রাজু আহমেদ আসিফ। রাজধানীর উত্তরায় জুলাই আন্দোলনের কঠিন সময়ে পালন করেন সমন্বয়কের দায়িত্ব। তিনি লিখেছেন দৈনিক সংগ্রামে। তার লেখনিতে উঠে এসেছে স্বৈরাচার হাসিনার শেষ সময়ের চিত্র। অনুলিখন ইবরাহীম খলিল।

জুলাইয়ে আমার রক্তে আগুন লাগে; যখন মনে এই উপলব্ধি জাগ্রত হয় যে, আবু সাঈদ ভাই বুক পেতে শহীদ হয় আর আমি এখনো অফিস আর ঘরে দৌড়াদৌড়ি করি? তারপর আমার আর কখনো অফিসে ফেরা হয়নি। আইইউবিএটি’র শিক্ষার্থীরা আন্দোলন গড়ে তুলি। ইউনিভার্সিটিতে অ্যাথলেট ট্রেইনার ছিলাম, ওখানকার কিছু ছোটো ভাইদের নিয়ে ম্যাপ করি একসাথে জুলাইয়ের। ১৭ই জুলাই আমার ছোটো ভাইয়েরা ফোন করে সন্ধ্যায় বলে যে, ভাই, একটা মশাল মিছিল করা যায়? আমি বলি যে, ইউনিভার্সিটির সামনে দাঁড়াও, আসছি। এরপর আমি, সোহান, রাহাত, আশিক, সাদিকসহ কয়েকজন মিলে প্ল্যান করে প্রোগ্রাম ডেকে ফেলি। মশাল মিছিল করার জন্য বাজেট কম ছিল। পরান ছোটো ভাই সিএসই ডিপার্টমেন্টের ওরা মিলে খাবারের টাকা দিয়ে দেয়। আশে পাশে আরও ম্যানেজ হয়। রাত ৮টার পর বাংলাদেশের প্রথম মশাল মিছিল হয় এটা, সারা বাংলাদেশে থেমে যাওয়া আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। রাতে নিউজ হয় জঙ্গী শিবিরের মিছিল বলে। পানির মতো শান্ত আমি রাজপথে কিভাবে যেন চলে আসি শরীরের টগবগে রক্ত নিয়ে ! ১৮ই জুলাইয়ের জন্য ম্যাপ সাজাই। অন্য ইউনির্ভাসিটি ও স্কুল, কলেজগুলোর সাথে আমিসহ সাদিক, সোহান, যুবরাজ, মুনতাসির, রাহাত রোডম্যাপ শেয়ার করি। আইইউবিএটি গেট থেকে স্লুইচ গেইট হয়ে ১১নং সেক্টর মাইলস্টোন হয়ে জমজম টাওয়ারে শান্তা মরিয়মের স্টুডেন্টরা আমাদের সাথে এক হয়। তারপর উত্তরা আধুনিক হয়ে হাউসবিল্ডিং থেকে একদম বিএনএসে সবাইকে নিয়ে জমায়েত হই।

একটু নিজের কথা বলি, খুব সাধারণ ঘরের সাধারণ ছেলে আমি, সারাদিন অফিস করে বাসায় ফিরে উপন্যাসের বই পড়া অথবা বন্ধুদের সাথে গল্প করা এর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো আমার জীবন। আমার জীবনের একটা বড় দুর্বলতাও আছে, সেটা দেশপ্রেম। আমার মনে আছে, ক্লাস নাইনে যখন পড়তাম, বিদ্যালয়ের কালচারাল প্রোগ্রামে দেশ প্রেমিকের অভিনয় করতে গিয়ে যখন মঞ্চে উঠেছিলাম অভিনয়ের একটা পার্টে কান্নার অভিনয় করতে গিয়ে সত্যিই কেঁদেছিলাম। সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম দেশের প্রতি কি গভীর আমার টান। আমি কখনো রাজনীতিতে ছিলাম না, দেশের জন্য কখনো কিছুই করতে পারিনি। পরিবারের সবাই চাপ দিচ্ছিলো বিদেশ চলে যাওয়ার, কিন্তু আমার দেশের জন্য অনেক কিছু করার বাকি ছিলো।

