এখনো তালিকাভুক্ত হয়নি জুলাই আন্দোলনে শহীদ এবং আহত অনেকের নাম। শহীদের সংখ্যা বেশি না হলেও আহতের সংখ্যা দুই হাজারের বেশি। যারা এখনো সরকারি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি। আন্দোলনে সম্মুখসারিতে থেকে আহত অনেকেই আছেন যারা টাকার অভাবে চিকিৎসা করতে পারছেন না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) বন্ধ থাকায় নাম তালিকাভুক্ত করা যাচ্ছে না। নাম অন্তর্ভুক্তি করতে প্রতিদিন বিভিন্ন দফতরে যোগাযোগ করেও সদুত্তর পাওয়া যাচ্ছে না বলে আহত অনেকের অভিযোগ। এ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদেরকে অনুরোধ জানিয়েছেন জুলাই আন্দোলনে শহীদ এবং আহতদের পরিবার।
জুলাই আন্দোলনে সম্মুখসারিতে থেকে আহত একজন নাম প্রকাশ না করে জানান, তিনি সরকার ঘোষিত নির্দিষ্ট সময়ে নাম অন্তর্ভুক্ত করতে পারেননি। হাসপাতাল এবং সংশ্লিষ্ট দফতর থেকেও তার নাম জুলাই ফাউন্ডেশন বা স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় সংশ্লিষ্ট শাখায় তালিকাভুক্ত করেনি। জুলাইয়ে সম্মুখসারিতে থেকে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে পায়ে গুলীবিদ্ধ হয়ে আহত হলেও কোনো দফতর থেকে তার কোনো খোঁজখবর নেয়নি। এমনকি চিকিৎসার ব্যাপারেও তাকে কোনো দফতর থেকে সহায়তা করেনি। পরবর্তীতে প্রয়োজনীয় নথিপত্র নিয়ে এমআইএস এর মাধ্যমে নাম অন্তর্ভুক্তি করতে গিয়ে তিনি জানতে পারেন সার্ভার লকড। গত মার্চ মাসে তিনি ঢাকা জেলা সিভিল সার্জন অফিসে গিয়ে প্রয়োজনীয় নথিপত্র জমা দিলেও সার্ভার বন্ধ থাকায় এখনো নাম অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি। সিভিল সার্জন অফিস থেকে বলা হচ্ছে এমআইএস সার্ভার এখনো বন্ধ। কবে নাগাদ সার্ভার চালু করা হবে সেব্যাপারেও কোনো তথ্য নেই সিভিল সার্জন অফিসের কর্মকর্তাদের কাছে।
জানা গেছে, রাজধানীর খিলগাঁওয়ে পুলিশের গুলীতে আহত উজ্জল হোসেন ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকেই জুলাই ফাউন্ডেশনে আসছেন। উদ্দেশ্য এমআইএস-এ নাম অন্তর্ভুক্ত করা। তিনি বলেন, ঢাকা জেলা সিভিল সার্জন অফিসে সব কাগজ জমা দিয়েছি। কিন্তু এখনো এমআইএস-এ নাম আসে নাই। কারণ জানতে তাদের অফিসে গেলে বলে, আপনার মেডিকেল ডকুমেন্টসহ যাবতীয় কাগজপত্র ঠিক আছে কিন্তু এমআইএস-এ নাম অন্তর্ভুক্তকরণের কাজ বন্ধ আছে। কার্যক্রম শুরু হলে নাম অন্তর্ভুক্ত করা হবে। তিনি আরও বলেন, আমার চিকিৎসার যাবতীয় খরচ নিজেদেরই বহন করতে হচ্ছে। কিন্তু অনেকে দ্বিতীয় ধাপে টাকা পাচ্ছেন। অথচ আমি এখনো প্রথম ধাপের টাকাই পাইনি। স্বাভাবিকভাবেই জীবনযাপন আমার জন্য কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়াও এখনো এমআইএস-এ তালিকাভুক্ত না হওয়ায় মাসিক ভাতার জন্য সরকারের গেজেটে নামও আসে নাই। আমি সরকারের কাছে এমআইএস-এ নাম অন্তর্ভুক্তকরণের কাজ দ্রুত শুরু করার দাবি জানাই।
জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার ও আহতদের সহায়তায় গড়ে তোলা হয়েছে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন। সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত এই ফাউন্ডেশন থেকে শহীদ পরিবারকে অর্থ সহায়তা দেয়া হচ্ছে। একইসঙ্গে আহতরা পাচ্ছেন চিকিৎসা খরচ ও সহায়তা। আহত এবং শহীদ পরিবারকে অর্থ সহায়তার দেয়ার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে সরকারিভাবে তালিকা করা হয়। এই তালিকাকে প্রাথমিক তথ্যের উৎস ধরে সেবা দিয়ে থাকে ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট ‘ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস)’র আওতায় ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে নিহত ও আহত ব্যক্তিবর্গের তালিকা প্রকাশ করার কাজ গত ১৯ জানুয়ারি থেকে বন্ধ আছে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ- এমআইএস ওয়েবসাইটে নাম অন্তর্ভুক্তি না করার কারণে কোনো সহায়তাই পাচ্ছেন না তারা। এতে চিকিৎসা খরচ যোগাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। এ ছাড়াও ফিল্ড ভেরিফিকেশনসহ সকল কাজ সম্পন্ন হলেও, সরকারের বরাদ্দকৃত অর্থ সহায়তা না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন অনেক পরিবার। তারা দ্রুত এমআইএস-এ নাম অন্তর্ভুক্তিকরণের দাবি জানান।
