বিশ্ব বরেণ্য আলেমে দ্বীন আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে চিকিৎসার নামে হত্যার (Medical Killing) অভিযোগ করেছেন তার তৃতীয় সন্তান মাসুদ সাঈদী। আল্লামা সাঈদীর দ্বিতীয় মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষে গতকাল বুধবার দৈনিক সংগ্রামকে তিনি এ কথা জানান। তিনি বলেন, আমি আজকে স্পষ্ট করেই ডা. চৌধুরী মেশকাত আহমেদ, ডা. এস এম মোস্তফা জামান, মোঃ রেজাউর রহমানের বিরুদ্ধে ক্লিনিক্যাল নেগলেজেন্সি’র এর মতো অপরাধ করে আমার পিতা আল্লামা সাঈদীকে হত্যার অভিযোগ আনছি। এ নিয়ে তিনি ৭টি প্রশ্ন তুলে ধরেন।
মাসুদ সাঈদী বলেন, পলাতক ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে কথিত যুদ্ধপরাধের সাজানো বিচারের নামে বিচারিক হত্যা (Judicial Killing) করতে চেয়েছিল, কিন্তু আল্লাহ তায়ালার দয়ায় বিশ্বব্যাপি সচেতন মানুষের প্রতিবাদ ও ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব শ্রেণী-পেশার মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভের কারনে ফ্যাসিষ্ট শেখ হাসিনা আল্লামা সাঈদীকে কথিত বিচারের নামে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করতে পারেনি। অবশেষে খুনি হাসিনা আল্লামা সাঈদীকে চিকিৎসার নামে হত্যার (Medical Killing) পথ বেছে নিয়েছিল।
জালেম শেখ হাসিনা আর তার চিকিৎসক নামের খুনিরা যে একটি মাষ্টার প্লানের মাধ্যমে আল্লামা সাঈদীকে চিকিৎসার নামে হত্যা করেছে, সে বিষয়ে আজকের আমি কিছু তথ্য জাতির সামনে দিতে চাই।
তিনি বলেন, আমি আজকে স্পষ্ট করেই ডা. চৌধুরী মেশকাত আহমেদ, ডা. এস এম মোস্তফা জামান, মোঃ রেজাউর রহমানের বিরুদ্ধে Clinical Negligence এর মতো অপরাধ করে আমার সম্মানিত পিতা আল্লামা সাঈদীকে হত্যার অভিযোগ আনছি। আমার এ দাবি সত্য কি সত্য নয় তা প্রমাণের দায়িত্ব আল্লামা সাঈদীর চিকিৎসার দায়িত্বে থাকা কার্ডিওলজিস্ট ডা. চৌধুরী মেশকাত আহমেদ, ডা. এস এম মোস্তফা জামানের। একই সাথে আমার বক্তব্যের সত্যতা নিরুপনে যে প্রশ্নগুলো আমি আজকে জাতির সামনে তুলে ধরতে চাই তা হলোঃ
১. কারো হার্ট অ্যাটাকের হলে অ্যাটাকের ১২ ঘন্টার মধ্যে এনজিওগ্রাম করে হার্টে রিং পরানো (Primary Percutaneous Coronary Intervention- PCI) হয় বা রোগীর বুকে ব্যথা থাকলে বা হার্টের গতি এলোমেলো (Arrhythmia) বা পেশেন্ট শকে (shock) গেলে সময়ের দিকে না তাকিয়ে দ্রুত এনজিওগ্রাম করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়। বুকে ব্যথা না থাকলেও ২৪ ঘন্টার মধ্যে Early PCI এর মাধ্যমে রোগীকে স্ট্যাবল করা হয়। কিন্তু আল্লামা সাঈদীর ব্যাপারে এর ব্যাতিক্রম হলো কেন? হাসাপাতালে আনা থেকে শুরু করে শাহাদাত পর্যন্ত এই দীর্ঘ সময়েও তার এনজিওগ্রাম করা হলো না কেন?
