প্রস্তাবিত ২০২৫-২৬ সালের বাজেট নিয়ে আলোচনা সভায় কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বাতিল করার দাবি জানিয়েছেন বক্তারা। কালো টাকা সাদা করার বিধানকে সম্পূর্ণ অনৈতিক, অন্যায় ও অগ্রহণযোগ্য বলে উল্লেখ করেন তারা। বাজেটে মাদরাসা শিক্ষার বরাদ্দ কমে যাওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ প্রত্যাশিত আকারে হয়নি বলে বক্তব্যে উঠে আসে। বক্তারা বলেন, জুলাই অভূত্থানের স্পিরিট ধারণ করা হয়নি প্রস্তাবিত বাজেটে। তরুণ সমাজের উন্নয়নের জন্যে বরাদ্দ বাড়ানোর আহবান জানানো হয়। বাজেট চূড়ান্ত করার আগে রাজনীতিবিদসহ বিভিন্ন অংশীজনের সাথে অলোচনা করে প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন করার আহ্বান জানানো হয় সরকারের প্রতি।
গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের মওলানা আকরাম খাঁ মিলনায়তনে ‘বাজেট সংলাপ ২০২৫’ এ প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন লেখক, প্রাবন্ধিক ও কবি ফরহাদ মজহার। সেন্টার ফর ডেমোক্রেসি এন্ড পিস স্টাডিজ আয়োজিত বাজেট আলোচনায় সভাপতিত্ব করেন নিউ নেশন পত্রিকার সাবেক সম্পাদক মুস্তাফা কামাল মজুমদার। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. মিজানুর রহমান। বিশেষ অতিথি হিসেবে আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমীর নূরুল ইসলাম বুলবুল, এফবিসিসিআই এর পরিচালক এনায়তে উল্লাহ, প্রফেসর ড. দেওয়ান সাজ্জাদ, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে) সভাপতি শহিদুল ইসলাম, বিশিষ্ট ব্যাংকার মেহতাজ হাসান, আবু আহাদ আল মামুন প্রমুখ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন আয়োজক সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক সাংবাদিক সাদিকুর রহমান।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ফরহাদ মজহার বলেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের থ্রি জিরো তত্ত্ব বাস্তবায়নের জন্যে জুলাই অভ্যূত্থান হয়নি। এই তত্ত্বকে আমরা জাতীয় নীতি আকারে গ্রহণ করি নাই। প্রস্তাবিত ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের বাজেটে কিছু ইতিবাচক দিক থাকলেও প্রস্তাবিত বাজেটকে কাঠামোগত লুটপাটতন্ত্র তৈরির দলিল বলে উল্লেখ করেন তিনি। তিনি বলেন, বাজেট লূটপাটের বৈধতা দিয়েছে।
বাজেটে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের থ্রি জিরো তত্ত্ব উল্লেখ করায়; এ বিষয়ে প্রশ্ন তুলে ফরহাদ মজহার বলেন, প্রধান উপদেষ্টাকে খুশি করার জন্যে এটা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এই বাজেটে থ্রি জিরো বাস্তবায়ন করা হবে। এটার জন্যে কিন্তু ৫ আগস্টের অভ্যত্থান হয়নি। থ্রি জিরো একটি ভালো তত্ত্ব। কিন্তু এটা নিয়ে আমাদের আলাদা বক্তব্য রয়েছে। সেটা আলাদাভাবে আলোচনা করবো। আমরা প্রশংসা করি; এটা একজন ব্যক্তির চিন্তা, স্বপ্ন। কিন্তু এই নীতি বাজেট প্রস্তাবনায় কেন? আন্তর্জাতিকভাবে এই নীতির অনেক প্রশংসা রয়েছে, থাকতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে এই তত্ত্ব সঠিক কি না; এই আলোচনা করার অধিকার আমাদের আছে। তাকে অসম্মান করার জন্য বলছি না, তবে এটা যদি বাজেটে ঢোকান তাহলে তিনি অসম্মানিত হবে।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে নির্বাচিত সরকার উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের লুটেরা-মাফিয়াতন্ত্রওয়ালারা অন্তর্বর্তী সরকারকে অনির্বাচিত সরকার বলে থাকে। আমরা এই সরকারকে মেনে নিয়েছি। কারণ জনগণ এই সরকারকে ম্যান্ডেট দিয়েছে। এ কারণে অর্ন্তবর্তী সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশাও বেশি। তিনি বলেন, এই বাজেটটা আমাদের যথেষ্ট সন্তুষ্ট করতে পারে নাই। যে স্পিরিটটা আমরা বাজেটে দেখতে চেয়েছি, সেটা দেখি নাই। ফরহাদ মজহার বলেন, গত বছরের ৮ আগস্ট সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার কথা বলে যে সরকার গঠন করা হলো, লুটপাটতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার জন্যই কিন্তু আপনি এই সরকার করেছেন। এই সরকারের আসলে কোনও ক্ষমতা নেই। এখন যে টিকে আছে এটাই বড় বিষয়।
