্গফুট ৪ হাজার ৮০০ টাকা নির্ধারণ করে। নির্মাণ ও প্রশাসনের খরচ মেটাতে ফ্ল্যাটের দাম বাড়ানো হয়। আবেদনকারীরা যাতে রেডিমেড ফ্ল্যাট পায় সেই লক্ষ্যেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
আইএমইডির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রকল্প হাতে নেওয়ার সময় রাজউক কোনো বেসলাইন জরিপ বা সম্ভাব্যতা সমীক্ষা পরিচালনা করেনি। কোনো সম্ভাব্যতা যাচাই না হওয়ায় এই প্রকল্পের সময় ও ব্যয় বেড়েছে। উল্লেখিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, নির্ধারিত ব্যয় ৯ হাজার ৩০ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা নির্ধারণ করেছে রাজউক। অর্থাৎ প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে ১৭ দশমিক ২৩ শতাংশ। সেইসাথে প্রকল্পের কাজ শেষ করার সময়সীমা ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত বাড়িয়েছে তারা। ফলে, প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি হওয়ায় অনেক আবেদনকারীই ব্যাংক ঋণ নিয়ে ফ্ল্যাট কিনতে বাধ্য হন। ফলে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে তাদেরকে। নিজেদের বর্তমান আবাসস্থলে বাড়ি ভাড়া দেওয়ার পাশাপাশি মাসিক ঋণের কিস্তিও দিতে হয় তাদেরকে।
যেসকল ফ্ল্যাট মালিকদের নিজস্ব গাড়ি নেই তাদের বেশিরভাগই এলাকায় পর্যাপ্ত অবকাঠামোর অভাবে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। কোনো মার্কেট, সরকারি স্কুল বা হাসপাতাল না থাকায় তাদের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য, জামা-কাপড়, পড়ালেখা, স্বাস্থ্যসেবার জন্য সবসময় উত্তরা বা মিরপুর যেতে হয়। ফলস্বরূপ, যাতায়াতের জন্য তাদের অতিরিক্ত টাকা খরচ হয়। এ কারণেই ব্যর্থ দেশের প্রথম এপার্টমেন্ট প্রকল্পটি।