যাই হউক, ১৮ই জুলাই আমার জীবনের সবচেয়ে কালো দিন ছিলো। পুলিশ-ছাত্রলীগের সাথে আমাদের ধাওয়া পাল্টা চলতে থাকে আমরা লাঠি হাতে। ওদের হাতে পিস্তলসহ ভারী অস্ত্র, পাখির মতো মারতে থাকে আমাদের। রাফসান বাবু ফোন করে বলে কুয়েত-মৈত্রী হাসপাতালের পেছনে ব্লক করে দিতে। ওখানে আমাদের একটা গ্রুপ দাঁড়িয়ে যায়। সিয়াম, মিথুন, পল্লব, রিমন, পরাণকে মেডিকেলের গেইট সেইফটির জন্য দাঁড়াতে বলি। আমি বের হয়ে যাই মেডিকেল থেকে। কয়েকজনের টিম করে একের পর এক ক্ষত-বিক্ষত শরীর নিয়ে আসা শুরু করি মেডিকেলে। পরান আমার সাথে আহতদের রেসকিউ করতে চলে আসে একটু পরেই।

পুলিশ দুপুরে সমঝোতার প্রস্তাব দিলে আমরা বোকার মতো রাজি হই। কিন্তু একটু পরেই ওরা গুলী শুরু করে। রাজউক কলেজের রোডে চলে আসি কোনোমতে বেঁচে। কলেজের সামনে পুলিশের সাদা গাড়ি থেকে গুলী করা শুরু হয় আবার। একটা গুলী আমার সামনে থাকা ছেলের শরীরে লাগে। একে নিয়ে কোনোমতে হাসপাতালে ঢুকি। এর ৫ মিনিটের মধ্যেই দেখি একের পর এক ঝাঝরা শরীর মেডিকেলে নিয়ে আসা হচ্ছে।

সাদিয়া ইউনিভার্সিটির ছোটো বোন আমার টি-শার্টে রক্ত দেখে চিৎকার করে কান্না করছিল, ভেবেছে আমি গুলী খেয়েছি। তার ওপর আমার ভাগিনা নাফিম রাবার বুলেট খেয়ে হসপিটালে। নাফিমকে রেখে বের হতে যাবো মেডিকেল থেকে; আরো গুলী খেয়েছে যারা তাদের আনতে হবে কিন্তু সিয়াম আটকায় আমাকে, ৫টা বাজে তখন। পরান ও আমি জোর করে বের হই। আজমপুর ওভারব্রীজের নিচে একটা ডেডবডি পড়ে আছে। আনতে চাচ্ছি। কিন্তু তখন এতো গুলী আর সাউন্ড গ্রেনেড মারা শুরু হয় যে, আশে পাশে শুধু ছেলে-মেয়েরা গুলী খেয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়ছে, দেখছি। পরান আমাকে হাত টেনে নিয়ে পেছনে যাচ্ছে আর বলছে, ভাই আমার কসম লাগে আপনি আর সামনে যায়েন না। অনেকগুলো লাশের হিসাব মাথায় ঘুরছিলো তখন। কি থেকে কি হয়ে গেলো! মুগ্ধ, আশিক পানি সেধেছিল, পানি তখন নেইনি কিন্তু মুগ্ধ এখন আর নেই। নর্দানের আসিফের লাশ পতাকা দিয়ে ঢাকা। একজন বাবা গড়াগড়ি দিয়ে কাঁন্না করছে। তার ছেলে শহীদ হয়েছে। আইইউটিতে পড়ে শুনলাম। রক্ত দেখলে আমার মাথা ঘুরে। কিন্তু আজ গুলী খেয়ে আমার শরীরের ওপর যেই ছেলেটা শরীর হেলিয়ে দিলো এর গরম রক্ত আমার শরীর বেয়ে পড়ছে, আমি ওকে জড়িয়ে ধরে রেখেছি!

