গাজায় চলমান দখল, গণহত্যা, জাতিগত নিধন ও ধ্বংসযজ্ঞের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে ঢাকায় ‘মার্চ ফর গাজা’ সমাবেশ কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে অংশ নেন বিভিন্ন ওলামায়ে কেরাম এবং সাধারণ মুসল্লিরা। সেখানে অবিলম্বে গাজায় ইসরাইলের গণহত্যা বন্ধ করা, জায়নবাদী ইসরাইলের গণহত্যার বিচার আন্তর্জাতিক আদালতে নিশ্চিত করার দাবিসহ দশ দফা ঘোষণা করা হয়েছে।

গতকাল শুক্রবার বাদ জুমা জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে মুসল্লিরা একত্রিত হন। আওলাদে রসূল চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের খতিব আল্লামা সাইয়েদ তাহের জাবের আল মাদানীর সভাপতিত্বে ও সম্মিলিত ইসলামী দলসমূহের সমন্বয়ক ড. মাওলানা খলিলুর রহমান মাদানীর সঞ্চালনায় মার্চ ফর গাজা কর্মসূচির শুরুতে আরবি, ইংরেজি ও বাংলায় ঘোষণাপত্র ও অঙ্গীকারনামা পাঠ করা হয়। আরবিতে ঘোষণাপত্র পাঠ করেন আওলাদে রসূল আল্লামা তাহের জাবের আল মাদানী, ইংরেজিতে ঘোষণাপত্র পাঠ করেন মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ভিসি প্রফেসর ড. আব্দুর রব এবং বাংলায় ঘোষণাপত্র পাঠ করেন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জনাব জাহিদুল ইসলাম।

মিছিলে নেতৃত্ব দেন যথাক্রমে আল্লামা তাজুল ইসলাম, মাওলানা আবু তাহের জেহাদী, অধ্যক্ষ মাওলানা যাইনুল আবেদীন, অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন, মাওলানা আবদুল হালিম, মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদী, ড. মাওলানা আবুল কালাম আজাদ বাসার, মুফতি ফখরুল ইসলাম, ড. মাওলানা আব্দুল মান্নান, জনাব কামাল উদ্দিন, অধ্যক্ষ মাওলানা মোশারফ হোসাইন, ড. মাওলানা মিম আতিকুল্লাহ, অধ্যক্ষ শহিদুল ইসলাম ও ছাত্র নেতা আজাদ প্রমুখ।

ঘোষণাপত্র পাঠ শেষে বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেট ও জাতীয় স্টেডিয়ামের কর্নার থেকে লাখো জনতা গাজার মজলুম মানুষের মুক্তির জন্য মার্চ করে জিপিও, পল্টন জিরো পয়েন্ট, পল্টন মোড়, বিজয়নগর, নাইটেঙ্গল ও কাকরাইল মোড় হয়ে শান্তিনগর এসে এক সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের মাধ্যমে মিছিলটি শেষ হয়। এ সময় গাজাবাসীসহ বাংলাদেশ ও বিশ্ববাসীর জন্য দোয়া ও মোনাজাতের মাধ্যমে মার্চ ফর গাজা কর্মসূচি সমাপ্ত হয়।

মজলুম ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে মিছিলের পূর্বে পঠিত ঘোষণাপত্রে বলা হয়ঃ

জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি

যেহেতু গাজায় ইতোমধ্যে ৬২ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে; এর মধ্যে ১৮ হাজার শিশু এবং সেখানকার ৮০ শতাংশের বেশি ভবন ধ্বংস হয়েছে, হাসপাতাল, স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয় মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। এবং জাতিসংঘ নিজেই বলেছে, 'গাজা আজ মানবতার কবরস্থানে পরিণত হয়েছে'। এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ইসরাইলি নেতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের দায়ে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে এবং আন্তর্জাতিক বিচার আদালত বলেছে, 'ইসরাইলকে গণহত্যা বন্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে'। পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর অস্ত্র ও অর্থ সাহায্য এই হত্যাযজ্ঞকে দীর্ঘস্থায়ী করেছে।

সেহেতু আমরা ঘোষণা করছি,

১. অবিলম্বে গাজায় ইসরাইলের গণহত্যা বন্ধ করতে হবে।

২. জায়নবাদী ইসরাইলের গণহত্যার বিচার আন্তর্জাতিক আদালতে নিশ্চিত করতে হবে।

৩. শুধু যুদ্ধ বিরতি নয়, গণহত্যা বন্ধে কার্যকর ও সম্মিলিত পদক্ষেপ নিতে হবে।

৪. ১৯৬৭ সালের পূর্ববর্তী ভূমি ফিরিয়ে দিতে বাধ্যবাধকতা তৈরি করতে হবে।

৫. পূর্ব জেরুজালেমকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিতে হবে।

৬. ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণ, নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত করতে হবে।

৭. ইসরাইলি পণ্য, প্রযুক্তি, অস্ত্র ও বিনিয়োগের ওপর বৈশ্বিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে।

৮. গাজার অবরোধ ভেঙে খাদ্য, পানীয়, ঔষধ ও মানবিক সহায়তা প্রবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

৯. জায়নিস্ট অর্থনীতিকে সহযোগিতা করা বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে কালো তালিকাভুক্ত করতে হবে।

