রাজধানীর উত্তরায় বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় দগ্ধদের ঢাকা মেডিকেল কলেজের জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে নেয়া হয়েছে। গতকাল সোমবার বেলা সাড়ে ৩টা পর্যন্ত সেখানে অন্তত ৬০ জনকে ভর্তি করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, দগ্ধদের বেশির ভাগই শিক্ষার্থী। অধিকাংশের অবস্থা আশংকাজনক। এমনকি অনেকের শরীরের ৮০-৯০ শতাংশ পুড়ে গেছে বলে জানান তারা। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শিক্ষার্থীদের স্বজনরা বাইরে আহাজারি করছেন। অনেকেই তাদের সন্তানদের খুঁজছেন। দগ্ধরা কি অবস্থায় আছে, নাকি মারা গেছে তারা নিশ্চিত হতে চাচ্ছেন।
দুর্ঘটনার পর থেকেই অনেক শিক্ষার্থী নিখোঁজ রয়েছেন। আতঙ্কগ্রস্ত অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের খোঁজে হাসপাতাল ও আশপাশের এলাকায় ছুটছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইতোমধ্যেই নিখোঁজদের ছবি পোস্ট করে অনেকে সাহায্য চেয়েছেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, বার্ন ইউনিটে আর ১০-১৫ জনকে ভর্তি করে রাখা যাবে। এরপর জায়গা সংকুলান না হলে বাকীদের ঢাকা মেডিকেলসহ অন্যান্য হাসপাতালে স্থানান্তর করা হবে বলে। এছাড়াও জরুরী অবস্থা বিবেচনায় হাসপাতালের সকল ডাক্তারদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে বলে জানান তারা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, উত্তরায় বিমান বিধ্বস্তের ভয়াবহ ঘটনায় দগ্ধ অর্ধশতাধিক মানুষের স্বজনদের কান্নায় ভারী হয়ে উঠে জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আঙিনা। সন্তান, নাতি, ভাই-বোনের জন্য স্বজনদের আহাজারি ও আর্তনাদে চারপাশে এক হৃদয়বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে এমন দৃশ্য দেখা যায়। নিহতদের মধ্যে নাহিদ হাসান নামের একজন রয়েছে। নিজের নাতনিকে হারিয়ে আহাজারি করছেন মোহাম্মদ মোসলেম উদ্দিন। তিনি বলেন, আমার প্রিয় নাতনি নাহিদ হাসান উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ত। বাসা থেকে হেঁটে আসতে ৫/৭ মিনিট লাগে। আমার কলিজার টুকরা নাই। না করছি, বড় স্কুল কলেজে পড়াইস না। জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সামনে রাস্তায় বসে এভাবেই আহাজারি করেন মোসলেম উদ্দিন। এদিকে, বার্ন ইনস্টিটিউটে অবস্থানরত চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, বেশিরভাগ দগ্ধ শিক্ষার্থীর অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাদের চিকিৎসা দিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। একইসঙ্গে স্বজনদের মানসিকভাবে শক্ত রাখতেও সহায়তা করছে হাসপাতালের কাউন্সেলিং টিম।
সোমবার দুপুরে উত্তরার দিয়াবাড়ি এলাকার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি এফ-৭ বিজেআই মডেলের প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়। একইভাবে কান্নায় ভেঙে পড়েন মুসলিম উদ্দিন, যিনি তার একমাত্র নাতিকে নিয়ে এসেছেন বার্ন ইনস্টিটিউটে। তার নাতিও তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে এবং বিমান দুর্ঘটনায় গুরুতর দগ্ধ হয়েছে। চোখ মুছতে মুছতে বলছিলেন, আপনারা দোয়া করেন, আমার নাতি যেনো বাঁচে। একমাত্র নাতি আমার, কী কষ্টে আছে তা বলে বোঝাতে পারবো না। একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী সাইম খান এসেছেন তার ছোট বোনকে নিয়ে। তার বোন চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী। আগুনে দগ্ধ হয়ে এখন বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি। সাইম বলেন, আমার বোনসহ যারা আহত হয়েছে, সবার জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই। কেউ যেন এমন পরিস্থিতিতে না পড়ে।
