আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রনে চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী ও ছিনতাইকারীসহ অপরাধীদের ধরতে দেশজুড়ে সরকারের বিভিন্ন বাহিনীর অভিযান চলমান। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের শুরু থেকেই মাঠে রয়েছে সশস্ত্র বাহিনী। তাদের রয়েছে ম্যাজেস্ট্রেসি ক্ষমতা। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের সমন্বয়ে ‘ডেভিল হান্ট’ নামে যৌথ বাহিনীর অভিযান চলছে। এসব অভিযানের চলমান থাকা অবস্থায় গত মাস থেকে সারাদেশে শুরু করা হয়েছে পুলিশের বিশেষ অভিযান। উদ্দেশ্য একটাই, দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা। বেপরোয়া অপরাধীদের পাকড়াও করে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড থেকে সাধারণ মানুষকে নিরাপদে রাখা। দেশকে সন্ত্রাসীমুক্ত করা। জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনা।

কিন্তু সর্বোচ্চ কমান্ড নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাঠে থাকার প্রভাব পড়ছে না। থানা পুলিশ থেকে শুরু করে শীর্ষ পর্যায় পর্যন্ত তাদের কর্মকান্ডকে অনেকটা ঢিলেঢালা মনে করছেন সাধারণ মানুষ। সেনাবাহিনীর অভিযানে শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদসহ হাতেগোনা কয়েকজন অপরাধী গ্রেফতার ছাড়া বড়ধরণের কোনো সাফল্য চোখে পড়ছে না বলে মন্তব্য বিশেষজ্ঞদের। বাহিনীগুলোর অভিযানের মধ্যেও চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম থামছে না। চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসীরা এখনো বেপরোয়া। খুন, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজির লাগাম টানা সম্ভব হচ্ছে না। দুর্বৃত্তরা প্রকাশ্যে রাস্তার ধারে বর্বরতা চালিয়ে মানুষকে হত্যা করতে দ্বিধা করছে না। ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ চাঁদাবাজদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। অনেকে ভয়ে মুখ ফুটে পুলিশের কাছেও অভিযোগ করতে পারছে না। কারণ অভিযোগ করলেই প্রাণ হারাতে হতে পারে চাঁদাবাজ চক্রের কাছে। বিভিন্ন স্থানে জিম্মি থাকা মানুষ তাই আতঙ্কের সঙ্গে বসবাস করছে। রাজনৈতিক দলের পরিচয় ছাড়াও ‘সমন্বয়ক’ পরিচয় দিয়েও হচ্ছে চাঁদাবাজি।

সর্বশেষ বৃহস্পতিবার রাতে গাজীপুরে দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ পত্রিকার গাজীপুর প্রতিনিধি মো. আসাদুজ্জামান তুহিনকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করা হয়। স্থানীয়রা অভিযোগ করেছিলেন-চাঁদাবাজির ঘটনা মোবাইলে ভিডিও ধারণ করার সময় সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজরা তাকে কুপিয়ে হত্যা করে। তবে গতকাল পুলিশ জানিয়েছে এটি চাঁদাবাজির ঘটনা ছিল না। একটি ভিডিও পুটেজ দেখে ভিন্ন তথ্য পাওয়া গেছে। প্রকৃত ঘটনা কি তা যাচাই বাছাই করে দেখা হচ্ছে। এ ঘটনায় ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচজনকে আটক করা হয়েছে। প্রকৃত অপরাধীদের ধরা পড়লে রহস্য জানা যাবে। এ ঘটনার একদিন আগে গাজীপুর নগরের সাহাপাড়া এলাকায় চাঁদাবাজদের হাতে আরেক সাংবাদিক আহত হয়। জানা গেছে, সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালকদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করছিলেন স্থানীয় কয়েকজন যুবক। এ ঘটনায় সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে পুলিশের সামনেই স্থানীয় সংবাদকর্মী আনোয়ার হোসেনকে (৩৫)। বেধড়ক মারধরের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। গুরুতর আহত অবস্থায় বর্তমানে তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। বুধবার বেলা সাড়ে তিনটার দিকে সাহাপাড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। আহত সাংবাদিক দৈনিক বাংলাদেশের আলো পত্রিকার গাজীপুরের স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কর্মরত। ওই সংবাদকর্মীকে মারধরের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।

