রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনার সময় আর একদিন বাকী। আজকের রাত পোহালেই ২১ সেপ্টেম্বর। এরমধ্যেই জুলাই সনদের চূড়ান্ত বাস্তবায়নের সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে চায় ঐকমত্য কমিশন। বাস্তবতা সেইদিকেই যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। সেইসাথে চারদিক অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এবং বিশেষজ্ঞ মহল থেকে সাংবিধানিক আদেশেই জুলাই সনদ বাস্তবায়নের দাবি উঠছে। বলা হচ্ছে, টেকসই আগামীর বাংলাদেশের জন্য জুলাই সনদ বাস্তবায়ন জরুরী। রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌছাতে ব্যর্থ হলে বিশেষজ্ঞরা অধ্যাদেশ, নির্বাহী আদেশ, গণভোট ও বিশেষ সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়েছেন। মূলত এগুলোই বিকল্প প্রস্তাব।

গত ১৭ সেপ্টেম্বর রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনার পর অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানিয়েছিলেন, গণভোট ও সাংবিধানিক আদেশ এই দুটো বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে ভিন্নমত ছিল তা কাটিয়ে উঠে বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে দ্রুতই আমরা ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারব।

শেষ কথা হলো একটি বড় রাজনৈতিক দল জুলাই সনদ নির্বাচনের পর বাস্তবায়ন করার পক্ষে। তাদের মতামত দেওয়ার জন্য আর একদিন সময় হাতে আছে। আবার কোন কোন দল গণভোট চায়। এজন্য আটকে আছে জুলাই সনদের বাস্তবায়ন। সবশেষ দুটি বিষয় নিয়ে কথা হলে কোনটা বেশি জুতসই তা নিয়ে চলছে আলোচনা। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন সবচেয়ে জুতসই পদ্ধতি হচ্ছে সাংবিধানিক আদেশে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করা।

সংবিধান বিশেষজ্ঞ এডভোকেট শিশির মনির মতামত দিয়ে জানিয়েছেন, গণঅভ্যুত্থান এবং জনগণের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে হবে। আর তা করতে বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ জারি করতে হবে। তিনি বলেন, ১০৬ অনুচ্ছেদের বেড়াজাল থেকে বের হতেই হবে। এটাই একমাত্র সমাধান।

তিনি ইঙ্গিত দেন, এ ধরনের বিষয় রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক স্তরে সমাধানের বিষয়। আদালতের এখতিয়ার এখানে প্রযোজ্য নয়। সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের মতামত নিতে পারেন, কোনো গুরুত্বপূর্ণ আইনি প্রশ্নে। তবে এটি বাধ্যতামূলক নয় এবং তা আদালতের রায় নয়, কেবল পরামর্শ। শিশির মনিরের বক্তব্য মূলত এই অনুচ্ছেদের সীমাবদ্ধতা ও কার্যকারিতা ঘিরে। তার মতে, জনগণের ক্ষমতা ও অভিপ্রায়কে বাস্তবায়নের জন্য নতুন ধরনের সাংবিধানিক কাঠামো দরকার, যা ১০৬ অনুচ্ছেদের সীমার বাইরে।

রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ৩০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। বৈঠকে এসব বিষয়ে বিস্তারিত উঠে আসে। বৈঠক শেষে ব্রিফিংয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, নির্বাচন অনিশ্চিত বা বাধাগ্রস্ত হলে পতিত ফ্যাসিবাদ এবং অসাংবিধানিক শক্তি লাভবান হবে। এ সময়ে তিনি আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) নিয়ে (জামায়াতসহ অন্যান্য দল) রাজপথ ছেড়ে আলোচনার টেবিলে আসার আহ্বান জানান।

জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে বিলম্ব হলে জনগণ আবারও রাস্তায় নামবে। তিনি বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন হতে হবে জুলাই সনদের ভিত্তিতে।

জুলাই সনদে মোট ৮৪ ধারা বা সিদ্ধান্ত আছে। এরমধ্যে বেশ কিছু সিদ্ধান্তে কোনো কোনো দলের নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমত) রয়েছে। সনদ বাস্তবায়নে তিন ধরনের প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে। বেশ কিছু সিদ্ধান্ত সরকারের নির্বাহী আদেশে বাস্তবায়ন করা যায়। কিছু সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অধ্যাদেশ জারি করতে হবে। আর প্রায় ৩৪টি ধারা বাস্তবায়নে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। এক্ষেত্রে নির্বাহী আদেশ এবং অধ্যাদেশ দিয়ে যে সব ধারা বাস্তবায়ন করা যাবে, সেক্ষেত্রে সব দল একমত। তবে যে সব ধারা বাস্তবায়নে সংবিধান সংশোধন করতে হবে, সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে বিভক্তি আছে। বিএনপি বলছে, সংসদ ছাড়া সংবিধান সংশোধন সম্ভব নয়। ফলে আগামী নির্বাচিত সরকার পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে সংবিধান সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন করবে।

জামায়াতে ইসলামী বলছে, গণভোট অথবা বিশেষ সাংবিধানিক আদেশে বাস্তবায়ন করতে হবে। আর এনসিপি চায় গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন। ইতিমধ্যে জামায়াতে ইসলামী আন্দোলনে রাজপথে আছে। এ অবস্থায় বিলম্ব না করে চূড়ান্ত সুপারিশ করতে যাচ্ছে কমিশন।

আলী রীয়াজ বলেন, জুলাই সনদের সংবিধান সংশ্লিষ্ট সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে একটি সমন্বিত পরামর্শ বা অভিমত পাওয়া গেছে। এর আগে তাদের দুটি বিকল্প প্রস্তাব ছিল। তা হলো ‘গণভোট‘ এবং ‘সংবিধান আদেশ‘। এ পর্যায়ে সমন্বিত করে তারা একটি চূড়ান্ত অভিমত দিয়েছেন।

এতে তারা বলেছেন, জুলাই ঘোষণাপত্রের ২২ দফা অনুসরণ করে একটি ‘সংবিধান আদেশ’ জারির মাধ্যমে জুলাই সনদের সংবিধান সংশ্লিষ্ট সুপারিশগুলো কার্যকর করা যায়। এই ‘সংবিধান আদেশ’ একটি গণভোটের মাধ্যমে জনগণের চূড়ান্ত অনুমোদন লাভ করতে পারে। গণভোট আয়োজনের বিষয়টি ‘সংবিধান আদেশে’ উল্লেখ থাকবে। আর গণভোট আগামী সংসদ নির্বাচনের একইদিনে অনুষ্ঠিত হবে।

তিনি আরও বলেন, কমিশনের মেয়াদ এক মাস বাড়ানো হয়েছে। কমিশন কোনো অবস্থাতেই এক মাস সময় নিয়ে এই আলোচনা অব্যাহত রাখতে উৎসাহী নয়। আমরা মনে করি না যে আগামী এক মাস ধরে এ বিষয়ে আমাদের আলোচনা করতে হবে। আমরা খুব দ্রুত একটা ঐকমত্যের জায়গায় উপনীত হতে পারব।

ঐকমত্য কমিশনের এই সহসভাপতি বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে ২১ সেপ্টেম্বরের মধ্যেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে চায় কমিশন। জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দিতে প্রধান উপদেষ্টা ২১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে যাবেন এবং ২ অক্টোবর তিনি দেশে ফিরে আসবেন।