জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে ভেঙে দুই ভাগে বিভক্ত করার প্রতিবাদে তিন দিনের কলম বিরতি পালন করছেন সংস্থাটির কাস্টমস, ভ্যাট ও আয়কর শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। অনতিবিলম্বে এটি পুনর্বিবেচনা না করা হলে কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা। কর্মসূচির অংশ হিসেবে গতকাল বুধবার সকাল থেকে সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অফিসে অবস্থান করলেও কার্যক্রম বন্ধ রাখেন। দেশব্যাপী সকল কাস্টমস হাউজ, শুল্ক স্টেশন এবং কর অঞ্চলে কর্মবিরতি পালন করা হয়। এতে বাজেট শাখা, আন্তর্জাতিক যাত্রী সেবা এবং রফতানি কার্যক্রম শাখা ব্যতীত এনবিআরের সকল শাখার কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। আজও সারাদেশে কর্মবিরতি পালন করা হবে।
এর আগে গত সোমবার দিবাগত রাতে দেশের ঐতিহ্যবাহী সংস্থা এনবিআর বিলুপ্ত করে বহুল আলোচিত রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ জারি করেছে সরকার। একই সঙ্গে বিলুপ্ত করা হয়েছে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ। আইএমএফের শর্ত মানতে আয়কর ও কাস্টমস ক্যাডার কর্মকর্তাদের মতামত উপেক্ষা করে গত সোমবার দিবাগত রাতে সরকারি এ প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
‘এনবিআর ঐক্য পরিষদ’ প্ল্যাটফর্ম জানায়, এনবিআর সংস্কারকে স্বাগত জানাচ্ছি। তবে এনবিআর সংস্কার পরামর্শক কমিটির প্রতিবেদন জনসম্মুখে না এনে অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। যা যুক্তিসংগত নয়। অনতিবিলম্বে এটি পুনর্বিবেচনা না করা হলে কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারিও দেন তারা।
অতিরিক্ত কর কমিশনার সাধন কুমার ক-ু বলেন, গতকাল বুধবার সকাল থেকে আমাদের এ কলমবিরতি শুরু হয়েছে। দাবি না আদায় হলে তিন দিন পর্যন্ত এ কলমবিরতি চলবে। এরপরও দাবি আদায় না হলে আমরা আলোচনা করে নতুন কর্মসূচি দেব। সাধন কুমার আরও বলেন, আমাদের দাবির বিষয়ে এখন পর্যন্ত সরকারের ওপর মহল থেকে কোনো সাড়া পাইনি। আশা করি, গণমাধ্যমের মাধ্যমে সরকারের ওপর মহল এরই মধ্যে আমাদের দাবির বিষয়টি জেনেছেন। ফলে তাদের থেকে ভালো সাড়া পাব বলে আশা করছি।
কর্মবিরতির মধ্যে এনবিআরের তিন ধরনের কার্যক্রম চালু রাখা হয়েছে। এগুলো হলো আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা, বাজেট ও রপ্তানি সংক্রান্ত কার্যক্রম।
এ বিষয়ে দ্বিমত করে এনবিআরের এক সদস্য গণমাধ্যমে বলেন, এনবিআরের কোথাও বিরতি চলছে না। আমি তো আমার অফিসারদের সঙ্গে কাজ করছি। কোথায় বিরতি চলছে আমাকে জানান। কর্মকর্তাদের অন্যদিকে পরিচালনার চেষ্টা চলছে বলে দাবি করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই এনবিআর সদস্য। তিনি বলেন, কর্মকর্তাদের কেউ অন্যদিকে পরিচালনা করার চেষ্টা করছেন। তাদের স্বার্থের ব্যাঘাত কোথাও হয়নি। আজকের মধ্যেই দেখবেন, সব ঠিক হয়ে যাবে।
জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন কর অঞ্চল ও কাস্টমস হাউসে কলম বিরতি পালন করা হয়েছে। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এনবিআর ভবনে সরেজমিনে দেখা যায়, কর্মকর্তারা যথারীতি দপ্তরে এসেছেন। তবে কোনো দাপ্তরিক কাজ করেন নি তারা। কেবল বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এনবিআরের কর, শুল্ক ও মূসক নীতি বিভাগের কর্মকর্তারা কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন। ফ্লোরগুলো ফাঁকা ছিল, লোকজনের আনাগোনা ছিল কম।