তিনি বলেন, বাজেটে সেনাবাহিনীর জন্য আমরা কীভাবে খরচ করি তার কোনও স্পষ্ট উল্লেখ নাই। এটা হতে পারে না। আমাদের এদিকে মায়ানমার, ওদিকে ভারত। তার মধ্যে যদি আমরা টিকে থাকতে চাই, তাহলে অবশ্যই আমাকে জাতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। আর তা করতে হলে এর জন্য খরচ আছে। এটা একটা ন্যায্য খরচ। সেই খরচ আমি কোথা থেকে তুলবো, কে দেবে? এটা থাকতে হবে, যে টাকাটা কোথায় খরচ হচ্ছে? বাজেটে খরচ কোথায় হচ্ছে, এটা লুকিয়ে রাখা একটি খারাপ লক্ষণ-যোগ করেন তিনি। তিনি বলেন, আমলাতন্ত্র আমাদের একটা পরজীবী রাষ্ট্রে পরিণত করে রেখেছে।
গণঅভ্যুত্থানের পরে কালো টাকা সাদা করার বিধান নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, লুটপাটতন্ত্রের সবচেয়ে দৃশ্যমান বিষয় হলো কালো টাকা সাদা করা। অবশ্যই এটাকে সংশোধন করতে হবে। কালো টাকা এখন সাদা হয় কোন যুক্তি? গণঅভ্যুত্থানের পরে এটা করার কোনও যুক্তি নেই।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমীর মো. নূরুল ইসলাম বুলবুল বলেন, তরুণ প্রজন্মকে জাতীয় সম্পদে রূপ দিতে বাজেটে এই খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। অথচ সরকার মাত্র ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে তরুণ প্রজন্মের উন্নয়নে ব্যয় করার জন্য। ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেটের মধ্যে তরুণ প্রজন্মের জন্য মাত্র একশো কোটি টাকা বরাদ্দ অপ্রত্যাশিত ও অগ্রহণযোগ্য।
কালো টাকাকে সাদা করার সুযোগ দিলে দুর্নীতিকে বৈধতা দেওয়া হয় উল্লেখ করে নূরুল ইসলাম বুলবুল বলেন, অতীতের সরকার গুলো দলীয় নেতাকর্মীদের দুর্নীতি, অনিয়ম, লুটপাটের অর্থকে বৈধতা দিতে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েছে। ঐ সুযোগ দলীয় প্রধানও কাজে লাগিয়ে নিজের অবৈধ অর্থকে বৈধ করে নিয়েছেন। যা সম্পূর্ণ অনৈতিক, অন্যায়, অগ্রহণযোগ্য। ‘কালো টাকা এবং অপ্রদর্শিত আয়’ দুইটি আলাদা বিষয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ প্রত্যাহার করে নিবেন বলে জোরালোভাবে প্রত্যাশা করছি।
তিনি বলেন, ৫ আগস্টের গতি ও চেতনার বাজেট উপস্থাপন করতে পারেনি সরকার। প্রস্তাবিত বাজেটে সংস্কারের জন্য নিদিষ্ট বরাদ্দ রাখা হয়নি। বাজেটে মাদ্রাসা শিক্ষায় বরাদ্দ কমে যাওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন তিনি। সরকারকে এই বাজেট সংযোজন, সংশোধন করে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে কল্যাণমুখী বাজেট ঘোষণা করতে আহ্বান জানান। বাজেটে রাজনৈতিক অংশীজনসহ সকল স্টেকহোল্ডারদের সাথে পরামর্শ না করায় উস্মা প্রকাশ করেন নূরুল ইসলাম বুলবুল।
এফবিসিসিআই এর পরিচালক এনায়ত উল্লাহ বলেন, যাদের সহায়তায় ফ্যাসিস্ট সরকার দুর্নীতি, অনিয়ম করেছে, তারা এখনো প্রশাসনে বসে আছে। জুলাই আন্দোলনে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্ণরের কোন অবদান আছে কি না প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, চুরির টাকা রয়েছে আমলাদের কাছে, তারা বড় চোর। ইসলামী ব্যাংক দখলের ঘটনা বর্ণনা করে তিনি বলেন, ওই সময় রাত ১১ টা পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক খোলা রেখে বসে ছিলো তৎকালীন গভর্ণরসহ কর্মকর্তারা। ডিজিএফআই’র লোক ইসলামী ব্যাংকে গিয়ে ডাইরেক্টরদের পদত্যাগে বাধ্য করে ফ্যাসিস্টের দোসরদের দিয়ে নতুন বোর্ড গঠন করে দেয়।
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে)’র সভাপতি শহিদুল ইসলাম বলেন, সাধারণ মানুষ জানতে চায় জিনিসপত্রের দাম বাড়লো না কমলো। তারা এতো পরিসংখ্যান বুঝে না। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার বিরোধীতা করে তিনি, কালো টাকা বাজেয়াপ্ত করার প্রস্তাব দেন।
সভাপতির বক্তব্যে মুস্তাফা কামাল মজুমদার বলেন, জুলাই অভূত্থানের মাধ্যমে যুব সমাজ জাতিকে বড় একটি ডিভিডেন্ট দিয়েছে। এটা হচ্ছে জাতীয় জীবনে চূড়ান্ত ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট।