সীমান্তে উত্তেজনা ও দুই বাংলাদেশীকে হত্যা

হাদীর খুনিদের সর্বশেষ অবস্থান ভারতের মহারাষ্ট্রে

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর থেকেই বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছে। গত এক সপ্তাহ ধরে এই টানাপোড়ন আরও গভীর হয় জুলাই বিপ্লবী হাদীর মৃত্যু ও খুনিদের ভারতে আশ্রয়ের মধ্যদিয়ে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের অচলায়তন বেশ কয়েকবার আলোচনায় এসেছে।সর্বশেষ গত বুধবার সকালে দিলীøতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার এম রিয়াজ হামিদুল্লাহকে তলব করা হয়েছে। এর আগে গত রোববার ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তলব করে ভারতের হাইকমিশনার প্রণব ভার্মাকে। এতদিন নীরবতা ও কৌশলগত সংযমের আড়ালে থাকা দ্বিপাক্ষিক টানাপোড়েন এখন প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে গত বৃহস্পতিবার রাতে জুলাই বিপ্লবী শরিফ ওসমান হাদীর মৃত্যুতে। এছাড়াও পলাতক ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে ঘিরে অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ, হাইকমিশনার তলব ও রাজপথের কড়া বক্তব্য-সব মিলিয়ে ঢাকা ও নয়াদিল্লির সম্পর্ক এক অভূতপূর্ব উত্তেজনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কূটনৈতিক সৌজন্যের সীমা ছাপিয়ে বিষয়টি এখন সরাসরি রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা ইস্যুতে রূপ নিয়েছে। এ পরিস্থিতি দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বৈরিতা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বলে ঢাকার কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞ ও ভূরাজনীতি বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করছেন। দুই দিনের ব্যবধানে দুই দেশের হাইকমিশনারকে তলবের ঘটনায় উদ্বেগ বাড়িয়েছে। বাংলাদেশের ‘ক্রমাবনতিশীল নিরাপত্তা পরিস্থিতি’ নিয়ে নয়াদিলীøর গভীর উদ্বেগ জানাতে বাংলাদেশের হাইকমিশনারকে তলব করা হয় বলে জানায়। এর ধারাবাহিকতায় গত বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র সচিব বিদেশি কূটনৈতিকদের ডেকে আশ্বস্ত করে বলেন যে দেশে কোনো নিরাপত্তা ঝুঁকি নেই। কূটনৈতিকদের ঐ সভায় ঢাকার ভারতীয় দূতাবাসের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।

হাদীর মৃত্যু দুই প্রতিবেশী বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কে নতুন করে উত্তাপ ছড়িয়েছে। তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রের বরাতে জানা গেছে, জুলাই বিপ্লবী শরিফ ওসমান হাদীর খুনি ফয়সালের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনের আইপি অ্যাড্রেস বিশ্লেষণ করে গত বুধবার তার অবস্থান ভারতের মহারাষ্ট্রে শনাক্ত করা হয়েছে। সে দেশটির রিলায়েন্স কোম্পানির একটি সংযোগ ব্যবহার করে যে যোগাযোগ রক্ষা করছে বলেও তথ্য পাওয়া গেছে। ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী শরিফ ওসমান বিন হাদীকে হত্যাচেষ্টার পর দুই দেশের সম্পর্কে আবার তিক্ততা তৈরি হয়েছে। এই তিক্ততার মধ্যে গতকাল শুক্রবার সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ সীমান্তে আশিকুর (১৯) ও মোশাঈদ (২২) নামে দুই তরুণকে গুলী করে হত্যা করেছে ভারতীয় খাসিয়ারা। গতকাল শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে উপজেলার উত্তর রণিখাই ইউনিয়নের দমদমা সীমান্তে এ হত্যাকাণ্ড ঘটে। হত্যাকাণ্ডের শিকার দুজন হলেন-দমদমা সীমান্তের পূর্ব তুরুং গ্রামের বুরান উদ্দীনের ছেলে আশিকুর (১৯) ও একই গ্রামের মৃত রব মিয়ার ছেলে মোশাঈদ (২২)।

