২৭ জুলাই রোববার। ২০২৪ সালে দিনটি ছিল শনিবার। জুলাই আন্দোলনে আহতদের পঙ্গু হাসপাতালে দেখতে গিয়ে চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে ‘নো ট্রিটমেন্ট, নো রিলিজ’ (না চিকিৎসা, না ছাড়পত্র) নির্দেশ দিয়েছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একথা পরবর্তীতে জানা যায়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মো. তাজুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, এর প্রমাণ প্রসিকিউশনের হাতে এসেছে। তিনি বলেন, ‘আমরা রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) বা পঙ্গু হাসপাতালে যখন পরিদর্শনে গিয়েছিলাম তখন সেখানে চিকিৎসারত আহত রোগী ও তাদের স্বজনরা আমাদের জানিয়েছিলেন, শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার আগে একবার হাসপাতাল পরিদর্শন করতে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে বলেছিলেন, ‘নো ট্রিটমেন্ট, নো রিলিজ’। অর্থাৎ কর্তব্যরত চিকিৎসক ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে আহতদের কোনো চিকিৎসা না দিতে এবং কাউকে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র না দিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল।
এ সময় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান চলাকালে আমাদের সে সকল সন্তানরা শহীদ হয়েছেন, তাদের লাশ প্রশাসনের নির্দেশে সুরতহাল করতে দেওয়া হয়নি, কাউকে কাউকে ডেথ সার্টিফিকেটও দেওয়া হয়নি। এমনকি গুলীবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে যাওয়ার পর যারা সেখানেই শহীদ হয়েছেন তাদের ডেথ সার্টিফিকেটে গুলীতে মারা গেছে- এই কথাটিও লিখতে দেওয়া হয়নি। শ্বাসকষ্ট কিংবা জ্বরে মারা গেছে এ ধরনের কথা লিখতে বাধ্য করা হয়েছে। আন্দোলনে শহীদের লাশ দাফন করতে যাচ্ছে জানতে পারলে রাস্তায় পুলিশ তাদের পরিবারের ওপর হামলা-আক্রমণ করেছে।
তিনি বলেন, আদালত আমাদের কাছে জানতে চেয়েছেন, যে শহীদদের সুরতহাল প্রতিবেদন বা পোস্টমর্টেম রিপোর্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য এবং কেন সেগুলো নেই। আমরা আদালতকে জানিয়েছি সেই মুহূর্তে মানবতাবিরোধী অপরাধের মাত্রা এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, দ্রুত শহীদদের লাশ দাফন করতে বাধ্য করা হয়েছে। তাই এ কারণে তাদের কোনও পোস্টমর্টেম রিপোর্ট দেওয়া হয়নি। ঘটনাটি কোনো স্বাভাবিক বিষয় নয় বরং তা মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি জাজ্জ্বল্যমান প্রমাণ। এটিই প্রমাণ করে কি ধরনের নিষ্ঠুরতার সাথে জুলাই-আগস্টে হত্যাকা-গুলো চালানো হয়েছিল।
স্বৈরাচার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের ২৭ জুলাই শনিবার সকালে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) চিকিৎসাধীন আহত ব্যক্তিদের দেখতে যান। সরকার প্রধান হাসপাতালে গুরুতর আহত চিকিৎসাধীন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেন এবং তাঁদের চিকিৎসার খোঁজখবর নেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী সংঘাতে আহত ব্যক্তিদের অনেকে এই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল।
প্রধানমন্ত্রী আহত ব্যক্তিদের যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করতে সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দেন। তিনি আহত ব্যক্তিদের অবস্থা দেখে আবেগাপ্লুত হওয়ার নাটক করেন। হাসপাতালের পরিচালক ড. কাজী শামীম উজ্জামান আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে জানান। শেখ হাসিনা আহত ব্যক্তিদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে বলেন। এ সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন, স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী রোকেয়া সুলতানা, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব এম তোফাজ্জল হোসেন মিয়া ও প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব নাইমুল ইসলাম খান উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী আগের দিন শুক্রবার বিকেলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ডিএমসিএইচ) হাসপাতাল পরিদর্শন করেন এবং সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে হামলায় আহত ব্যক্তিদের খোঁজখবর নেন।
