দেশের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী- বিএসএফ কর্তৃক পুশইন থামছেই না। প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে মানুষ ঠেলে দেয়া হচ্ছে বাংলাদেশের ভেতরে। গত ৭ মে থেকে শুরু হওয়া এই ভারতীয় আগ্রাসনের শিকার হয়েছেন ১ হাজার ৬৯৫জন। সর্বশেষ গতকাল মঙ্গলবারও সিলেট, সুনামগঞ্জ ও লালমনিরহাট সীমান্ত দিয়ে ৪৬ জনকে পুশ-ইন করেছে বিএসএফ। তাদের আটকের পর পরিচয় নিশ্চিতে কাজ করেছে বাংলােেশর সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাশে (বিজিবি)। বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো মানুষের তালিকায় ভারতীয় নাগরিকও রয়েছে। এছাড়া রয়েছে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা নাগরিক। বিজিবি পুশইন করা মানুষের তালিকায় ১১০ জনকে ভারতীয় হিসেবে শনাক্ত করেছে। যাদের মধ্যে ইতোমধ্যে ১০৬ জনকে ভারতে পুশব্যাক করেছে বিজিবি। আইনি প্রক্রিয়া ছাড়া ভারতীয়সহ অন্যান্য দেশের নাগরিকরে বাংলাদেশে জোর পূর্বক ঠেলে দেওয়ার ঘটনায় ভারতীয় মানবাধিকার সংগঠনগুলো ইতোমধ্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। তবে দেশটির সরকার এ বিষয়টি আমলে নেয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
পুশইন ইস্যুতে বিজিবি কর্মকর্তারা বলছেন, যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে পুশইনের ঘটনায় পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে মৌখিক ও লিখিতভাবে বিএসএফের কাছে জোরালো প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে সব সময়। সংবেদনশীল সীমান্ত এলাকায় বিজিবি উচ্চ সতর্কতায় রয়েছে। সেখানে নজরদারি এবং টহল জোরদার করা হয়েছে। কিন্তু বিএসএফ পুশইন বন্ধ করেনি।
এদিকে বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশে একের পর এক পুশইনের ঘটনায় পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে বিজিবির জোরালো প্রতিবাদের পাশাপাশি কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে এর সমাধান চেয়ে আসছে বাংলাদেশ। পুশইন ইস্যুতে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকার ভারতকে একাধিক চিঠি দিয়ে ঘটনাকে ‘গভীর উদ্বেগজনক’ বলে উল্লেখ করা হয়। এছাড়া ১৯৭৫ সালের যৌথ সীমান্ত নির্দেশিকা, ২০১১ সালের সমন্বিত সীমান্ত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা এবং বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের আলোচনার চুক্তিগুলোর সঙ্গে এ ধরনের কর্মকা- যে সাংঘর্ষিক তা মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের বাংলাদেশে ঠেলে দিয়ে তাদের আদি নিবাস মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু পুশইন বন্ধের বিষয়ে গতকাল পর্যন্ত ভারত সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। যে কারণে গতকালও ৪৬ জনকে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
ভারতের দিক থেকে যেটা পুশ-ব্যাক, বাংলাদেশের চোখে সেটাই পুশ-ইন। সীমান্তে পুশ-ব্যাক বা পুশ-ইন আসলে এমন একটা পদ্ধতি যেখানে ধরা পড়া ব্যক্তিদের সীমান্তে নিয়ে গিয়ে অন্য দেশের সীমান্তে ঠেলে দেওয়া হয়ে থাকে।