আয়কর ও শুল্ক ক্যাডারের কর্মকর্তারা বলেন, পৃথিবীর সব দেশের নিজস্ব রাজস্ব আদায়কারী সংস্থা রয়েছে। অথচ কোনো ধরনের সমীক্ষা ছাড়াই এনবিআর বিলুপ্ত করতে অধ্যাদেশ চূড়ান্ত করা হচ্ছে। এ সিদ্ধান্তের ফলে অংশীজন বা ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়বে, তা নিয়ে কোনো আলোচনাই করা হয়নি। একটি বিশেষ ক্যাডার নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে একতরফাভাবে খসড়া অধ্যাদেশ তৈরি করেছে। এ ক্ষেত্রে কাস্টমস ও আয়কর ক্যাডারের মতামত তো দূরের কথা, অর্থনৈতিক পরিস্থিতিবিষয়ক শ্বেতপত্র কমিটি বা এনবিআর সংস্কারবিষয়ক পরামর্শক কমিটির সুপারিশ আমলে নেওয়া হয়নি। খসড়া অধ্যাদেশে নানা রকমের অসংগতি আছে। এসব ত্রুটি-বিচ্যুতি চিহ্নিত না করে এবং সমীক্ষা ছাড়া এনবিআর বিলুপ্ত করলে রাজস্ব আদায় কার্যক্রম চরমভাবে ব্যাহত হবে। এতে দেশের অর্থনীতি ধসে পড়তে পারে।
এর আগে কাস্টমস ও আয়কর ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশন থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশের খসড়ায় কর্মকর্তাদের মতামত প্রতিফলিত হয়নি। বিভাগ দুটিতে কাস্টমস ও আয়কর ক্যাডারের জন্য পদ সংরক্ষিত না রেখে রাজস্বের কাজে অভিজ্ঞতা নেই এমন কর্মকর্তা পদায়নের সুযোগ রাখা হয়েছে। এতে একদিকে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা কাজে অভিজ্ঞ নয় এমন কর্মকর্তা পদায়নের মাধ্যমে রাজস্ব প্রশাসনের দক্ষতা, গতিশীলতা এবং কার্যকারিতা বিঘিœত হবে, অন্যদিকে, এনবিআরে কর্মরত দুটি ক্যাডারের কাজের ক্ষেত্র ও পদোন্নতির সুযোগ মারাত্মকভাবে ক্ষুন্ন হবে।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম গণমাধ্যমকে বলেন, এটা হওয়া উচিত ছিল এবং হয়েছে। তবে সরকারি প্রতিষ্ঠানে সুযোগও তৈরি হয় আবার সংকট সৃষ্টি হয়। সে ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের উদ্বিগ্ন হওয়া স্বাভাবিক। তবে আশা করব, এই পরিবর্তনের ক্ষেত্রে রাজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরি, পদোন্নতি ও নতুন দুটি বিভাগের শীর্ষ পদে আসীন হওয়ার ক্ষেত্রে সংকট তৈরি না হয়, সে বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।
উল্লেখ্য, ১৯৯৩ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) এনবিআরকে নীতি ও প্রশাসন বিভাগে বিভক্ত করতে পরামর্শ দিয়েছিল। ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিশ্বব্যাংকও চাপ দিয়েছিল। কিন্তু তখন তা বেশি দূর এগোয়নি। এর মধ্যে গত ৫ আগস্ট অভ্যুত্থানে ক্ষমতার পালাবদলের পর দেশের হাল ধরা অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যবস্থা সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। এরই অংশ হিসেবে এনবিআর সংস্কারে পাঁচ সদস্যের একটি পরামর্শক কমিটি গঠন করে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি)। এতে প্রশাসন ক্যাডার থেকে আসা এনবিআরের সাবেক দুই চেয়ারম্যান, শুল্ক ও আয়কর ক্যাডার থেকে আসা রাজস্ব নীতি প্রণয়ন ও আদায় বিভাগের দু’জন সাবেক সদস্যকে এ কমিটিতে রাখা হয়। গত ডিসেম্বরে ‘রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা’ নামে আলাদা বিভাগ করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে এ কমিটি অর্থ উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়।