২. এক সাক্ষাৎকারে ডা. এস এম মোস্তফা জামান বলেছেন যে, তারা প্রথমেই আল্লামা সাঈদীকে PCI (Per Cutaneous Intervention) করার সিদ্ধান্ত নেন। পরে রোগীর বুকে ব্যথা না থাকার কারণে তারা আর PCI না করে কনজারভেটিভ ট্রিটমেন্ট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। PCI না করার এটা কোন কারন হতে পারে? কার্ডিওলজির আন্তর্জাতিক মানদন্ডের নীতিমালায় কোথাও লেখা নেই যে, বুকে ব্যথা না থাকলে বা কমে গেলে PCI করার প্রয়োজন নেই। PCI না করার অন্য কারণগুলো আল্লামা সাঈদীর ক্ষেত্রে তো প্রযোজ্য ছিলো না। তাহলে আপনারা কেন PCI করলেন না? এটা স্পষ্ট Medical Negligence- যা সুস্পষ্ট অপরাধ।
৩. যে কোনো জটিল রোগে আক্রান্ত সাধারণ রোগীর ক্ষেত্রেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিশেষজ্ঞ মেডিকেল বোর্ড গঠন করে তার চিকিৎসা প্রদান করে। কিন্তু আল্লামা সাঈদীর মতো বিশ্বব্যাপি পরিচিত ও নন্দিত একজন মানুষকে অসুস্থতার কথা বলে হাসপাতালে আনা হলো কিন্তু তার সুচিকিৎসার জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কোন মেডিকেল বোর্ড গঠন করলো না কেন?
৪. আওয়ামী সরকার/হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলেছে যে, আল্লামা সাঈদীর নাকি ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। হার্ট অ্যাটাকের রোগীকে তো স্ট্রেস ফ্রি রাখতে হয়, বিছানায় শুইয়ে রেখেই তার সবকিছু করতে/করাতে হয়। বেড থেকে না নামা বা যে কোনো ধরনের Exertion এড়িয়ে চলা, এমনকি খাওয়া নামাজ বাথরুম সবকিছুই বেডে হওয়া বাধ্যতামূলক। এটাই International protocol, তবে আল্লামা সাঈদীর বেলায় এই প্রটোকল মানা হলো না কেন? কেন তাকে কাশিমপুর কারাগার থেকে এম্বুলেন্সে বসিয়ে আনা হলো? কেন এম্বুলেন্স থেকে নামানোর সময় হাঁটিয়ে নামানো হলো? কেনো তাকে স্ট্রেচারে না শুইয়ে হুইলচেয়ারে বসিয়ে হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে নেওয়া হলো? কেন আবার তাকে ইমার্জেন্সিতে নিয়ে বেডে বসিয়ে রাখা হলো?
৫. ডাঃ এস এম মোস্তফা জামান আল্লামা সাঈদীর শাহাদাতের পর এক মিডিয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সন্ধ্যা ৬:৪৫ মিনিটের দিকে নাকি আল্লামা সাঈদীর কার্ডিয়াক এরেস্ট হয় এবং সাথে সাথেই CPR শুরু হয়, সন্ধ্যা ৭:১০ মিনিটে ETT করানো হয় এবং লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয়। যেখানে হার্ট অ্যাট্যাকের ক্ষেত্রে শ্বাসনালী প্রটেকশন (CPR শুরু হওয়া ও Airway protection by ETT intubation) যত দ্রুত সম্ভব শুরু হওয়া উচিত, সেখানে CPR শুরুর ২৫ মিনিট পরে শ্বাসনালী প্রটেকশন নেয়া হয়েছে। চিকিৎসা বিজ্ঞান অনুযায়ী, চার মিনিট ব্রেইনে অক্সিজেন সাপ্লাই বন্ধ হলে ব্রেইন ডেমেজ শুরু হয়, সেখানে ২৫ মিনিট তো অনেক অনেক বেশী সময়। তাহলে আল্লামা সাঈদীর ক্ষেত্রে সিপিআর শুরু করতে ২৫ মিনিট দেরি করা হলো কেন?