আন্দোলনে আহত হয়ে অনেক শিক্ষার্থী মানবেতর জীবন যাপন করে। তাদের অনেকে সরকারী হাসপাতালে পর্যন্ত যাওয়ার সাহস পায়নি। অনেকে বিনা চিকিৎসায় কাতরান। অনেকে চিকিৎসা নিতে গিয়ে হয়রাণির শিকার হয়েছেন। এরপর যদি দেশের প্রধানমন্ত্রী নো ট্রিটমেন্ট নো রিলিজ অর্ডার করেন; তাহলে কি পরিণাম হতে পারে বিষয়টা কতটা অমানবিক তা কেবল ভুক্তভোগীরাই বুঝতে পারেন। এরকম ভয়ার্ত পরিবেশেও ধরপাকড় অব্যাহত রাখে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী।
এদিন কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরও দুই সমন্বয়ককে হেফাজতে নেয় ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। শনিবার রাতে অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন সমন্বয়ক জানান, পুলিশের ধরপাকড়সহ নানা কারণে সব সমন্বয়কদের সাথে তারা যোগাযোগ করতে পারছেন না। যে কারণে সমন্বিতভাবে তারা কোন কর্মসূচি ঘোষণা করতে পারছেন না। আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক মাহিন সরকার বলেন, আন্দোলনের মূল দাবি মেনে নেয়া হয়েছে বলে প্রচার করছে সরকার। কিন্তু আমাদের দাবি ছিল কমিশন গঠন করে এই সংকটের সমাধান করা। কিন্তু সেটি করা হয়নি বলেই আমরা এই পরিপত্র প্রত্যাখ্যান করছি। অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও আবু বাকের মজুমদারসহ সমন্বয়কদের গ্রেফতার ও মামলা হামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন আন্দোলনকারীরা।
সংবাদ সম্মেলনে সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদ বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সমন্বয়কদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এখন পর্যন্ত তিন হাজারের বেশি শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়েছে। মি. মাসুদ বলেন, “রোববারের মধ্যে সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামসহ, আসিফ মাহমুদসহ আটক সকল শিক্ষার্থীদের মুক্তি, মামলা প্রত্যাহার ও শিক্ষার্থী গণহত্যার সাথে জড়িত মন্ত্রী পর্যায় থেকে কনস্টেবল পর্যন্ত সকল দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি আল্টিমেটাম দিয়ে জানান, আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এই তিন দফা না মানা হলে তা না হলে পরশুদিন থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আরো কঠিন কর্মসূচি নিতে বাধ্য হবে। একই সাথে পরদিন রোববার সারাদেশের দেয়ালগুলোতে গ্রাফিতি ও দেয়াল লিখন কর্মসূচিরও ঘোষণা দেয়া হয় সংবাদ সম্মেলন থেকে।
এছাড়া সোমবার থেকে সারাদেশের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, জেলা, উপজেলা ও নগরকেন্দ্রিক "হেলথ ফোর্স" গঠন করে আহত-নিহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি, এবং আহত-নিহত ছাত্র-নাগরিক ও তাদের পরিবারকে মানসিক ও আর্থিকভাবে সহযোগিতা কার্যক্রম পরিচালনার ঘোষণা দেয়া হয়। একইসাথে "লিগ্যাল ফোর্স" গঠন করে সারাদেশে শিক্ষার্থীদের নামে মামলার ডকুমেন্টেশন এবং যাদের আইনি সাহায্যের প্রয়োজন তাদেরকে সেই সাহায্যের ব্যবস্থা করারও ঘোষণা দেয়া হয়। শনিবার রাতে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার জুনায়েদ আলম সরকার বিবিসি বাংলাকে বলেন, ওই পাঁচ জন নিরাপত্তার নিয়ে সংশয়ে ছিল। যে কারণে ডিবি তাদের নিরাপত্তার স্বার্থে হেফাজতে নিয়েছে। একই সাথে সাম্প্রতিক ঘটনা সম্পর্কে তাদের কাছে তথ্য নেয়া হবে বলেও জানান মি. সরকার। কিন্তু তারা কী ধরনের নিরাপত্তাহীনতায় ছিল? এই প্রশ্নে কোন উত্তর দেননি গোয়েন্দা পুলিশের এই কর্মকর্তা।
