ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে ‘ইতিহাসের সেরা ভোট’ উপহার দেওয়ার প্রত্যয় রাখলেও সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে দেখছে এএমএম নাসির উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ লক্ষ্যে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের নৈতিকতা, পেশাদারত্ব ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে কাজ করার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। একই সঙ্গে ‘বিতর্কিত ভোটের’ জন্য সাবেক দুই সিইসিকে কারাবন্দি ও জুতার মালা দেওয়ার ঘটনায় উদ্বেগের বিষয়টিও তুলে ধরেন নির্বাচন কমিশনাররা।

গতকাল শুক্রবার আগারগাঁওয়ে নির্বাচনী প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে (ইটিআই) ‘ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে দুই দিনব্যাপী কোর প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ’ কর্মসূচি উদ্বোধন করেন সিইসি। এসময় চার নির্বাচন কমিশনার, ইসি সচিব ও ইটিআই মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

এসময় প্রধান নির্বাচন কমিশনার ভোটগ্রহণে সম্পৃক্ত নির্বাচন কর্মকর্তাদের আইন, বিধি জানার পাশাপাশি নৈতিকতা, সততার সঙ্গে নিরপেক্ষতা বজায় রাখার নির্দেশনা দেন। কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে মাঠ পর্যায়ে যেন সঠিকভাবে প্রশিক্ষণের প্রতিফলন ঘটে সে বিষয়ে নজর রাখার তাগিদ দেন এবং এআইয়ের অপব্যবহার রোধে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

প্রশিক্ষণার্থীদের সতর্ক করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, যোগাযোগ ভেঙে পড়া মানেই সবকিছু ভেঙে পড়া। মাঠ পর্যায়ে দায়িত্ব পালনের সময় বার্তা যেন সঠিকভাবে পৌঁছায়, সেদিকে মনোযোগী হতে হবে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে যে অর্থ ব্যয় করা হয়, সেটিকে ব্যয় নয় বরং বিনিয়োগ হিসেবে দেখা উচিত। আপনি যখন স্বাস্থ্য বা শিক্ষায় টাকা খরচ করেন, আসলে সেটি বিনিয়োগ। একইভাবে প্রশিক্ষণে ব্যয়ও একটি দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ।

যোগাযোগ ভেঙে পড়ার ঝুঁকি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে নেওয়া এক প্রশিক্ষণের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন। সেখানে এক ছোট বার্তা কয়েক ধাপ পেরিয়ে পৌঁছাতে গিয়ে বিকৃত হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নির্বাচনেও একই ঝুঁকি থাকে। তাই মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে এবং সঠিকভাবে নোট নিতে হবে। পেছনের সারিতে বসা প্রশিক্ষণার্থীরা প্রায়ই ঝিমায়। এতে যোগাযোগ ভেঙে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাই সতর্ক থাকতে হবে।

সিইসি বলেন, নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক ও আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ তো আছেই, এর পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়াজনিত নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে ভুয়া ও বিভ্রান্তিকর তথ্য মোকাবিলায় নির্বাচন কমিশন আলাদা সেল গঠন করবে।

এ সময় প্রশিক্ষকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আইন-কানুন শেখানোর পাশাপাশি ভুয়া তথ্য প্রতিরোধের দায়িত্বও নিতে হবে এবং এ বার্তা প্রত্যন্ত অঞ্চলেও পৌঁছে দিতে হবে।

নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ বলেন, আমার সহকর্মী বলে গেলেন নির্বাচনটা ঝুঁকিপূর্ণ হবে। এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে জুতার মালা পরানো হয়েছে। আরেকটু যোগ করে যদি বলি-আরেকজন প্রধান নির্বাচন কমিশনারও বর্তমানে কারান্তরে রয়েছেন, দুঃখজনক। এ পরিস্থিতির জন্য কে দায়ী- গভীর বিশ্লেষণের দরকার। আশা করি, একসময় বিশ্লেষণ হয়েও যাবে, গবেষণাও হয়ে যাবে। আমরা যারা আজ দাঁড়িয়ে আছি, আজ যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত তারা কী করবো, হোয়াটস অ্যা মেকানিজম? সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করার বিষয়ে ইসির ভূমিকা তুলে ধরেন এ নির্বাচন কমিশনার।

নির্বাচন কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, নিজের দায়িত্বটাকে আইনানুগভাবে করতে হবে। কারও দিকে না তাকিয়ে আইন মেনে কাজ করতে হবে। সংবিধান ও আইন মেনে কাজ করলেই সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি হবে। কে কী করলে, কী ভাবলো, চিন্তা করলে- সে দিবে ভ্রুক্ষেপ করার প্রয়োজন নেই।

নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হবে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তিনি জানান, ইসির প্রধান দায়িত্ব একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করা। এর বিকল্প কোনো পথ নেই।

নিজেদেরকে গণঅভ্যুত্থানের ফসল উল্লেখ করে আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু করার বিষয়ে সবার দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেন ইসি আনোয়ারুল ইসলাম সরকার। তিনি বলেন, ভালো নির্বাচন আমাদের কমিটমেন্ট হবে। এই যে এত রক্ত গেলো, এত প্রাণ গেলো, এত বছর মানুষের দুঃখ-কষ্ট; যদি সঠিক নির্বাচন হতো এগুলো কিন্তু হতো না। আজকে নির্বাচন নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের গলায় যদি জুতার মালা হয় এটির অংশীদার কিন্তু আপনি, মনে করবেন না যে আপনিও না।

নির্বাচন কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, আবারও বলছি, আবারও অনুরোধ করছি- এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেন যে প্রশিক্ষণের মধ্যে থাকবে কমিটমেন্ট। যে প্রশিক্ষণের মধ্যে থাকবে সুন্দর সঠিক নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই।

নির্বাচনে কোনো ধানাই-পানাই হবে না বলে মন্তব্য করে এ নির্বাচন কমিশনার বলেন, জীবন চলে যেতে পারে; কিন্তু নির্বাচনে ফাঁকিবাজি, ধোঁকাবাজি করা যাবে না। কমিশন ও মাঠপর্যায়ের সবাইকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে।

প্রবাসীদের ভোট পদ্ধতি ও আইন-কানুন বিষয়ে ভালো প্রশিক্ষণ দেওয়ার দাবি জানান নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ। তিনি বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন হবে বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি দৃষ্টান্ত। এজন্য সবার প্রতি সৎভাবে ও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান তিনি।

ইসি সচিব আখকার আহমেদের সভাপতিত্বে এ অনুষ্ঠান শুরু হয়। এতে ইইটিআই মহাপরিচালক এসএম আসাদুজ্জামান জানান, আগামী চার মাসে ভোটগ্রহণ সম্পৃক্ত ১০ লাখেরও বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও লোকবল প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।