৬. ডাঃ এস এম মোস্তফা জামান বলছেন আল্লামা সাঈদীকে ৭:১০ মিনিটে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। তাহলে প্রশ্ন হলো- আমি তো সারাদিন হাসপাতালের প্রত্যেকটি দরজায় আব্বার জন্য অনুনয় বিনয় করেছি, ডা. মেশকাত, ডা. জামান, পরিচালক রেজাউর রহমানসহ প্রত্যেকের কাছে গিয়েছি এবং তারা জানেন আমি হাসপাতালেই আছি- তাহলে আব্বাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়ার আগে আমাকে জানানো হলো না কেন? লাইফ সাপোর্টে নেওয়ার অনুমতি পরিবারের কাছ থেকে নেওয়া হলো না কেন?
৭. আব্বার শাহাদাত পরবর্তী ছবিতে তার পেট অনেক ফোলা দেখা গিয়েছে। আমি ডা. মেশকাত ও ডা. জামানকে প্রশ্ন করার পরও তারা এর কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি। আমার যেটা বিশ্বাস তা হলো- আল্লামা সাঈদীকে হত্যার পর তারহুড়ো করে লাইফ সাপোর্টের নাটক সাজাতে গিয়ে তারা ETT tube শ্বাসনালীতে না দিয়ে খাদ্যনালীতে দিয়েছিল বলে আল্লামা সাঈদীর পেটে বাতাস জমে পেট ফুলে গিয়েছিল।
আল্লামা সাঈদীর চিকিৎসা নিয়ে আরো কিছু তথ্য ও প্রশ্ন: আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর চিকিৎসা এবং মৃত্যু নিয়ে যেসব তথ্য ও প্রশ্ন সাধারণ জনগণের মাঝে দেখা দিয়েছে তা এখানে তুলে ধরছি।
একজন গুরুতর অসুস্থ ব্যক্তির চিকিৎসার জন্য যে ধরনের তড়িৎ পদক্ষেপ নেয়ার কথা ছিল, তা আল্লামা সাঈদীর ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। বরং বেশিরভাগ মানুষই বলছেন, প্রক্রিয়াগত দীর্ঘসূত্রিতার মাধ্যমেই তাকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে এবং এটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।
প্রসঙ্গত কিছু বিষয় এখানে গুরুত্বপূর্ণ-
১. আল্লামা সাঈদীর চিকিৎসা নিয়ে শুরু থেকে কারাকর্তৃপক্ষ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ লুকোচুরি করেছেন। এই প্রক্রিয়ার কোনটার সাথেই পরিবারকে সম্পৃক্ত করা হয়নি। এমনকি পরিবারকে অসুস্থতার খবরটিও পর্যন্ত দেয়া হয়নি।
২. আমি তাদের অবহেলা/ষড়যন্ত্র আঁচ করে সন্ধ্যার কিছু আগে/পরে ফেসবুকে লিখেছিলাম, “আমরা আব্বার শারিরীক অবস্থার অবনতির খবর পাচ্ছি। হাসপাতাল কতৃপক্ষ এবং প্রশাসন নিষ্ঠুর আচরণ করছে। তারা আমাদেরকে কোন তথ্যতো দিচ্ছেই না আমাদেরকে একরকম অসহায় করে রেখেছে। তারা কিছু একটা লুকাচ্ছে আমাদের কাছ থেকে।”
৩. আল্লামা সাঈদীর চিকিৎসা পারিবারিক তত্ত্বাবধানে বন্দোবস্ত করার ও একজন অ্যাটেনডেন্টকে তার সাথে রাখার সুযোগ দেয়ার অনুমতি চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা সত্ত্বেও মন্ত্রণালয় থেকে আমাদেরকে বিন্দু পরিমান সহযোগিতা করা হয়নি। আব্বার জীবনের শেষ মুহূর্তেও তাকে তার স্ত্রী এবং সন্তানদের সাথে সাক্ষাৎ করতে দেয়া হয়নি। এমনকি মৃত্যুর পরও তার স্ত্রীসহ পরিবারের সদস্যদেরকে তার মৃত মুখ পর্যন্ত দেখতে দেয়া হয়নি। এটা শুধু মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘনই নয়, অমানবিকও বটে।
৪. হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আল্লামা সাঈদীকে হাসপাতালে ভর্তি থেকে শুরু করে শাহাদাত পর্যন্ত কোন আনুষ্ঠানিক ব্রিফ্রিং করেনি। তার চিকিৎসা নিয়েও কোন বক্তব্য দেয়নি। যা আল্লামা সাঈদীর মতো আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে সমাদৃত একজন মানুষের ক্ষেত্রে নজিরবিহীন।
৫. শাহাদাতের দুইদিন পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আব্বার চিকিৎসার বিষয়ে সাংবাদিক সম্মেলন ডাকলেও অদৃশ্য কারণে তা স্থগিত করে। পরে গণমাধ্যমে একটি দায়সারা প্রেসবিজ্ঞপ্তি পাঠায়। কেন সাংবাদিক সম্মেলনটা করা হলো না? সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে সত্য প্রকাশ হয়ে যাবে এই ভয়ে? জটিল রোগীর ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ মেডিকেল বোর্ড গঠন করে চিকিৎসা প্রদান করা হয়। আল্লামা সাঈদীর ক্ষেত্রে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের পক্ষ কোন মেডিকেল বোর্ড গঠন হয়নি। কেন মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হলো না এর কোন ব্যাখ্যা দুই দিন পর দেয়া হাসপাতালের প্রেসবিজ্ঞপ্তিতেও উল্লেখ করা হয়নি।
৬. হাসপাতালে সার্বক্ষণিক মিডিয়ায় কথা বলেছেন মেডিকেল টিমের সদস্য ডা. এস এম মোস্তফা জামান। তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য বিষয়ক কমিটির সদস্য, ঢাকা মেডিকেল কলেজে ছাত্রলীগ নেতা এবং ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে শাহবাগীদের কথিত গণজাগরণ মঞ্চে আল্লামা সাঈদীর ফাঁসির দাবিতে উগ্র শ্লোগান দেওয়া ব্যাক্তি। তার কাছে কি আল্লামা সাঈদী সুচিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ আছে? যার ফাঁসির দাবিতে রাজপথে গলা ফাঁটিয়েছেন তিনি কি কখনো সুযোগ পেলে ওই লোকটিকে সুচিকিৎসা দিতে পারেন? তাহলে তাকে কেন আল্লামা সাঈদীর চিকিৎসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলো?
৭. হার্ট অ্যাটাকের রোগীকে কখনো কি হাত ধরে নামানো হয়? হুইল চেয়ার ব্যবহার করা হয়?
৮. অসুস্থতার কোন খবরই পরিবারকে জানানো হয়নি। এমনকি বারবার চেস্টা করেও কোনো খোঁজ নিতে পারিনি। এমনকি আব্বা জীবিত অবস্থায় আমাদের পরিবারের কোন সদস্যকেও ধারে কাছে যেতে দেওয়া হয়নি।
৯. পিজি হাসপাতালে আল্লামা সাঈদীকে আনার পর তাকে কী কী ওষুধ দেওয়া হয়েছিল এবং কে সেগুলো প্রেসক্রাইব করেছিল?
১০. ডাক্তারদের বক্তব্য অনুযায়ী আল্লামা সাঈদীর হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী আল্লামা সাঈদীর চিকিৎসা চলছিল তাহলে তার দ্বিতীয় দফায় হার্ট অ্যাটাকের কারন কি? এর কোনো উত্তর ডাক্তাররা দিলেন না কেন?
১১. আন্তর্জাতিক গাইডলাইন অনুযায়ী আমাদের দেশে কার্ডিওলজীর সবগুলো চিকিৎসাই প্রচলিত আছে। তাহলে আল্লামা সাঈদীর জন্য কেন এগুলো করা হলো না? আল্লামা সাঈদী ভর্তি হয়েছিলেন ডা. মেশকাতের অধীনে। তাহলে চিকিৎসা দিতে ডা. মোস্তফা জামান কেনো এসেছিল?