সম্প্রতি রাজধানীর গুলশানে সাবেক এক এমপির বাসায় সমন্বয়ক পরিচয়ে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবির ঘটনা নিয়ে সম্প্রতি তোলপাড় শুরু হয়। তবে সমন্বয়ক পরিচয়ে চাঁদাবাজর ঘটনা আলোচনায় আসার পরপরই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছে। সেই সমন্বয়কের দল থেকেও তাৎক্ষনিক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। আলোচনা-সমালোচনার মুখে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটি ব্যতীত সব কমিটি স্থগিত ঘোষণা করা হয়। ওই ঘটনায় পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া পাঁচজনকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ থেকে বহিষ্কারের করা হলেও জুলাই আন্দোলনের এসব প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে চাঁদাবাজির নানা অভিযোগ আলোচনায় এসেছে। জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কয়েক জন নেতা গত কয়েকমাসে নানা ঘটনায় আলোচনায় এসেছেন। যুগ্ম সদস্যসচিব গাজী সালাউদ্দিন তানভীরকে গত এপ্রিলে দল থেকে সাময়িকভাবে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। গুলশানে সাবেক এক এমপির বাসায় গিয়ে চাঁদা দাবি করার অভিযোগে গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক ও প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আব্দুর রাজ্জাক বিন সোলাইমান রিয়াদ, একই সংগঠনের ঢাকা মহানগর শাখার আহ্বায়ক ও অতীশ দীপংকর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইব্রাহিম হোসেন মুন্না এবং কমিটির সদস্য ও প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সাকাদাউন সিয়াম ও একই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাদমান সাদাব। গ্রেপ্তার হওয়া আরেকজন অপ্রাপ্ত বয়স্ক। চাঁদার টাকা আনতে গিয়ে তারা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের পর ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার তালেবুর রহমান বলেন, আব্দুর রাজ্জাক বিন সোলাইমান রিয়াদের বাসা থেকে প্রায় আড়াই কোটি টাকার চেক ও এফডিআরের নথি উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে ২ কোটি ২৫ লাখ টাকার চেক, একইসঙ্গে প্রায় ২০ লাখ টাকার এফডিআর নথি রয়েছে।

চাঁদাবাজির প্রতিবাদে ভুক্তভোগীরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করেছে বিভিন্ন স্থানে। গত ৯ জুলাই পুরান মিটফোর্ড হাসপাতাল সংলগ্ন সড়কে প্রকাশ্যে দুর্বৃত্তরা মো. সোহাগ ওরফে লাল চাঁদ নামের এক ব্যবসায়ীকে মাথায় ইট দিয়ে থেঁতলে বর্বরতা চালিয়ে হত্যা করে। ঐ হত্যাকাণ্ডে দেশব্যাপী ব্যাপক আলোড়নের সৃষ্টি হয়। মাসে দুই লাখ টাকা চাঁদা না পেয়ে এই নির্মম হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে প্রতিপক্ষের লোকেরা। পুলিশের হাতে আটকের পর জানা গেছে, সোহাগ এবং তার প্রতিপক্ষের লোকেরা সবাই বিএনপির অঙ্গ সংগঠনের সাথে জড়িত। এর আগে গত ২৮ মে মিরপুরে নাজমুল হাসান পাপ্পু ও দোলনা নামের এক দম্পতিকে ছুরি মেরে হত্যা করা হয়। গত ৮ মে রাজধানীর বাড্ডায় ঠিকাদার আনোয়ার হোসেন, গত ১৫ মে একই থানার গুদারাঘাট এলাকায় বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক কামরুল আহসান সাধনকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রতিটি হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্ট পরিবারের যে ক্ষতি হয়, তা পূরণ হওয়ার নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী আরো তৎপর হলে হত্যার ঘটনা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তা না হলে এভাবে হত্যার ঘটনা বাড়তেই থাকবে। রাজধানীতে সংঘটিত গত ছয় মাসের ২১৭টি হত্যাকাণ্ড বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এর বেশির ভাগ রাজনৈতিক কারণে ঘটেছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে। পুলিশ এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি সক্রিয়। গত রবিবার সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত কোর কমিটির বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের এ কথা বলেন।

