জনঘনত্ব, ফ্লোর এরিয়া রেশিও (ফার) ও ভবনের নকশা অনুমোদন প্রক্রিয়া-এই তিন বিষয় নিয়ে অংশীজনের মধ্যে যে বিভক্তি-দ্বন্ধ দেখা দিয়েছিল, তার একটা সমাধান হয়েছে দীর্ঘ টানাপোড়েনের পর। দফায় দফায় বৈঠকের পর অংশীজনদের মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে এখন চলছে ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান-ড্যাপ (বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা) এর খসড়া চূড়ান্ত প্রস্তাবনা তৈরির কাজ। এই কাজটি করছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-রাজউক। কুরবানি ঈদের ছুটির পরই প্রস্তাবনাটি গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। সেখান থেকে যাবে ড্যাপ সংশোধন বিষয়ক উপদেষ্টা কমিটিতে। উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে ড্যাপ চূড়ান্তসহ অনুমোদন হওয়ার পরই হবে গেজেট। জুনের মধ্যেই ড্যাপ গেজেট আকারে প্রকাশিত হবে, জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র।
জানতে চাইলে রাজউক চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মো: রিয়াজুল ইসলাম দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, জুনের মধ্যেই চূড়ান্ত ড্যাপের সংশোধিত গেজেট প্রকাশিত হবে। এ নিয়ে কাজ করছে রাজউক। তিনি জানান, পরিবেশ সংরক্ষনের ওপর গুরুত্ব দিয়েই ড্যাপ চূড়ান্ত করা হচ্ছে।
জানা গেছে, ড্যাপের খসড়া চূড়ান্ত প্রস্তাবনা এবং ঢাকা ইমারত বিধিমালার সংশোধনী প্রস্তাবনা ড্যাপ সংশোধন বিষয়ক উপদেষ্টা কমিটিতে অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করতে রাজউককে দায়িত্ব দেয়া হয়। এই দায়িত্ব পাওয়ার পর সংস্থাটি গত কয়েকদিনে একাধিকবার অংশীজনদের নিয়ে বৈঠকে মিলিত হয়। প্রতিটি বৈঠকেই অংশীজনদের মধ্যে একাধিক বিষয়ে মতদ্বৈততা সৃষ্টি হয়। সর্বশেষ গত ২২ মে বৃহস্পতিবার রাজউকে অনুষ্ঠিত বৈঠকে মতদ্বৈততা থাকা বিষয়গুলো নিয়ে অংশীজনদের মধ্যে মতৈক্য সৃষ্টি হয়। এর ভিত্তিতেই ড্যাপ সংশোধন বিষয়ক উপদেষ্টা কমিটিতে ড্যাপের খসড়া চূড়ান্ত প্রস্তাবনা তৈরীর কাজটি এখন করছে রাজউক। এছাড়া, গৃহায়ন ও গনপূর্ত মন্ত্রনালয়ও অংশীজনদের নিয়ে একাধিক বৈঠক করে ড্যাপের খসড়াকে এগিয়ে দেয়। সৃষ্ট মতদ্বৈততা দূরীকরনে ভুমিকা রাখে।
রাজউকের সংশ্লিষ্ট একাধিক সুত্র জানায়, সর্বশেষ তিনটি বিষয়ের ওপর অংশীজনদের মতদ্বৈততা ছিল। এই তিনটি বিষয় হলো জনঘনত্ব, ফার ও নকশা অনুমোদন প্রক্রিয়া কি হবে। এই তিনটি বিষয়ের ওপর সর্বশেষ বৈঠকে মতৈক্য হয়েছে বলে সুত্রের দাবী। সুত্র মতে, জনঘনত্ব ও ফারের বিষয়টি রিভাইজ (পূণবিবেচনা) করার ব্যাপারে সকল পক্ষই বৈঠকে একমত হয়। নকশা অনুমোদন প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে সেটি করা হবে ইলেকট্রনিক সিস্টেমে স্ট্রাকচারাল ড্রয়িং করে।
বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে অংশীজনদের মধ্যে অন্যতম সদস্য প্রতিষ্ঠান রিয়েল এস্টেট হাউজিং এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) এর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট লিয়াকত আলী ভুইয়া দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, আমাদের মধ্যে সবাই একমত হয়েছেন ড্যাপের সংশোধনী নিয়ে। এখন আর কোন পক্ষেরই অভিযোগ নেই। তাই ড্যাপের খসড়া চূড়ান্ত হতে আর কোন বাধা নেই। এখন খসড়াটি আগামী ১৫ দিনের মধ্যেই উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে চূড়ান্ত হয়ে গেজেট আকারে প্রকাশিত হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। গেজেট হলেই আবাসন খাতের দীর্ঘদিনের স্থবিরতা কেটে উঠবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
