# ১২ দিনের যুদ্ধে ইসরাইলের অর্থনীতিতে বড় ধস
# ৩০ হাজার ৮০৯টি ভবন এবং ৩ হাজার ৭১৩টি যানবাহনের ক্ষতি
যুদ্ধ থেমেছে। যুদ্ধে বিধ্বস্ত ইসরাইলের বুক ফুটো করে ভেসে উঠলো গাজার চিত্র। ১২ দিন ধরে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনে ইসরাইলের তেল আবিব, হাইফা, বেয়ার শেভা শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। সামরিক ঘাঁটি ও গোয়েন্দা কেন্দ্রগুলো, ছয়টি গবেষণাগার সম্পূর্ণ ধ্বংস, ৯টি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়। বিপুল সংখ্যক ইসরাইলি নাগরিক দেশ ছেড়ে পালাতে শুরু করে, অনেকে চোরাইপথে সাইপ্রাস বা মিশরের সীমানা পেরিয়ে ইউরোপে পাড়ি জমায়। যুদ্ধ বিরতীর প্রথমদিনে বাড়িতে ফিরে ১০ হাজার নাগরিক দেখেন তাদের বাড়ি-ঘর সম্পূর্ণ ধ্বংস। হিব্রু গণমাধ্যম অনুযায়ী, এই ১২ দিনে ইসরাইলের আর্থিক ক্ষতি গাজা, লেবানন ও সিরিয়ায় ২০ মাসের যুদ্ধের ক্ষতির সমান। অবৈধ দখলদার ইসরাইলের রাজধানী তেল আবিবসহ বিভিন্ন শহরে ধ্বংস হওয়া ঘর-বাড়িতে ফিরতে শুরু করেছেন বাসিন্দারা। যুদ্ধে বিধ্বস্ত ইসরাইলের নাগরিকরা সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণ চেয়ে আবেদন করেছে প্রায় ৪০ হাজার। ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার এবং যুদ্ধ পরবর্তী পুনর্গঠনে আরও ৪০০ মিলিয়ন ডলারের অধিক ব্যয় হতে পারে। যদিও ইসরাইলের সরকারের কড়াকড়ির কারণে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সেভাবে মিডিয়াতে আসছে না। ইরানের সঙ্গে টানা ১১ দিন লড়াই চালিয়ে ১২তম দিনে গত মঙ্গলবার ২৪ জুন যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিলো ইসরাইল। ১২ দিনের যুদ্ধে ইসরাইলের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৪.৩ শতাংশ থেকে কমে ৩.৬ শতাংশে নেমে এসেছে। ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে বেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়টি গবেষণাগার ধ্বংস হয়ে গেছে এবং নয়টি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। খবর আল জাজিরা, টাইমস অফ ইসরাইল, আরব নিউজ, আনাদোলু নিউজ, দ্য গার্ডিয়ান, রয়টার্স।
ইসরাইলের পত্রিকা ইয়েদিয়থ আহারোনোথের মতে, গত ১৩ জুন ইসরাইল-ইরান সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পর থেকে ইসরাইলি কর কর্তৃপক্ষের প্রায় ৩৮ হাজার ৭০০টি ক্ষতিপূরণের দাবি পেয়েছে। এই দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে ভবনের ক্ষতির জন্য ৩০ হাজার ৮০৯টি, যানবাহনের ক্ষতির জন্য ৩ হাজার ৭১৩টি এবং সরঞ্জাম ও অন্যান্য জিনিসপত্রের ক্ষতির জন্য ৪ হাজার ৮৫টি। যদিও ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যুদ্ধের সব লক্ষ্য অর্জনের দাবি করলেও বিভিন্ন স্বাধীন বিশ্লেষক এই দাবিকে খ-ন করছেন। তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইয়্যেদ আব্বাস আরাঘচি জানিয়েছেন, ইসরাইল যদি নতুন করে আগ্রাসন চালায়, তবে তেহরানও আবার প্রতিরোধে যাবে।
অন্যদিকে, ইরানের প্রতিশোধমূলক হামলায় তেল আবিবে বেন গুরিওন বিমানবন্দরের কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। এই ব্যাঘাতের ফলে আরও বেশি অর্থনৈতিক ক্ষতি হতে পারে। দেশটির বৃহত্তম বিমানবন্দরে প্রতিদিন সাধারণত প্রায় ৩০০টি ফ্লাইট এবং ৩৫ হাজার যাত্রী যাতায়াত করে।
এখনো আতঙ্ক ইসরাইলে: যুদ্ধ থেমেছে। তেল আবিবের রামাতআবিবে ধ্বংস হওয়া ঘর-বাড়িতে ফিরতে শুরু করেছেন বাসিন্দারা। খুঁজে ফিরছেন টুকরো স্মৃতি, ছবি, বই কিংবা আস্ত সোফা। ধ্বংসাবশেষ সরাতে ব্যস্ত উদ্ধারকর্মীরা। তবে যুদ্ধ থামলেও সবার চোখে-মুখে ভয়ের রেখা স্পষ্ট-বাতাসে গুনগুন করছে একটাই প্রশ্ন: আদৌও থামবে তো এই যুদ্ধ? ইসরাইলের কর কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, প্রথম সপ্তাহে ঘরবাড়ি হারানো ইসরাইলিদের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে এবং প্রায় ৩৬ হাজার ৪৬৫ জন ক্ষতিপূরণের জন্য আবেদন করেছেন।
ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় তছনছ হয়ে গেছে তেল আবিবের শহর রামাতআবিব। ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজ চলছে এখনো। ‘মনে হচ্ছে এই দিনটা যেন শেষ হচ্ছে না, একটানা চলছেই, বলছিলেন তেল আবিবের একটি বিনোদন সংস্থার প্রধান অর্থ কর্মকর্তা লিয়াত। তিনি আরও বলেছেন, আমরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাই। আবার আনন্দ করতে চাই। বাসিন্দা ইলানা বেন আরি বলছিলেন, প্রথম মুহূর্তে তো বোঝাই যায় নি কী হয়েছে। বড় ধাক্কাটা পরে আসে। আমরা ভেবেছিলাম, আর কখনো আমাদের বাড়িতে ফিরতে পারব না।
১৩ জুন থেকে শুরু হওয়া এই যুদ্ধের সূচনা হয়েছিল ইরানে ইসরাইলের শত শত বিমান হামলার মধ্য দিয়ে। এর জবাবে ইরানও শুরু করে ব্যাপক ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা। যা দিন দিন আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে। সোমবার পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। মার্কিন হামলার জবাবে যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক ও কাতারের মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা চালায় ইরান। এরপর পরই যুদ্ধবিরতির ঘোষণা করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ১২ দিনের টানা ইরানি হামলায় ইসরাইলে ২৪ জন নিহত ও কয়েকশ আহত হয়েছেন। অন্যদিকে ইসরাইলি হামলায় ইরানে অন্তত ৪৩০ জন নিহত ও ৩ হাজারেরও বেশি আহত হয়েছেন। তেহরানসহ ইরানের বহু অঞ্চল থেকে হাজার হাজার মানুষ ঘরছাড়া হয়েছেন। মঙ্গলবার পর্যন্ত গত ১০ দিন ধরে রাজধানী তেহরানে চলছে টানা বোমাবর্ষণ। তেলআবিবে রোববারের হামলার রেশ কাটেনি সোমবারও। দেশটিতে বন্ধ হয়ে গেছে বহু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। বিধ্বস্ত হয়েছে বেশ কয়েকটি বড় বড় শহর।
ইসরাইলি সেনাবাহিনীর প্রাক্তন আর্থিক উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রিয়েম আমিনাচ জানিয়েছেন, যুদ্ধের প্রথম দিকে প্রতিদিন প্রায় ৭২৫ মিলিয়ন ডলার সামরিক খরচ করেছে ইসরাইল। এর মধ্যে ৫৯৩ মিলিয়ন ডলার ছিল ইরানের বিমান হামলার প্রতিরোধের জন্য, বাকি অর্থ খরচ হয়েছে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থা ও রিজার্ভ সংগ্রহে। অন্যান্য প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ইসরাইলের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় যেমন ‘ডেভিডস্লিং’ প্রতিটি ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করতে প্রায় ৭ লাখ ডলার খরচ হয়েছে, আবার ‘এরো থ্রি’ ব্যবস্থায় একক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধে খরচ হয়েছে ৪ মিলিয়ন ডলার। এভাবে ৪০০টিরও বেশি ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র মোকাবেলায় ব্যাপক অর্থ ব্যয় হয়েছে।