আইইউবিএটি’র ভাইবোনগুলোর সবার খবর এখনো পাইনি। তানভীর নামে একজন শহীদ হয়েছে। আইইউবিএটি’র অনেকে বলছে, কিন্তু সঠিক ইনফরমেশন পাইনি। সন্ধ্যা হলে আমি, সিয়াম, নাফিম, পরান, পল্লব, মিঠুন, রিমন রেইললাইন দিয়ে পালিয়ে বাসায় ফিরি। পল্লব, রিমন দুইজনের শরীরে রাবার বুলেটে বাজে অবস্থা।

রেস্ট নিচ্ছিলাম সবাই, রাত তখন ১টা বাজে আমরা ২০ নং রোডে থাকি কামার পাড়ায়, পুলিশ ঢোকা শুরু করলো গভীর রাতেই। এই রোডে শুধু একটাই ব্যাচেলার বাসা। এর আগে ১০, ১১, ১২ নং রোডের দিকে তল্লাশি হয়েছে। আমরা তখন বাসা ছেড়ে রাজাবাড়ী পালাই। শহীদুল ভাইদের বাড়িতে উঠি। রাস্তা খারাপ তাই পুলিশের গাড়ি যেতে পারে না। এরপর ফোনে কল করে করে যোগাযোগ রেখে আন্দোলন করতে থাকি, কিন্তু নেট অফ হওয়ায় বড় মিছিল আর করতে পারছিলাম না।

২রা আগস্ট শুক্রবার। গত রাত বৃহস্পতিবারেই আমরা উত্তরার ইন্সটিটিউটগুলো প্ল্যান করি শুক্রবার আমরা মিছিল নিয়ে নামবো না। কিন্তু জুম্মার পর ১১নং সেক্টরে মাইলস্টোনের স্টুডেন্টরা রাস্তায় নেমে যায়। ওদেরকে ছাত্রলীগ ঘিরে ধরে। আমি, সিয়াম তখন নরমালি ফিল্ড অবজার্ভ করছিলাম। সিচুয়েশন খারাপ হতে থাকে, আইইউবিএটি, শান্তা মারিয়াম থেকে কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থী মাইলস্টোনের এখানে চলে আসে। আকাশ ৬নং সেক্টর থেকে মিছিল নিয়ে এদিকে ঢুকে। এরপর শুরু হয় তুমুল লড়াই। ছাত্রলীগের সবার হাতে অস্ত্র, আমরা ১১ নং সেক্টরের বিল্ডিংগুলোতে অনুরোধ করতে থাকি দরজা খোলার জন্য। অন্তত মেয়েগুলোকে যেন নিরাপদ আশ্রয়ে রাখা যায়। একজনের পায়ে ধরি আমি গেইট খোলার জন্য। গেইট খুললে সিয়ামসহ অনেকে বিল্ডিংয়ে ঢুকে পড়ে। তাদের সাথে আমিও ঢুকি। কিন্তু ভিতরে ঢুকে দেখি একটা ছেলের গায়ে গুলী লেগেছে। তার অবস্থা খারাপ। নোমান (আইইউবিএটি), আমি ওকে নিয়ে বের হই।

মনসুর আলী মেডিকেল আমাদেরকে ফিরিয়ে দেয়। ওকে চিকিৎসা দেয় না। এরপর লেইক ভিউতে আশ্রয় নেই। পাশাপাশি ২টা বিল্ডিং আর লেইক ভিউ মেডিকেল ছাত্রলীগ ঘিরে ফেলে। অবস্থা বেগতিক দেখে সিয়াম আমাকে ফোন দিয়ে শেষ বিদায় নেয়। তখনো চাপাটি দিয়ে ছাত্রলীগ তালা ভাঙছিলো।