দিল্লীতে তলবের আগে ঢাকায় ভিসা সেন্টারের কার্যক্রম বন্ধের ঘোষণা করলেও এখন চালু আছে সীমিত পরিসরে এবং ঢাকার বাহিরে ভারতের ভিসা সেন্টারগুলো বন্ধ করে দিয়েছে নয়াদিলীø। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ঢাকায় কিছু চরমপন্থি গোষ্ঠী যেভাবে ভারতীয় দূতাবাসকে ঘিরে নিরাপত্তা হুমকি সৃষ্টি করেছে, সে কারণেই রাষ্ট্রদূতকে তলব করা হয়েছে। কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দীর্ঘ ১৬ মাস ধরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে টানাপোড়েন অব্যাহত রয়েছে। গত কয়েক দিনে অর্থাৎ তফসিল ঘোষণার পর পলাতক ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তী সরকার ও নির্বাচনের বিপক্ষে এবং সন্ত্রাসী কার্যক্রমকে উসকানি দিয়ে নানান বক্তব্য-বিবৃতি দেয় যা দেশের গণমাধ্যম সহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হয়। এ ছাড়া ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান বিন হাদীকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলীবর্ষণকারীরা ভারতে পালিয়ে গেছেন বলে দেশে ব্যাপক আলোচনা হয়। এ পরিস্থিতিতে ভারতের হাইকমিশনারকে তলব করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ভারতে পালিয়ে যাওয়া ক্ষমতাচ্যুত পলাতক শেখ হাসিনার বাংলাদেশ-বিরোধী কর্মকাণ্ডের দ্রুত অবসান চায় ঢাকা। হাদীর হত্যাচেষ্টায় জড়িত সন্দেহভাজন ব্যক্তিদেরও ফেরত পাঠানোর আহ্বান জানায় ঢাকা।

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বহুমাত্রিক। কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, কোনো ধরনের উসকানিতে পা দিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক নষ্ট করা যাবে না। পাল্টাপাল্টি মন্তব্য দুই দেশের মধ্যে বৈরিতা সৃষ্টি করবে। আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতাদের উচিত সংবেদনশীল বিষয়গুলো নিয়ে বৈরিতা সৃষ্টি হয় এমন ধরনের মন্তব্য না করা। বাংলাদেশ যখন একটি সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের দিকে হাঁটছে সেদিকেই মনোযোগ নিবদ্ধ রাখা উচিত। নির্বাচনের সামনে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা আসতে পারে। তাই সতর্ক ও সংযত থেকে দেশকে একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরিতে সরকারকে সহযোগিতা করা সবার দায়িত্ব।

শরিফ ওসমান হাদীর মৃত্যুর পর বাংলাদেশ ভারতের সম্পর্ক নিয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের মন্তব্য জানতে চাইলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার অফিস জানায় এই বিষয়ে আগামী ব্রিফিংয়ে তিনি তার মতামত জানাবেন। তবে গত বুধবার বিকেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বাংলাদেশ ভারতের সম্পর্ক নিয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই ভারতের সঙ্গে একটা ‘গুড টু ওয়ার্কিং রিলেশন’ চেয়েছে। তবে সম্পর্ক দুপক্ষ থেকেই এগোনোর চেষ্টা করতে হবে। আমার মনে হয় আমরা দুপক্ষ মিলে হয়তো অতটা এগোতে পারিনি, যে কারণে টানাপোড়েনটা রয়েই গেছে।

তিনি বলেন, শেখ হাসিনা ভারতে বসে আগে বক্তব্য দিতেন শুধু সামাজিক মাধ্যমে। পরে আমরা দেখলাম, প্রধান গণমাধ্যমে তাঁর (শেখ হাসিনা) বক্তব্য আসছে এবং সেই বক্তব্যের মধ্যে (বাংলাদেশ নিয়ে) প্রচুর উস্কানি রয়েছে। শেখ হাসিনা আদালত থেকে শাস্তিপ্রাপ্ত হয়েছেন। তিনি আমাদের পাশের দেশে বসে, এখানে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করছেন। এটা আমরা আপত্তি করব বা তাদের (ভারতের) সহায়তায় চাইব যে তাকে ফেরত পাঠান। তৌহিদ হোসেন বলেন, সর্বশেষ যে বক্তব্য (ভারত) এসেছে তাতে আমাদের নসিহত করা হয়েছে। সেটার কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। বাংলাদেশে নির্বাচন কেমন হবে এটা নিয়ে আমরা প্রতিবেশীদের উপদেশ চাই না। শেখ হাসিনার উস্কানিমূলক বক্তব্য থামানোর পরবর্তী পদক্ষেপ জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, ভারত যদি তাঁকে থামাতে না চায়, আমরা থামাতে পারব না। এটা আমাদের বুঝে নিতে হবে। আমরা চাইব, ভারত তাঁকে থামাক। এখানে যে একটা পরিবেশ সৃষ্টি যেটা হচ্ছে নির্বাচনের জন্য, সেখানে যেন শেখ হাসিনার উস্কানিমূলক বক্তব্যের কারণে নষ্ট না হয়।