বিবিসি বাংলাকে নাহিদ ইসলামের পিতা বদরুল ইসলাম বলেন, আমরা যোগাযোগের চেষ্টা করেছি। কিন্ত আমার ছেলের সাথে কোন যোগাযোগ করতে পারিনি। এই অবস্থায় কী করবো বুঝতে পারছি না। পরিবারের সদস্যরা বলছেন, মামলা ছাড়া কেন তাদের তুলে নেয়া হয়েছে। এতক্ষণ ধরে আটকে কেন রাখা হয়েছে সেটিও জানতে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন বলেও জানান তাদের পরিবারের সদস্যরা।
সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদের পিতা বিল্লাল হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, আমরা শুনছি পুলিশের কাছে আছে। আমরা তো কোন যোগাযোগও করতে পারছি না তারা কেমন আছে, কিভাবে আছে। ছেলের নামে মামলা হইছে কী না তাও জানি না। এখন আমরা কি করবো ? তবে গোয়েন্দা পুলিশের পক্ষ থেকে জানান হয়, তাদের নামে কোন মামলা হয়নি। আগেও তাদের নামে কোন মামলা নেই। গোয়েন্দা কর্মকর্তা মি. সরকার বলেন, মামলা হয়নি, তবে তারা অনিরাপদ মনে করছিল তাই নিরাপত্তা দিয়ে রেখেছি আমরা।
একদিনে স্বৈরাচার হাসিনা পঙ্গু হাসপাতালে দিয়ে চোখে রুমাল দিয়ে কান্নার অভিনয় করে; অন্যদিক ব্লক রেইড দিয়ে কয়েক হাজার শিক্ষার্থীকে আটক করে। পুলিশী অভিযানে ব্যাপক আতংক তৈরি হয় দেশজুড়ে। তরুণ ও যুব সমাজ সরকারের টার্গেটে পরিণত হয়। তাদের যেখানেই পাওয়া যাচ্ছিল গ্রেফতার করা হচ্ছিল। বলা হচ্ছিল কয়েক দিনের মধ্যে ৯ হাজারের বেশি মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কেবল রাজধানী ঢাকা থেকেই কয়েক হাজার গ্রেফতার করা হয়ে আতংক তৈরি করার জন্য।
২৭ জুলাই শনিবার বিকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করে নূরুল হক নূরের স্ত্রী মারিয়া আক্তার বলেন, গত শনিবার (২০ জুলাই) ভোর রাতে দরজা ভেঙে কিছু সাদা পোশাক ও কয়েকজন পুলিশি পোশাকে এসে ঘুমন্ত নুরকে তুলে নিয়ে যায়। এরপর ডিবি কার্যালয়, র্যাব কার্যালয় ও হাতিরঝিল থানায় খোঁজ নিলে তারা কোনো তথ্য দেয় নাই। নিরুপায় হয়ে আমি কোর্টে যাই। সেদিন আর কোর্টে তোলেনি। ভেবেছিলাম আমার স্বামীকে আর খুঁজে পাব না। পরে জানতে পারলাম একদিন পর কোর্টে তোলা হবে। গিয়ে যা দেখলাম তা কোনো মানুষ সহ্য করতে পারবে না। গ্রেফতারের পর থেকে তার ওপর নির্যাতন করা হয়েছে। এমন নির্যাতন করা হয়েছে যে, নুর নিজের পায়ে হেঁটে আদালতে আসতে পারেনি। পুলিশ সদস্যদের কাঁধে ভর করে আদালতে আসে। স্ত্রী হিসেবে এমন নির্যাতন কোনোভাবে সহ্য করার মত নয়। অপাশবিক নির্যাতনের পরও তাকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।
নুরের চিকিৎসার দাবি জানিয়ে মারিয়া আক্তার বলেন, আমার অনুরোধ সন্তানের জীবন থেকে বাবার স্নেহ যেন কেড়ে নেওয়া না হয়। আমার সন্তানদের তো অধিকার আছে । এদেশে জন্ম নেওয়াটাই আমাদের পাপ ? আমি দাবি জানাই নুরকে আর যেন রিমান্ড নেওয়া না হয়। তার চিকিৎসা ব্যবস্থা যেন করা হয়। প্রয়োজনে আমার স্বামীকে আমি রাজনীতি করতে দিব না। তবুও অনুরোধ আমার স্বামীকে ফিরিয়ে দিন। এমন নির্যাতন হলে নূর বাঁচবে না।
তিনি আরও বলেন, যেদিন ঘুমন্ত নুরকে গ্রেফতার করা হয় সেদিন ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চের মতো মনে হয়েছিল। আমার বড় সন্তান নুরের গলা ধরে ঘুমিয়েছিল। নুর উঠতে পারছিল না। তারা আমাকে এমনভাবে ধরেছে। মেয়েকে রেখে বাবাকে নিয়ে গেল। আমার মেয়ে ট্রমায় পড়ে গেছে।
নুরকে রিমান্ডে নিয়ে ইলেকট্রিক শক দেওয়ার অভিযোগ করে মারিয়া আক্তার আরো বলেন, নুরের পা ওপরে বেঁধে পেটানো হয়েছে। ইলেকট্রিক শক দেওয়া হয়েছে। ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে, সেটি স্লো পয়জনিং কিনা আমার জানা নেই। অনুরোধ জানাই তার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা হোক। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যারা আছেন তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। সংবাদ সম্মেলনে নুরের বাবা ইদ্রিস আলী ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। এসময় নুরের ছোট ভাইকেও গ্রেফতারের অভিযোগ করেন তারা। সূত্র জানাচ্ছে, এখন পর্যন্ত রাজধানী ঢাকাসহ সারদেশের যে সব মামলা হয়েছে তার বেশিরভাগ মামলার বাদী পুলিশ। আবার কোথাও কোথাও সরকারদলীয় নেতাকর্মীরাও মামলার বাদী হয়েছেন। পুলিশের দেয়া তথ্যমতে এর মধ্যে শুধুমাত্র রাজধানী ঢাকায় মামলা হয়েছে ২০৯টি।