জানা গেছে, কয়েকদিন আগে রাজধানীর মোহাম্মদপুর-আদাবরে চাঁদাবাজির প্রতিবাদে মানববন্ধন ও মিছিল করে স্থানীয় শিক্ষক সমাজ। কর্মসূচিতে অংশ নেন ৭০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। তারা বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছেও নিয়মিত চাঁদা দাবি করা হচ্ছে। প্রতিবাদ করলে সন্ত্রাসীরা হুমকি দিচ্ছে। সাভার-বিরুলিয়া আঞ্চলিক সড়কে মানববন্ধন করেন চার শতাধিক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। জাতীয় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সংস্থা শপিং কমপ্লেক্সের (অন্ধ মার্কেট) আয়োজনে এই কর্মসূচিতে তারা অভিযোগ করেন, দোকান মালিকদের চাঁদা না দিলে দোকান দখলের ভয় দেখানো হয়। অনেকেই এরই মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। গত ২৩ জুন আশুলিয়ার বাইপাইল এলাকায় সাধারণ ব্যবসায়ী ও পরিবহন শ্রমিকরা মানববন্ধন করেন। চিহ্নিত চাঁদাবাজদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবি জানান তারা।

পুলিশ বলছে, চাঁদাবাজসহ অপরাধীদের নিয়মিত গ্রেফতার করা হচ্ছে। সম্প্রতি খিলক্ষেত মধ্যপাড়া এলাকা থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজ মাসুদ রানা (৩৫) কে চাঁদার টাকা সহ হাতেনাতে গ্রেফতার করে পূর্বাচল আর্মি ক্যাম্পের সেনা সদস্যরা। এ সময় তাকে চাঁদা আদায়ের ২,৩০,০০০ (দুই লক্ষ তিরিশ হাজার) টাকা ও ইয়াবাসহ আটক করে। পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) এ এইচ এম শাহাদাত হোসাইন জানান, চলমান বিশেষ অভিযানে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে একদিনে মোট এক হাজার ৬২২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন মামলার ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি এক হাজার ১১৯ জন ও অন্যান্য অপরাধে জড়িত ৫০৩। শাহাদাত হোসাইন যপঠন, গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে পুলিশ একযোগে অভিযান পরিচালনা করে এক হাজার ৬২২ জন আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে। এ সময় তিনটি দেশীয় পাইপগান, একটি বিদেশি রিভলভার, দুইটি ওয়ান শুটার গান, ১৯ রাউন্ড কার্তুজ, ছয় রাউন্ড গুলির খোসা, একটি স্টিলের বার্মিজ চাকু, ছয়টি ককটেল ও একটি স্টিলের স্প্রিং চাকু জব্দ করা হয়েছে। অপরাধী চাঁদাবাজদের গ্রেফতারে পুলিশের এ অভিযান চলমান আছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরে আলোচনায় ছিল দেশের বিভিন্ন স্থানে মব সন্ত্রাস, ভুয়া বা মিথ্যা মামলা এবং চাঁদাবাজির ঘটনা। বিভিন্ন ঘটনায় ১ লাখ ৭৬ হাজার ৭৮৮টি মামলা দায়ের হয়েছে। এর মধ্যে ব্যক্তিগত আক্রোশ, শত্রুপক্ষকে হয়রানি, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমন, সম্পত্তি থেকে ওয়ারিশদের বঞ্চিত করাসহ নানা কারণে দায়ের হয়েছে সহস্রাধিক ভুয়া বা মিথ্যা মামলা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পরিসংখ্যানে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ১০ মাসে সারাদেশে ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৭৯৮ জন গ্রেপ্তার হয়েছে। এর মধ্যে ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে গ্রেপ্তার হয়েছে ১ লাখ ৪৬ হাজার ১০৯ জন। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত পাঁচ মাসে গ্রেপ্তার হয়েছে ২ লাখ ১৩ হাজার ৬৮৯ জন। পুলিশ সদরদপ্তরের প্রতিদিনের গ্রেপ্তার-সংক্রান্ত পরিসংখ্যান থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। এদিকে পুলিশ সদরদপ্তরের উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বপরোয়া চাঁদাবাজি রুখতে প্রচলিত আইনের পাশাপাশি প্রয়োজনে ডিটেনশন আইনে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবছে পুলিশ। চাঁদাবাজদের ভয়ে ভুক্তভোগীদের কেউ মামলা করতে ভয় পেলে, পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করবে। হাতেনাতে চাঁদার টাকা, রসিদ, অন্য আলামতসহ কাউকে আটক করা হলে তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার আইনে মামলা করা হবে। তবে এখন পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।