১০. আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও গণমাধ্যমকে গাযায় প্রবেশাধিকার দিয়ে গণহত্যার সত্য বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরতে হবে।

মুসলিম উম্মাহর নেতৃবৃন্দের প্রতি : যেহেতু ফিলিস্তিন শুধু একটি জমিনের নাম নয়, এটি আমাদের অস্তিত্বের প্রতীক, উম্মাহর আত্মপরিচয়। গাজার রক্তস্রোত আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতার সাক্ষী হয়ে আছে। ইসরাইল আজও সেই অবৈধ দখলদার শক্তি, যে উম্মাহর প্রথম কিবলা আল-আকসাকে মুছে ফেলার শয়তানি প্রচেষ্টায় লিপ্ত। অথচ বিশ্ববাসী, বিশেষত মুসলিম ও আরব দুনিয়া তার কাক্সিক্ষত ভূমিকা পালন করতে পারছে না।

সেহেতু আমরা মুসলিম বিশ্বের নেতৃবৃন্দ ও ওআইসি’র প্রতি ঘোষণা করছি

১. ইসরাইলের সঙ্গে সকল কূটনৈতিক, সামরিক, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক অবিলম্বে ছিন্ন করতে হবে।

২. মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে ইসরাইলি পণ্য ও কোম্পানির বিরুদ্ধে বয়কট কর্মসূচি জোরদার করতে হবে।

৩. গাজার মজলুম জনগণের পাশে ঔষধ, খাদ্য, আশ্রয় ও মানবিক সহায়তা দ্রুততম সময়ে পৌঁছে দিতে হবে।

৪. আন্তর্জাতিক আদালতে যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়ায় মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে সম্মিলিতভাবে অংশগ্রহণ করতে হবে।

৫. ঙওঈ কে আরও কার্যকর ও ঐক্যবদ্ধ কণ্ঠে ফিলিস্তিন ইস্যুকে আন্তর্জাতিক মহলে উত্থাপন করতে হবে।

৬. মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে স্পষ্টভাবে ঘোষণা করতে হবে– ফিলিস্তিন ইস্যুতে ভিন্নমত বা দ্বিধাদ্বন্দ্বের কোনো স্থান নেই; এটি উম্মাহর অস্তিত্বের সংগ্রাম।

৭. মুসলিম দেশগুলোকে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে নিপীড়িত মুসলিম ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর অধিকারের পক্ষে অবস্থান নিতে হবে।

বাংলাদেশের সরকারের প্রতি: যেহেতু বাংলাদেশ একটি স্বাধীনতা সংগ্রামী রাষ্ট্র, যার নৈতিক অবস্থান সবসময় মজলুমের পাশে এবং জনগণ ধারাবাহিকভাবে গাজার পাশে দাঁড়িয়েছে;

সেহেতু আমরা বাংলাদেশের সরকারের প্রতি দাবি জানাই-

১. বাংলাদেশের কোনো সরকারি, আধা-সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ইসরাইলি বা জায়নিস্ট সংশ্লিষ্ট কোম্পানির চুক্তি বা বাণিজ্য থাকলে তা বাতিল করতে হবে।

২. গাজার জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে জরুরি চিকিৎসা সহায়তা, ত্রাণ এবং পুনর্গঠনে সরাসরি অবদান নিশ্চিত করতে হবে।

৩. ইসরাইলের বিরুদ্ধে ওঈঈ ও ওঈঔ-এর প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের ভূমিকা আরও জোরদার করতে হবে।

৪. জাতীয় অর্থনীতি ও আমদানি নীতিতে ইসরাইলি কোম্পানির পণ্য ও বিনিয়োগ নিষিদ্ধ করতে হবে।

৫. পাঠ্য পুস্তকে ফিলিস্তিন ও আল-আকসার ইতিহাস অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

আমাদের অঙ্গীকার:

যেহেতু আল-কুদস আমাদের অস্তিত্বের অংশ, আমাদের বিশ্বাসের প্রাণকেন্দ্র। বাইতুল মাকদিসের মুক্তি কেবল এক ইতিহাসের অংশ নয়, এটি আমাদের প্রজন্মের দায়িত্ব ও দায়িত্বশীলতার পরীক্ষা। আজ যদি আমরা জেগে না উঠি, প্রস্তুত না হই; তবে আমাদের অবস্থার পরিবর্তন হবে না। আমরা আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে এ অন্যায়ের ধারাবাহিকতার শিকার হতে দিতে পারি না।

সেহেতু আমরা প্রতিজ্ঞা করছি–

১. আমরা বয়কট করব প্রত্যেক সেই পণ্য, কোম্পানি ও শক্তিকে; যারা ইসরাইলকে টিকিয়ে রাখে।

২. আমরা আমাদের প্রজন্মকে প্রস্তুত করব, যারা ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর প্রতীক ও ঐতিহ্য রক্ষা করবে।

৩. আমরা আমাদের সন্তানদের গড়ে তুলব, যারা জান-মালের ত্যাগে দ্বিধা করবে না।

৪. আমরা বিভক্ত হব না, ঐক্যবদ্ধ থাকব।

৫. আমরা অনলাইন ও বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্মে ফিলিস্তিনের লড়াইকে শক্তিশালী করব।

৬. বিশ্বের কোনো প্রান্তকে আমরা নতুন গাজা হতে দেবো না।