সিয়াম বলে, রাজু তোর কাছে দাবি হলো আমার লাশটা পেলে আমার পরিবারের কাছে পাঠাইস। আমিও একই দাবি করি সিয়ামের কাছে। সেদিন ৩ দিক দিয়ে ছাত্রলীগ ঘেরাও করে রেখেছে।

এমতাবস্থায় কিছুক্ষণ পর আল্লাহর রহমতের বৃষ্টি নামে। পিনাকি দা তখন আইইউবিএটি’র স্টুডেন্টরা কিভাবে মেডিকেল থেকে প্রতিরোধ করতেছিল তার নিউজ করে ফেলে। আর বৃষ্টিতে ছাত্রলীগেরা সরতে থাকে। তখন আমরা আহতদের নিয়ে ময়লার ভাগাড় দিয়ে ১০নং সেক্টরে পার করতে থাকি। জুলাইয়ের ৪ তারিখ আইইউবিএটি থেকে আবার একসাথে বিশাল মিছিল নিয়ে বের হই। এবার আর আমরা মাইর খাই নাই। একের পর এক ছাত্রলীগকে আক্রমণ করতে থাকি সবাই। সেন্ট্রাল থেকে যখন বলা হয় পরশু নয় কালই ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ তখন আমিও সবার সামনে প্রতিজ্ঞা করি, হাসিনার পতনের আগ পর্যন্ত রাস্তায় থাকবো। আকাশ, সাগর হাওলাদার তখন সাহস দিয়ে যাচ্ছিলো। আকাশ আর আমি রোডগুলো চেক করতে থাকি। কোথাও রিস্ক আছে কি-না? আমরা আর পিছু ফিরি না। ৫ই আগস্টের আইইউবিএটি’র গেইটে জমা হই কিন্তু স্টুডেন্টস জমায়েত খুব কম ছিল প্রথমে, অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে আমরা মাইক নিয়ে সেক্টরের সামনে অনুরোধ করেছিলাম আমরা আন্দোলনে যাচ্ছি। আপনারা আমাদের লাশ গুলো নিতে আসেন। ৫ মিনিটের মধ্যেই অনেক বড় জমায়েত হয়ে যায়। বিশাল মিছিল নিয়ে আইইউবিএটি থেকে স্লুইচ গেইট হয়ে আগের রোড ম্যাপ অনুযায়ী আগাই আমরা।

৫ই আগস্ট বাংলাদেশে প্রথম বেরিকেড ভাঙা হয় জমজম টাওয়ার উত্তরায়, এরপর একেরপর এক বিএনএস, এয়ারপোর্ট সব বেরিকেড ভেঙে ফেলি। গণভবনে পৌঁছানোর পর যখন খবর পাই হাসিনা পালাইছে। আমি তখন কান্নায় ভেঙে পড়ি আর সাথে সাথে সেজদায় পড়ে যাই।

স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তির নিশ্বাস নিচ্ছিলাম, বুক ভরে নিশ্বাস নেয়ার সে কি এক শান্তি! নতুন জীবনের স্বাদ উপভোগ করছিলাম। এটা আমার জীবনের প্রথম জয়। আকাশ, সজীব, সিয়াম আমার সাথেই ছিলো, একটু পর তাদের হারিয়ে ফেলি। রাতে খবর পাই আকাশ গুলীবিদ্ধ। শরীর ক্লান্ত হাঁটতে পারছিলাম না, এক ভাই বাইক রাইড দিয়ে পৌঁছে দিয়ে যায়।

আমার একক কোনো ক্রেডিট নিয়ে বলছি না। এখানে এই জুলাইয়ে সবার দেয়া সাপোর্ট, সাহস আর সহায়তায় আমাকে দেশের জন্য বিপ্লবী করে তুলেছিল, আমি শুধু আমার দেশের জন্য জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলাম তখন, আমার আপন বড় ভাইকে বলেছিলাম, আমি হয়তো আর ফিরবো না, মাকে দেখে রেখো।