ঢাকায় অবস্থিত ভারতীয় হাইকমিশনের নিরাপত্তা ঝুঁকির বিবেচনায় এবং ভারতবিরোধী মন্তব্যের প্রতিবাদ জানাতে গত বুধবার বাংলাদেশের হাইকমিশনার এম রিয়াজ হামিদুল্লাহকে তলব করে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। রিয়াজ হামিদুল্লাহকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিরাপত্তা শঙ্কার বিষয়টি তুলে ধরার পাশাপাশি বিষয়টি কতটা গুরুত্বের সঙ্গে ভারত দেখছে, তা তুলে ধরেছে। তবে হুমকির নির্দিষ্ট প্রকৃতি বা উৎস সম্পর্কে কোনো আনুষ্ঠানিক তথ্য সরবরাহ করা হয়নি।

যদিও এক বিবৃতিতে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার রিয়াজ হামিদুল্লাহকে গত বুধবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তলব করেছে এবং বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিবেশের অবনতিতে ভারতের তীব্র উদ্বেগের কথা অবহিত করেছে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা সম্পর্কে চরমপন্থি উপাদানগুলো যে মিথ্যা বর্ণনা তৈরি করার চেষ্টা করছে, তা ভারত সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করে। দুর্ভাগ্যজনক যে, অন্তর্বর্তী সরকার ঘটনাগুলোর বিষয়ে কোনো পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করেনি বা ভারতের সঙ্গে অর্থপূর্ণ প্রমাণ ভাগ করেনি।

জুলাই ঐক্যের ডাকে ‘মার্চ টু ইন্ডিয়ান হাইকমিশন’কর্মসূচি রাজধানীর উত্তর বাড্ডায় আটকে দেয় পুলিশ। এরপর কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া বিক্ষোভকারীরা সেখানে বসে স্লোগান দিতে থাকে। তবে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। এ সময় প্রগতি সরণিতে যান চলাচল বন্ধ ছিল।

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতা হাসনাত আবদুল্লাহর মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে কড়া প্রতিক্রিয়া এসেছে আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার কাছ থেকে। গত মঙ্গলবার স্থানীয় সাংবাদিকদের তিনি বলেন, বাংলাদেশে গত এক বছরে এই চর্চা বারবার হচ্ছে, নর্থ-ইস্টকে (ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল) ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করে বাংলাদেশে যুক্ত করা উচিত। কিন্তু আপনারা জানেন, ভারত একটি বড় দেশ, পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র এবং বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ কীভাবে এটা করবে? এটা তো ভাবাও ভুল। তাদের বেশি সাহায্য করা আমাদের উচিত নয়। এই লোকগুলোকেও এটা বুঝিয়ে দেওয়া উচিত ভারতের সঙ্গে এমন ব্যবহার করলে আমরা চুপ করে বসে থাকব না।

সীমান্তে ‘বাড়াবাড়ি’ করছে বিএসএফ: গণ-অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সীমান্তে বিএসএফের পুশ ইন ও তৎপরতা বেড়েছে। সীমান্ত হত্যাও বেড়েছে। এ নিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই গত সপ্তাহে কোচবিহার জেলায় এক প্রশাসনিক বৈঠকে বলেন, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফ বাড়াবাড়ি করছে। তারা ভারতীয় নাগরিকদের ধরে ধরে বাংলাদেশে ঠেলে দিচ্ছে।