জানা গেছে, রাজধানী ঢাকা শহরকে পরিকল্পিত, বাসযোগ্য এবং পরিবেশবান্ধব করে গড়ে তুলতে মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করে রাজউক। এই মহাপরিকল্পনার নাম বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ড্যাপ। এটি ২০২২ সালে গেজেটভুক্ত হওয়ার ১ বছরের মাথায় কারিগরি মতামত উপেক্ষা করে আবাসন ব্যবসায়ীদের চাপে ২০২৩ সালে একদফা সংশোধন করা হয়। এরপর রাজউক মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে থাকলেও গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিদ্যমান ড্যাপকে বৈষম্যবিরোধী আখ্যা দিয়ে আবাসন ব্যবসায়ীরা আবারও সংশোধনের দাবি তোলে। নানামুখী চাপে রাজউক আবাসন ব্যবসায়ীদের দাবির পক্ষে অবস্থান নিয়ে ড্যাপ সংশোধন প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যায়। এই প্রক্রিয়ার প্রথম পর্বে নগর পরিকল্পনাবিদদের সঙ্গে রাখলেও মাঝপথে তাদের বাদ দিয়ে কার্যক্রম এগিয়ে নেয় রাজউক। নগর পরিকল্পনাবিদদের বাদ দিয়ে ঢাকার মহাপরিকল্পনা সংশোধনের এই প্রক্রিয়াকে অস্বচ্ছ দাবি করে দফায় দফায় সংবাদ সম্মেলন এবং সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দেয় পরিকল্পনাবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউ অব প্লানার্স (বিআইপি)। এর বিপক্ষে সংবাদ সম্মেলন করেছে আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব)। পরে আবাসন ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি আন্দোলন জোরদারে গঠিত হয়েছে ঢাকা সিটি ভূমি মালিক সমিতি। তারাও সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধন এবং সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে স্মারকলিপি দেওয়াসহ নানাবিধ কর্মসূচি পালন করে।
নানাভাবেই ড্যাপ সংশোধন কেন্দ্র করে নগর পরিকল্পনাবিদ এবং আবাসন ব্যবসায়ীদের মধ্যে মতপার্থক্য তৈরি হয়। এতে ড্যাপ অনুযায়ী বাসযোগ্য শহর গড়ার নানা আয়োজনের বাস্তবায়ন কার্যত আটকে যায়। এই মহাপরিকল্পনা গেজেটভুক্ত হওয়ার আড়াই বছর পার হলেও বাস্তবায়নে তেমন কোনো অগ্রগতি ছিল না। ড্যাপ সংশোধন ইস্যুতে নগর পরিকল্পনাবিদ এবং আবাসন ব্যবসায়ীদের অবস্থান মুখোমুখি হয়ে নানা যুক্তি দিতে থাকে দুপক্ষই। ফলে সরকার সকল কাউকেই বাদ দিয়ে ড্যাপ চূড়ান্ত করতে চায়নি। তাই সকল অংশীজনদের মতামতকে গুরুত্ব দিতেই ড্যাপ সংশোধন বিষয়ক উপদেষ্টা কমিটি গঠন করে সরকার। এই কমিটির সর্বশেষ বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় গত ১৯ মার্চ। বৈঠকে ড্যাপ নিয়ে তিনটি সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়। সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই রাজউক সকল অংশীজনদের নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করে ড্যাপের খসড়া চূড়ান্তকরনের দিকে এগোয়।
জানা গেছে, ভূমি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় বেশির ভাগ উপদেষ্টাই ভবনের উচ্চতা শিথিলের বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন। এ ছাড়া ড্যাপ সংশোধনে নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপিতদের মতামতকে কেন গুরুত্ব দেওয়া হয়নিÑ এমন প্রশ্নও ওঠে। আইন, ভূমি, গৃহায়ন, জ্বালানি, সড়ক পরিবহন, পরিবেশ ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির ৭ সদস্য সভায় অংশ নেন।
সূত্র মতে, গত বছরের আগস্ট থেকে ‘ড্যাপ’ কার্যকর করা হয়। ঢাকা মহানগরসহ আশপাশের ১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে এই মহাপরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু শুরু থেকে ড্যাপ (২০২২-৩৫) নিয়ে বিতর্ক ও সমালোচনা চলছে। আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) নেতারা শুরু থেকেই বলে আসছেন, নতুন ড্যাপ বৈষম্যমূলক এবং অস্পষ্ট। আবাসনশিল্পে যে সংকট চলছে তাতে প্রধান সমস্যা এই ড্যাপ। এটি আবাসন খাতের জন্য মরণফাঁদ। ‘ড্যাপ’ এর কারণে দেশের অর্থনীতি ঝুঁকির মুখে পড়েছে। আবাসন খাত সংশ্লিষ্ট লিংকেজ শিল্পগুলোকে উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। নকশা