এই প্রক্রিয়ার কোনো আইনি স্বীকৃতি নেই। এটি আন্তর্জাতিক আইন এবং মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন হিসেবে দেখছেন মানবাধিকার কর্মীরা। অন্যদিকে বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টির নতুন কৌশল হিসেবে ‘পুশইন’ চলছে। যেকারণে পুশইন বন্ধে ঢাকার পক্ষ থেকে দিল্লিকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ করা হলেও এ ব্যাপারে দেশটি পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
গত ২২ এপ্রিল ভারত শাসিত কাশ্মীরের পেহেলগামে হামলার পর দেশটিতে অনুপ্রবেশকারী ধরতে অভিযান শুরু করে ভারত। অবৈধভাবে ভারতে বসবাসকারীদের আটকের পর এদের অনেককেই বাংলাদেশে ঠেলে দিয়েছে বিএসএফ। এরপর দিনের পর দিন বাংলাদেশে পুশইন বাড়তে থাকে। এই পুশইন ঠেকাতে কোন কোন সীমান্তে বিজিবির পাশাপাশি সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারা রাতে পাহারা বসায়। এতে অনেক জায়গাতেই পুশইন করতে ব্যর্থ হয় বিএসএফ।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বিজিবি সূত্রের খবর অনুযায়ী গত ৭ মে থেকে ১৭ জুন পর্যন্ত বিএসএফ বাংলাদেশের ২২টি জেলার সীমান্ত এলাকা দিয়ে ১৫৬০ জনকে বাংলাদেশে পুশইন করেছে।এদের মধ্যে ১৩৮৬ জন বাংলাদেশি নাগরিক, ৬৪ জন মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা এবং ১১০ জন ভারতীয় নাগরিক। এদের মধ্যে ১৫৫৬ জনকেই পুশব্যাক করেছে বিজিবি। ১৮ জুন থেকে গতকাল ২৪ জুন পর্যন্ত আরও ১৩৫ জনকে পুশইন করা হয়েছে। এর মধ্যে গতকাল মঙ্গলবার সিলেট, সুনামগঞ্জ ও লালমনিরহাট সীমান্ত দিয়ে আরো ৪৬ জনকে পুশ-ইন করে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিএসএফ। বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সাতক্ষীরা, নওগাঁ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, খাগড়াছড়ি, মৌলভীবাজার, কুড়িগ্রাম, সিলেট, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, দিনাজপুর, ফেনী, কুমিল্লা, ঝিনাইদহ, হবিগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, সাতক্ষীরা, সুনামগঞ্জ ও কুষ্টিয়া জেলা দিয়ে ইতোমধ্যে পুশইন করা হয়েছে। এছাড়া সুন্দরবন এলাকা দিয়ে ৭৮ জনকে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়। যাদের কেউ কেউ দেশে পুশইনের পর ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ করেন।
জানতে চাইলে ৪৮ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. নাজমুল হক গতকাল মঙ্গলবার দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার সীমান্ত দিয়ে গতকাল মঙ্গলবার ৩৯ জনকে ঠেলে দেওয়া হয়। তাদের পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার মিনাটিলা সীমান্ত দিয়ে ১৯ জনকে ঠেলে পাঠায় বিএসএফ । তাদের মধ্যে তিনটি পরিবারের নারী, পুরুষ ও শিশু রয়েছেন। তাদের সবার বাড়ি কুড়িগ্রাম জেলায়। অন্যদিকে, সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলার নোয়াকোট সীমান্ত দিয়ে আরও ২০ জনকে ঠেলে পাঠানো হয়। তাদের মধ্যে তিনটি পরিবারের নারী পুরুষ ও শিশু রয়েছেন। আটক ২০ জনের মধ্যে ১৯ জনের বাড়ি কুড়িগ্রাম ও ১ জনের বাড়ি পাবনা জেলায়।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. নাজমুল হক বলেন, সীমান্তে পুশইন ঠেকাতে বিজিবি সর্বোচ্চ সতর্ক রয়েছে। গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধির পাশাপাশি সীমান্তে টহল জোরদার করা হয়েছে। এছাড়া স্থানীয়দেরও এ ব্যাপারে সজাগ থাকতে অনুরোধ করা হয়েছে বলে তিনি জানান।