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মুখপাত্র ফারুক হোসেন বিবিসিকে জানিয়েছেন, বিভিন্ন অভিযোগে ঢাকায় যে সব মামলা হয়েছে এসব মামলায় আড়াই হাজারেরও বেশি ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে। এর মধ্যে বিএনপি, জামায়াত, গণঅধিকার পরিষদসহ কিছু রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীও রয়েছে। দেশের বিভিন্ন থানায় যে সব মামলা হয়েছে এসব মামলায় অজ্ঞাতনামা অনেককে আসামী করা হয়েছে। প্রায় প্রতিদিন রাতেই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা ব্লক রেইড দিয়ে যৌথ অভিযানের মাধ্যমে অনেককে গ্রেপ্তারেরও খবর পাওয় যাচ্ছে।
পরে তাদেরকেই অজ্ঞাত মামলায় আসামী করে আদালতে পাঠানো হচ্ছে। তাদের মধ্যে কারও কারও রিমান্ড চাওয়া হচ্ছে। আবার রিমান্ড ছাড়াই কোন কোন আসামীকে আদালত থেকে পাঠানো হচ্ছে কারাগারে।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে শনিবার নারায়ণগঞ্জে যান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন শেষে জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এসময় তিনি বলেন, কোটা আন্দোলনের সমন্বয়কারী তিনজনকে নিরাপত্তা হেফাজতে রাখা হয়েছে। কারা তাদের আক্রমণ করতে চায় সে বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এসময় কথা বলেন কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের নতুন আট দফা দাবি নিয়েও। তিনি বলেন, ছাত্র আন্দোলনের নেতারা নতুন যে ৮ দফা দাবি দিয়েছিলেন সে প্রসঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন এগুলোর মধ্যে যৌক্তিক দাবিগুলো ক্রমান্বয়ে মেনে নিবেন। কিন্তু সেই সুযোগ শিক্ষার্থীরা দেন নি। তিনি দাবি করেন, একটি মহল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আক্রমণকারীদের প্রধান আক্রোশই ছিল পুলিশ এবং আওয়ামী লীগের প্রতি। আমাদের র্যাব, পুলিশ, বিজিবি যখন একত্রে পারছিল না তখন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য সেনাবাহিনীর সহযোগিতা চেয়েছি। খুব শিগগিরই আমরা এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাবো।
পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “কোটা আন্দোলনকারীদের কমপ্লিট শাটডাউন, আর তার ফলাফল আজকের এই অবস্থা। সমস্ত দাবি মেনে নেওয়ার পরেও তাদের আর সেই শাটডাউন শেষ হয় না, কী কারণে আমি বুঝি না। আমরা তো সবগুলো দাবিই মেনে নিয়েছি”। এই আন্দোলন ঘিরে প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষতির কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আজকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে সব একদিকে ছারখার, আর আজকে কত মানুষ জীবন হারাল! কতগুলো মানুষ পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে! তিনি বলেন, “২০০৮ এর বাংলাদেশ আর ২০২৪ এর বাংলাদেশ এক না। মানুষের জীবন মান উন্নত হয়েছে। অর্থনীতি কত উপরে উঠে গিয়েছিলো। এটা আর কিছুই না, আমাদের দেশকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে আবার ভিক্ষুক জাতিতে পরিণত করা, এটাই বোধহয় এদের পেছনে ষড়যন্ত্র। পরে শেখ হাসিনা ক্ষতিগ্রস্ত সেতু ভবন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ পরিদর্শন করেন। তিনি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল প্লাজার ক্ষয়ক্ষতিও ঘুরে দেখেন।