দুর্ঘটনার সময় ভবনটিতে দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী ক্লাস করছিলেন, পাশাপাশি আশেপাশের এলাকায়ও অনেক সাধারণ মানুষ অবস্থান করছিলেন। বিধ্বস্ত হওয়ার পর যুদ্ধবিমানের জ্বালানিভর্তি ফুয়েল ট্যাঙ্ক থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়ে ভবনসহ আশেপাশের এলাকায় ভয়াবহ অগ্নিকা-ের সৃষ্টি হয়। এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত আহত হয়েছেন দেড় শতাধিক, যাদের মধ্যে অনেকেই আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ, উত্তরা আধুনিক হাসপাতালসহ রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ জাহেদ কামাল বেলা পৌনে ৫টার দিকে মাইলস্টোনের দুর্ঘটনাকবলিত এলাকা পরিদর্শনের সময় এই তথ্য জানান।বিমান দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে পাইলট ফ্ল্যাইট লেফট্যানেন্ট তৌকির ইসলাম সাগর রয়েছেন। এছাড়াও, জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে দগ্ধ হয়ে মারা যাওয়া দুই শিক্ষার্থীর নাম জানা গেছে: মো. জোনায়েদ হাসান (তৃতীয় শ্রেণি, মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ) এবং মো. তানভীর আহমেদ (অষ্টম শ্রেণি, একই স্কুল)।
জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আবাসিক চিকিৎসক শাওন বিন রহমান জানিয়েছেন, দগ্ধদের বেশিরভাগই শিক্ষার্থী এবং তাদের সবার অবস্থা আশঙ্কাজনক। এখনো দগ্ধ আহতদের হাসপাতালে আনা হচ্ছে এবং হতাহতের সংখ্যা বাড়বে বলে মনে হচ্ছে। হাসপাতালে ভর্তি ও পরিচয়কৃত দগ্ধদের তালিকা (৩৬ জন): ১. শামীম ইউসুফ (১৪), ২. মাহিন (১৫), ৩. আবিদ (১৭), ৪. রফি বড়ুয়া (২১), ৫. সায়েম (১২), ৬. সায়েম ইউসুফ (১৪), ৭. মুনতাহা (১১), ৮. নাফি (১০), ৯. মেহেরিন (১২), ১০. আয়মান (১০), ১১. জায়েনা (১৩), ১২. ইমন (১৭), ১৩. রোহান (১৪), ১৪. আবিদ (০৯), ১৫. আশরাফ (৩৭), ১৬. ইউশা (১১), ১৭. পায়েল (১২), ১৮. আলবেরা (১০), ১৯. তাসমিয়া (১৫), ২০. মাহিয়া (১৩), ২১. অয়ন (১৪), ২২. ফয়াজ (১৪), ২৩. মাসুমা (৩৮), ২৪. মাহাতা (১৪), ২৫. শামীম (১৭), ২৬. জাকির (৫৫), ২৭. নিলয় (১৪), ২৮. সামিয়া (১৪), ২৯. আরিয়ান (১২), ৩০. তৌফিক (১৩), ৩১. নূসরাত (১৩), ৩২. তানভীর আহমেদ (১৩) (নিহত)।
ঢাকা মেডিকেলে দগ্ধ চারজন: রাইয়ান (১৪), জুনায়েদ (১১) (নিহত), জারিফ (১২), সবুজা বেগম (৪০)। বিভিন্ন হাসপাতালে হতাহতের চিত্র (আইএসপিআর): আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) গণমাধ্যমে পাঠানো এক বার্তায় জানিয়েছে, কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে আহত ৮; বার্ন ইনস্টিটিউটে আহত ৭০, নিহত ২; সিএমএইচ-ঢাকায় আহত ১৪, নিহত ১১; কুর্মিটোলা জেনারেল হসপিটালে আহত নাই, নিহত ২; লুবনা জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড কার্ডিয়াক সেন্টার, উত্তরায় আহত ১১, নিহত ২; উত্তরা আধুনিক হসপিটাল আহত ৬০, নিহত ১; উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালে আহত ১, নিহত নেই।
‘ও নেগেটিভ’ রক্ত প্রয়োজন: বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় আহতদের চিকিৎসায় ঢাকায় জাতীয় বার্ন ইন্সটিউট এবং উত্তরায় আধুনিক হাসপাতালে জরুরি ভিত্তিতে ‘ও নেগেটিভ’ রক্ত খোঁজা হচ্ছে। উত্তরা আধুনিক হাসপাতালে ‘ও নেগেটিভ’ রক্ত প্রয়োজন। গতকাল সোমবার বিকালে আশপাশের শিক্ষার্থী স্বেচ্ছাসেবকরা রক্তের জন্য আকুতি জানাচ্ছেন। সাধারণ মানুষ রক্ত দেয়ার জন্য এগিয়ে আসছেন। তবে ও নেগেটিভ রক্ত মিলছে না। স্বেচ্ছাসেবক সিফাত বলেন, ‘উত্তরা আধুনিক হাসপাতালে ‘ও নেগেটিভ’ ব্লাড লাগবে। অন্যান্য গ্রুপের ব্লাড পাওয়া গেছে। ‘ও নেগেটিভ’ পাওয়া যাচ্ছে না।’ উত্তরা আধুনিক হাসপাতাল ছাড়াও কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল, উত্তরা উইমেন্স মেডিকেল কলেজ, মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল ও জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে আহতদের নেয়া হয়েছে। তাদের বেশির ভাগই দগ্ধ বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকরা।
হতাহতদের তালিকা দিলো আইএসপিআর
বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় আইএসপিআরের বিজ্ঞপ্তিতে নিহত ও আহত ১৮ ব্যক্তির তালিকা দেওয়া হয়। পরে ৫টা ৪০ মিনিটের দিকে আরও একটি বিজ্ঞপ্তিতে পাইলটের মৃত্যু নিশ্চিত করে বিবৃতি দেওয়া হয়। সে তালিকায় কোন হাসপাতালে কতজন আহত ও নিহত রয়েছে তা জানানো হয়েছে।
১. কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল: আহত ৮ জন, নিহত নেই
২. জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউট: আহত ৭০জন, নিহত ২
৩. সিএমএইচ-ঢাকায়: আহত ১৪ জন, নিহত ১১
৪. কুর্মিটোলা জেনারেল হসপিটাল: আহত নেই, নিহত ২
৫. উত্তরার লুবনা জেনারেল হাসপাতাল: অ্যান্ড কার্ডিয়াক সেন্টারে আহত ১১, নিহত ২
৬. উত্তরা আধুনিক হসপিটাল: আহত ৬০, নিহত ১
৭. উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতাল: আহত ১, নিহত নেই।