জুলাই আন্দোলনে শহীদ ও আহত ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্মনিবন্ধন সনদ, স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা, মোবাইল নম্বর, হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণের প্রমাণপত্র এবং উপযুক্ত অন্যান্য কাগজপত্রসহ সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের কার্যালয় অথবা সিভিল সার্জন অফিস কিংবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় গিয়ে সরকারিভাবে নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য আবেদন করতে হয়। গত বছরের ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্টের মধ্যে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়ে প্রতিপক্ষের আক্রমণে যারা শহীদ বা আহত হয়েছেন তাদের নাম এমআইএস তালিকাভুক্তির জন্য ‘জেলা যাচাই- বাছাই কমিটি’ করা হয়েছে। জেলা প্রশাসনকে সভাপতি এবং জেলা সিভিল সার্জনকে সদস্য সচিব করে, পুলিশ সুপার ও সামাজ সেবা কর্মকর্তা ওই কমিটির সদস্য। এ ছাড়াও ২ জন করে ছাত্র প্রতিনিধি উক্ত কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এই কমিটির যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার পরেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট এমআইএস-এ নাম তালিকাভুক্ত করা হয়। যা কয়েক মাস ধরে বন্ধ রয়েছে।
সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদেরা ‘জুলাই শহীদ’ নামে অভিহিত হবেন। আর আহত ব্যক্তিরা ‘জুলাই যোদ্ধা’ নামে অভিহিত হবেন। জুলাই শহীদ পরিবার ও জুলাই যোদ্ধারা আর্থিক সহায়তাসহ বিভিন্ন সুবিধা পাবেন। জুলাই যোদ্ধারা তিনটি মেডিকেল ক্যাটাগরি (‘ক্যাটাগরি এ’ ‘ক্যাটাগরি বি’ ও ‘ক্যাটাগরি সি’) অনুযায়ী সুযোগ-সুবিধা পাবেন। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহত ব্যক্তিদের তালিকায় নাম তোলার আগে তা যাচাই-বাছাই করে জেলা প্রশাসন, সিভিল সার্জন কার্যালয় ও সরকার গঠিত গণ-অভ্যুত্থানসংক্রান্ত বিশেষ সেল। ঢাকা জেলার সিভিল সার্জন অফিসের পরিসংখ্যানবিদ মো. রকিবুল ইসলাম জানান, প্রতিদিন এমআইএস-এ নাম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ২০ থেকে ২৫ জন আসছে। সারা দেশে প্রায় ২০০০ জনের মতো আহত লোক নতুন করে এমআইএস-এ তালিকাভুক্তির অপেক্ষায়। এ ছাড়াও ৩ জন শহীদ কেস ভেরিফিকেশনসহ সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন। কিন্তু এমআইএস-এ অন্তর্ভুক্ত করতে পারছি না। আমরা এমআইএস-এ তথ্য এন্ট্রি করি। কিন্তু এটা মূলত স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। তারা যদি খুলে দেন আমরা দ্রুত কাজ শুরু করবো।
প্রতারণা: এদিকে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে অংশগ্রহণ না করেও অনেকের বিরুদ্ধে ওঠছে প্রতারণার অভিযোগ। ইতিমধ্যে কয়েকজনের বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য দিয়ে জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে সহায়তা নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। জুলাই ফাউন্ডেশনের দায়িত্বপ্রাপ্তরা যাচাইবাছাই করতে গিয়ে এ প্রতারণার বিষয় চিহ্নিত করেন। ইতিমধ্যে এরকম কয়েকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে বলে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে জানা গেছে। তবে নিয়মিত কাজের মধ্যে প্রায় প্রতিদিনই এধরণের প্রতারণার বিষয়গুলো চিহ্নিত করতে তাদের অনেক সময় নষ্ট হচ্ছে। তারপরও যারা মিথ্য তথ্য দিয়ে ইতিমধ্যে সহায়তার অর্থ নিয়ে গেছে তাদেরকে চিহ্নিত করে সবার কাছ থেকে টাকা ফেরত আনাও কঠিন কাজ হয়ে পড়েছে।
জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে জানা গেছে, গত ৫ মে লক্ষ্মীপুরের নূরানী মাদরাসার শিক্ষক আলী হাসান (৫৪) মিথ্যা তথ্য দিয়ে এমআইএস এ নাম তালিকাভুক্ত করে ফাউন্ডেশন থেকে সহায়তার টাকা নিতে এসেছিলেন। কিন্তু তার কথাবর্তা এবং তথ্যে গড়মিল থাকায় জিজ্ঞাসাবাদ করলে প্রতারণার বিষয়টি ধরা পড়ে। জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, তিনি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হলেও জুলাই অভ্যুত্থানে আহত হওয়ার মিথ্যা তথ্য দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে জুলাই ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তাদের দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদে তিনি প্রকৃত সত্য স্বীকার করেন। একজন বয়ষ্ক ব্যক্তি হওয়ায় তাকে পুলিশের কাছে সোপর্দ না করে মুচলেকা দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। এছাড়া সাভারের ক্যাবল অপারেটর মাহবুব হোসেন মিথ্যা তথ্য দিয় জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে এক লাখ টাকা নিয় গেছে। জুলাই ফাউন্ডেশন জানতে পেরেছে মাহবুব ডিসলাইন মেরামতের কাজ করেন। গত ১১ জুন ডিসলাইন মেরামত করতে গিয়ে উপর থেকে পড়ে আহত হয়। পরবর্তীতে জুলাইয়ে আহত বলে দাবি করে নাম তালিকাভুক্ত করে জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে এক লাখ টাকা নিয়ে গেছেন। পরবর্তীতে তাকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি প্রতারণার বিষয়টি স্বীকার করেন। মাহবুব বলেন, স্থানীয় কোচিং সেন্টারের এক শিক্ষক এমআইএস সিস্টেমে মিথ্যা তথ্য দিয়ে তার নাম অন্তুর্ভুক্তি করিয়ে দেন। চুক্তি অনুযায়ী এক লাখ টাকার অর্ধেক তাকে দিয়েছেন মাহবুব। মাহবুব টাকা ফেরত দেয়ার কথা স্বীকার করলেও এখনো জুলাই ফাউন্ডেশনে যোগাযোগ করেননি।
এছাড়াও জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নিয়ে আহত হননি মো. ইলিয়াছ হোসেন হিরণ (৩৭)। কিন্তু তিনি ‘জুলাই যোদ্ধা’ হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে দেওয়া আর্থিক সহায়তা নিয়েছেন। একইভাবে ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’ থেকেও আর্থিক সহায়তা নিয়েছেন ইলিয়াছ। তবে বিষয়টি ধরা পড়লে তিনি ১৫ এপ্রিল ফাউন্ডেশনের কাছে মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পান। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার ও আহত ব্যক্তিদের গত ১০ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রীয়ভাবে আর্থিক সহায়তা দেওয়া শুরু করে অন্তর্বর্তী সরকার। সেদিন ইলিয়াছ ‘জুলাই যোদ্ধা’ হিসেবে দুই লাখ টাকার চেক গ্রহণ করেন। এ ছাড়া তিনি ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’ থেকে এক লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা নিয়েছেন। জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনে ১৫ এপ্রিল ইলিয়াছ যে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন, তাতে বলেছেন, তিনি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত হননি। তিনি মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত হিসেবে সরকারি তালিকায় তার নাম অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
জুলাই ফাউন্ডেশনের গ্রাহক সেবা কর্মকর্তা মো: সাইদুর রহমান দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ ফাউন্ডেশন অফিসে আসেন যাদেরকে যাচাইবছাই করতে আমাদের সময় নষ্ট হয়। মিথ্যা তথ্য দিয়ে কেউ কেউ বিভাগীয় কমিশনার, সিভিল সার্জন অফিস বা ইউএনও অফিস থেকে এমআইএস করে সংশ্লিষ্ট দফতরে নাম অন্তর্ভুক্তি করে আমাদের কাছে সহায়তা নিতে আসে। তাৎক্ষনিকভাবে প্রতারণার বিষয়টি ধরা যায় না, তবে বিভিন্ন কৌশলে আমাদেরকে সন্দেজনক ব্যক্তিদেরকে চিহ্নিত করতে হয়। এসব করতে গিয়ে নিয়মিত কাজেরও সমস্যা হচ্ছে আমাদের। সার্ভার লক থাকার বিষয়ে তিনি বলেন এটি স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাতে। তবে এ’, বি’ ও সি’ ক্যাটাগারির আর্থিক সহায়তার কাজ শেষ হলে এমআইএস সার্ভার খুলে দেয়া হতে পারে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, যতদিন শীহদ এবং আহতদের নাম আসবে ততদিনই নাম অন্তর্ভুক্তি করা হবে। এমআইএস সার্ভার লক থাকার বিয়ষটি সাময়িকি। এটি শিগগরই চালু করা হবে বলে জানান তিনি।