যুক্তরাষ্ট্রকে রপ্তানি পণ্যে বিগত দিনে ১৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে আসছে বাংলাদেশ । চলতি বছর থেকে ৩৫ শতাংশ বাড়তি শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। ১ আগস্ট থেকে এটি কার্যকর হবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সোমবার চিঠি দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে বিষয়টি জানিয়েছেন। যদিও শুল্ক কমানো নিয়ে দুপক্ষের মধ্যে দরকষাকষি চলছে। বুধবার রাতে মার্কিন পক্ষের সাথে এনিয়ে বাংলাদেশী প্রতিনিধিদের আরেক দফা আলোচনার কথা রয়েছে।
তবে শেষ বলতে কিছু নেই কারণ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন ঘোষণা করেছিল, ‘৯০ দিনে ৯০টি বাণিজ্য চুক্তি’ করবে। তবে গতকাল বুধবার ৯ জুলাই প্রথম সময়সীমা পার হলেও একটি উল্লেখযোগ্য চুক্তিও সম্পন্ন হয়নি, বরং শুল্ক আরোপের সময়সীমা আগস্ট পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এসময়সীমা থাকা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন অনেকে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, ১ আগস্ট আসতে বাকি মাত্র ২১ দিন। এ সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের সঙ্গে ভালোভাবে দরকষাকষি করতে পারলে শুল্কহার কমতে পারে। অন্যথায় ঘোষিত হারই কার্যকর হবে। সেক্ষেত্রে বিপদের শেষ থাকবে না।
এদিকে অতিরিক্ত এ শুল্কহার কার্যকর হলে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়ার শঙ্কায় রয়েছে দেশের পোশাকশিল্পসহ রপ্তানি খাত। বিশেষ করে পোশাক খাতে বড় ধরনের অশনিসংকেত দেখা দিতে পারে। কারণ, ট্রাম্প প্রশাসনের এ পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশী পণ্যের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা অনেকটা কমিয়ে দেবে। চীন-পাকিস্তান-ভিয়েতনামের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হবে আমাদের।
যুক্তরাষ্ট্র হলো বাংলাদেশের পোশাক খাতের সবচেয়ে বড় বাজার। এই বাজারে যদি এতো শুল্ক দিতে হয় তবে তৈরি পোশাক শিল্পের মুনাফা কমে যাবে। এছাড়া এর প্রভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বাজারেও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এমনটিই মনে করেন বিশেষজ্ঞ ও পোশাকশিল্পের ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা।
যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিনির্ধারণী মহল থেকে আশা প্রকাশ করে বলা হচ্ছে, এ শুল্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এখনো আলোচনা অব্যাহত আছে। আজ আরেক দফা আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে। ওয়াশিংটন ডিসিতে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির দপ্তরের (ইউএসটিআর) সঙ্গে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বৈঠক করবেন। এছাড়া নতুন শুল্কহার নিয়ে ১০, ১১ ও ১২ জুলাই ইউএসটিআর-এর সঙ্গে নেগোসিয়েশন বৈঠক রয়েছে বাংলাদেশের। বৈঠকগুলোর পর শুল্কহার আরও কমে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, দেশের রপ্তানি আয়ের ৮৪ ভাগই আসে তৈরি পোশাক থেকে। আর একক দেশ হিসাবে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি তৈরি পোশাক রপ্তানি করে। গত বছর মোট রপ্তানির ১৮ শতাংশ ছিল যুক্তরাষ্ট্রে। দেশটির বাজারে মোট রপ্তানি পণ্যের ৮৭ শতাংশ হচ্ছে তৈরি পোশাক। গত বছর বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ৭৩৪ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে।
মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধির দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে ৮৩৬ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। এর বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২২১ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। এই হিসাবে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য-ঘাটতির পরিমাণ ৬১৫ কোটি ডলার।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি শুল্ক কমানোর শর্ত হিসাবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে যেসব পণ্য বাংলাদেশ আমদানি করে সেসব পণ্যে পর্যায়ক্রমে শুল্ক, ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক, রেগুলেটরি ডিউটি হ্রাস চেয়েছে। এরই অংশ হিসাবে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বিদ্যমান বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। বিশেষ করে সরকারি খাতে ফুড ড্রিংক, বোয়িং বিমান ও মিলিটারি ইক্যুইপমেন্ট কেনার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে গুরুত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা গম, সয়াবিন এয়ারক্রাফট ও অন্যান্য মেশিনারির ওপর ডিউটি খুব কম। তুলা আমদানিকে আরও অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। তুলা আমদানির ওপর ২ শতাংশ এআইটি আছে। সেটি প্রত্যাহার নিয়ে আলোচনা হচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সঙ্গে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা আমদানি যাতে বেশি হয় সেজন্য কিছু সুবিধা দেওয়ার চিন্তা করছে সরকার।
ট্রাম্প প্রশাসনের লক্ষ্য ছিল ‘পারস্পরিক শুল্ক’। শুল্কের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি কমানো এবং উৎপাদন খাতকে সুরক্ষা দেওয়া। ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্ট জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ঘাটতির ৯৫ শতাংশের জন্য দায়ী ১৮টি দেশের সাথে বাণিজ্য বৈষম্য দূর করাই মূল লক্ষ্য।
তবে বাস্তবতা হলো, হোয়াইট হাউজের চাপ সত্ত্বেও জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ইউরোপ এবং চীন নিজেদের অবস্থানে অনড় থেকেছে। জাপানের অর্থমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ঋণদাতার ভূমিকা ব্যবহার করে চাপের জবাব দেওয়ারও ইঙ্গিত দিয়েছেন।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ দেখছে, বাণিজ্য যুদ্ধের হুমকিতে মার্কিন বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয় এবং খুচরা বিক্রেতারা শুল্কের কারণে পণ্যের দাম বৃদ্ধির আশঙ্কা জানিয়ে হোয়াইট হাউজকে সতর্ক করছে। অন্যদিকে, শুল্ক আরোপের আগে পণ্য মজুদের কারণে বাণিজ্যে সাময়িক বৃদ্ধি হলেও এখন উল্লেখযোগ্য হারে আমদানি হ্রাস পেয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে চীনা রপ্তানি এ বছর প্রায় ৯.৭ শতাংশ কমেছে। তবে চীনের রপ্তানি অন্য দেশে বেড়েছে, যেমন যুক্তরাজ্যে ৭.৪ শতাংশ, আসিয়ান দেশগুলোতে ১২.২ শতাংশ এবং আফ্রিকায় প্রায় ১৯ শতাংশ। এতে স্পষ্ট, যুক্তরাষ্ট্র যখন শুল্কের প্রাচীর তুলছে, বাকি বিশ্ব একে অপরের সাথে বাণিজ্য সম্প্রসারণে মনোযোগী হচ্ছে।
ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করেছিল, শুল্ক আরোপে ডলারের মান বৃদ্ধি পাবে এবং মূল্যস্ফীতি রোধ হবে। কিন্তু বাস্তবে ডলারের মান ১০ শতাংশ কমেছে, যা মূল্যস্ফীতি বাড়ার ঝুঁকি তৈরি করছে।
শুল্ক আরোপ থেকে আয় বাড়লেও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্যের দামের উপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে প্রায় ১৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করছে, যেখানে গত ৪০ বছর ধরে এ হার ২-৪ শতাংশের মধ্যে সীমিত ছিল।
বাজার আপাতত স্থিতিশীল থাকলেও বিশ্লেষকরা সতর্ক করছেন, যদি ট্রাম্প প্রশাসন বাণিজ্য চুক্তির পরিবর্তে শুল্ক আরোপের উপর নির্ভর করে, তাহলে মার্কিন বাজারে নতুন করে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে এবং বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থায় বড় ধরনের আঘাত আসতে পারে।
বিশ্লেষকদের মতে, শুল্ক আরোপ ও বাণিজ্য যুদ্ধে একতরফা পথে হাঁটার পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এখন গুরুত্বপূর্ণ হলো কার্যকর কূটনীতি ও বাণিজ্য আলোচনার মাধ্যমে স্থিতিশীল সমাধানের দিকে এগিয়ে যাওয়া। তা না হলে, ট্রাম্প প্রশাসনের এই কৌশল যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে মূল্যস্ফীতি এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বিচ্ছিন্নতার ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে তুলবে।