ইরানের হামলায় ছয়টি গবেষণাগার সম্পূর্ণ ধ্বংস, ৯টি ক্ষতিগ্রস্ত: ইসরাইল গত ১৯ জুন ইরান থেকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে দক্ষিণ ইসরাইলি শহর বিয়ারশেবার বেন-গুরিয়ন বিশ্ববিদ্যালয় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গতকাল বুধবার (২৫ জুন) এক প্রতিবেদনে টাইমস অফ ইসরাইল জানিয়েছে, ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে বেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়টি গবেষণাগার ধ্বংস হয়ে গেছে এবং নয়টি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, ‘চিকিৎসা ও জীববিজ্ঞানের’ বিভিন্ন গবেষণা প্রকল্পের জন্য বছরের পর বছর ধরে করা কাজ নষ্ট হয়ে গেছে।
প্রতিবেদন অনুসারে, প্রধান ক্যাম্পাসের ৩০টি ভবনের পাশাপাশি শ্রেণীকক্ষ, শিক্ষাদান পরীক্ষাগার এবং স্বাস্থ্যবিজ্ঞান অনুষদের কক্ষও উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টি জানিয়েছে, এখনো ক্ষয়ক্ষতি মূল্যায়ন করা হচ্ছে। গত ১৩ জুন ভোরে ইসরাইল ইরানের বিরুদ্ধে বিমান হামলা চালিয়ে আগ্রাসন অভিযান শুরু করে। ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে ইরান প্রতিশোধ নেয়। এরপর ধারাবাহিকভাবে ইসরাইলি হামলার জবাবে পাল্টা হামলা চালায় ইরান। ২২ জুন ভোরে মার্কিন বোমারু বিমানগুলো তিনটি ইরানি পারমাণবিক স্থাপনায় আক্রমণ করে। পরের দিন সন্ধ্যায় তেহরান কাতারে অবস্থিত এই অঞ্চলের বৃহত্তম মার্কিন সামরিক বিমান ঘাঁটি আল উদেইদে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। এরপর ২৪ জুন ট্রাম্প ঘোষণা করেন, ইসরাইল এবং ইরান যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। ইসরাইলও ঘোষণা করে, তারা মার্কিন প্রস্তাবে রাজি। পরিবর্তে তেহরান জানায়, তারা তেল আবিবকে আগ্রাসন বন্ধ করতে বাধ্য করে বিজয় অর্জন করেছে। ২৪ জুন থেকে যুদ্ধবিরতি কার্যকর রয়েছে।
জানা গেছে, ইসরাইলের ডায়মন্ড এক্সচেঞ্জেও আঘাত হানে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র, যা ইসরাইলের মোট রপ্তানির প্রায় ৮ শতাংশ। ইসরাইল ডায়মন্ড ইনস্টিটিউট জানিয়েছে, এই হামলার ফলে তেল আবিব স্টক এক্সচেঞ্জে বড় ধরনের পতন দেখা যায়। এছাড়াও ইসরাইলের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর বিরশেবায় অবস্থিত গাভ-ইয়াম অ্যাডভান্সড টেকনোলজি পার্কেও কয়েক দফায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান। এটি ইসরাইলের একটি হাই-টেক বাণিজ্যিক জোন, যেখানে বহু আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি কোম্পানি ও স্টার্টআপের অফিস রয়েছে, যা সামরিক ও গবেষণামূলক কাজেও ব্যবহৃত হয়। ইরানি হামলার ফলে হাইটেক পার্কের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।