শনিবার সড়ক পরিবহন মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের রাজধানীর বনানীতে ক্ষতিগ্রস্ত সেতু ভবন পরিদর্শনে গেলে সেখানে তাকে মেট্রোরেল কবে চালু হবে তা জানতে চান সাংবাদিকরা। জবাবে মি. কাদের বলেন, “মেট্রোরেলের কাজীপাড়া ও মিরপুর-১০ স্টেশন ধ্বংসপ্রাপ্ত। এটা এক বছরেও যন্ত্রপাতি এনে সচল করা সম্ভব হবে না বলে এক্সপার্টরা জানিয়েছেন।' কবে নাগাদ মেরামত হবে এ প্রসঙ্গে সরকারের এই মন্ত্রী মন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে সিদ্ধান্ত নেবেন, ওই সিদ্ধান্তের ওপর আমরা পর্যায়ক্রমে যেখানে যা করার সেটা করব। তার সিদ্ধান্তের আগে আমরা কোনও কিছু করতে চাই না”। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দাবি করেন, মেট্রোরেলের স্টেশনসহ সরকারি বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা ছাত্ররা করেনি। হামলা ও আগুনের ঘটনায় জড়িত ছিল বিএনপি-জামায়াত।
রোববার ২৮শে জুলাই থেকে আগামী ৩০শে জুলাই মঙ্গলবার পর্যন্ত সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি অফিস চলবে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত। কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে শনিবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে নতুন এই সময়সূচী ঘোষণা করা হয়।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ শিবলী সাদিক বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আগামী মঙ্গলবার পর্যন্ত সরকারি অফিস আদালতের জন্য নতুন এক সময়সূচী ঘোষণা করা হয়েছে। পরবর্তী সময়সূচী কি হবে তা মঙ্গলবার বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হবে”। তিন দিনের জন্য সরকারি অফিস সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত চালু থাকলেও ব্যাংকের জন্য নতুন সময়সূচী নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এদিন শনিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, সারাদেশের সব ব্যাংক খোলা সকাল ১০টা থেকে বিকেল সাড়ে তিনটা পর্যন্ত খোলা থাকবে। তবে লেনদেন চলবে সকাল দশটা থেকে বিকেল তিনটা পর্যন্ত। কোটা আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়লে গত রবি ও সোমবার নির্বাহী আদেশে সরকারি ছুটি ঘোষণা করে। পরে তা মঙ্গলবার পর্যন্ত বাড়ানো হয়। গত বুধ ও বৃহস্পতিবার আংশিকভাবে খোলে সরকারি অফিস। সে দু’দিন বেলা ১১টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত অফিস খোলার সিদ্ধান্ত নেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
এদিন জানা যায়, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সংঘাত, প্রাণহানি এবং ধ্বংসযজ্ঞের ঘটনায় উদ্বেগের কথা জানায় ঢাকাস্ত পশ্চিমা ১৪ দেশের দূতাবাস ও হাইকমিশন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের কাছে লেখা এ চিঠিতে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে চলমান সংকটের একটি টেকসই সমাধান খুঁজতে ও নতুন করে প্রাণহানির ঘটনা এড়াতে উৎসাহ দেন তারা। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, স্পেন, নেদারল্যান্ডস, কানাডা, সুইজারল্যান্ড, সুইডেন, ডেনমার্ক, নরওয়ে, অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ঢাকাস্থ ডেলিগেশন প্রধান কার্যালয়ের প্রতিনিধির সই সম্বলিত ওই চিঠিতে সংকট সমাধানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাত্রাতিরিক্ত বল প্রয়োগের জবাবদিহিতা, আটক ব্যক্তিদের বিচারে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ এবং যত দ্রুত সম্ভব সারাদেশে পুরোদমে ইন্টারনেট চালুর অনুরোধ জানানো হয়েছে।
চিঠিতে আরও বলা হয়, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সংঘাত ও সহিংসতায় জড়িত সন্দেহে আটক ব্যক্তিদের বিচারে মানবাধিকার সমুন্নত রাখা জরুরি। প্রকৃত অপরাধীর বিচারের পাশাপাশি সাধারণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সমাবেশের অধিকারসহ সর্বজনীন মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে হবে। এতে বলা হয়, আন্দোলনকে ঘিরে কারফিউ জারি ও ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় সব নাগরিকের জীবনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ছে। এতে করে দেশে-বিদেশে ব্যবসা বাণিজ্যে বিঘœ ঘটার পাশাপাশি যোগাযোগে বাধা তৈরি হয়েছে।