অনুমোদন কমে গেছে এবং আবাসন খাতে স্থবিরতা নেমে এসেছে। ফলে খাতের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে বেকার হয়েছে লক্ষাধিক চাকরিজীবী। ভবনের কম আয়তন এবং উচ্চতা কম হওয়ার গত আবাসন ব্যবসায়ী ও জমির ক্ষতিগ্রস্ত মালিকরা ইমারত নির্মাণ বন্ধ রেখেছে। অর্থনীতিতে ১৫ শতাংশ অবদান রাখা এই খাতে রড-সিমেন্টের চাহিদা কমায় উৎপাদন কমিয়ে দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো। এর ফলে দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হওয়ার আশংকা করেছেন অনেকে। ফলে অর্থনীতি আরো ঝুঁকির মুখে পড়বে।
ড্যাপ সংশোধনের পক্ষে যুক্তি হিসেবে ঢাকা শহরের ভূমির মালিকদের সমন্বয়ক ড. দেওয়ান এম এ সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘ড্যাপে ঢাকা শহরের মাত্র ২০ শতাংশ এলাকাকে পরিকল্পিত এরিয়া হিসেবে দেখানো হয়েছে। সেখানে সুউচ্চ ভবন নির্মাণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। অবশিষ্ট ৮০ শতাংশ এলাকাকে অপরিকল্পিত এরিয়া ট্যাগ দিয়ে ভবনের উচ্চতা ও আয়তন হ্রাস করে দেওয়া হয়েছে। যেন ঢাকা শহরের প্রকৃত ভূমির মালিকেরা কোনোভাবে ভবন নির্মাণ করতে না পারেন। যে কারণে জমির মালিকেরা নতুন করে ভবন-বাড়ি নির্মাণ বন্ধ রেখেছেন।’
বর্তমান ড্যাপে যা আছে : বর্তমান ড্যাপে ভূমি পুনর্বিন্যাস, উন্নয়নস্বত্ব, প্রতিস্থাপন পন্থা, ভূমি পুনঃউন্নয়ন, ট্রানজিটভিত্তিক উন্নয়ন, উন্নতিসাধন ফি, স্কুল জোনিং ও ডেনসিটি জোনিং আছে। রাজউকের অন্তর্ভুক্ত এক হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে মোট ৪৬৮টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে। সেখানে ঢাকাসহ আশপাশের এক হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকার দুই হাজার ১৯৮ কিলোমিটার জলাধার সিএস রেকর্ড অনুযায়ী উদ্ধার করে সচলের সুপারিশ করা আছে। একই সঙ্গে এসব এলাকাকে বিনোদন স্পটে পরিণত করারও সুযোগ সৃষ্টি করা হবে।
ঢাকা শহরকে নতুন করে পরিকল্পিত নগরীতে পরিণত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ২০১০ সালে। সেজন্য প্রণয়ন করা হয় ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান বা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ)। ১৯৫৩ সালের টাউন ইমপ্রুভমেন্ট অ্যাক্টের আওতায় ২০১০ সালে ড্যাপ প্রণয়ন করা হয়েছিল। প্রথম ড্যাপের মেয়াদ ছিল ২০১৫ সাল পর্যন্ত। পরে মেয়াদ বাড়ানো হয়। পরবর্তী সময়ে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) নতুন ড্যাপ (২০২২-৩৫) তৈরি করে। ঢাকা মহানগরসহ আশপাশের এক হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে এ মহাপরিকল্পনা করা হয়। ড্যাপে ছয়টি স্বতন্ত্র অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে ঢাকাকে। সেগুলো হচ্ছেÍ কেন্দ্রীয় অঞ্চল- ঢাকা শহর, উত্তর অঞ্চল- গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন, পূর্ব অঞ্চল- কালীগঞ্জ ও রূপগঞ্জ উপজেলা, দক্ষিণ অঞ্চল- নারায়ণগঞ্জ, দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল- কেরানীগঞ্জ উপজেলা এবং পশ্চিম অঞ্চল- সাভার উপজেলা।
এলাকাভিত্তিক জনঘনত্ব বিন্যাস, নগরজীবন রেখা, ট্রানজিটভিত্তিক উন্নয়ন, নাগরিক সুযোগ-সুবিধার মানদ- প্রণয়ন, ব্লকভিত্তিক উন্নয়ন ও উন্নয়ন স্বত্ব বিনিময় সবমিলিয়ে রাজধানী ঢাকার সমস্যাগুলো কমিয়ে পরিকল্পিত শহর গড়ার লক্ষ্যে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) গেজেট আকারে প্রকাশ হয়। শহরের বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করতে নাগরিক সুবিধাদি ও পরিষেবার বিপরীতে জনসংখ্যা নির্ধারণ করে শহরের সার্বিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। সেক্ষেত্রে কোন এলাকার উন্নয়নে কতটুকু অনুমোদন দেওয়া হবে তা নির্ভর করবে ওই এলাকার সুবিধাদিপ্রাপ্তির ওপর।