‘জুলাই গণহত্যার বিচার আলোচনা ও তথ্যচিত্র প্রদর্শন’ অনুষ্ঠানে বিশিষ্টজনরা বলেছেন, বিগত দিনে শেখ হাসিনা এবং তার দোসররা যে অপরাধ বাংলাদেশে করেছে, সেরকম জঘন্য অপরাধ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী বাহিনীও করেনি। লাশ পুড়িয়ে ফেলা, আহত মানুষকে গুলী করে মেরে ফেলা, নিরস্ত্র আহত মানুষকে গুলী করে মেরে ফেলা তো যুদ্ধাপরাধ।
গতকাল মঙ্গলবার বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনিস্টিটিউট মিলনায়তনে ‘জুলাই গণহত্যার বিচার আলোচনা ও তথ্যচিত্র প্রদর্শন’ অনুষ্ঠানে একথা বলেন তিনি। আইন মন্ত্রণালয় আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য দেন পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম, জুলাই শহীদ মুগ্ধর পিতা মীর মোস্তাফিজুর রহমান, শহীদ ইয়ামিনের পিতা মহিউদ্দিন প্রমুখ। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন আইন ও বিচার বিভাগের সচিব শেখ আবু তাহের।
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের নৃশংসতা পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীকেও হার মানিয়েছে। তিনি বলেন, আমরা ’৭১ সালেও দেখিনি মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলার দৃশ্য। কিন্তু জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে সে কাজ করে দেখিয়েছে আওয়ামী শাসনামল।
উপদেষ্টা বলেন, আপনারা বলতে পারেন, এরকম তো ২৫ মার্চ কালো রাত্রে ঘটেছে। অবশ্যই ২৫ মার্চে কালো রাত্রে ভয়ানক ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু ওটা তো অন্য দেশের বাহিনী, আমরা স্বাধীনতা ঘোষণা করেছি, তারপর মানে আপনি যদি পাসপেক্টিভ দেখেন, পাসপেক্টিভ ওয়াইজ ডিফারেন্ট আমার ’৭১ সালে ডেড বডি পুড়িয়ে ফেলেছে, এরকম কোনো ফুটেজ আমি দেখি নাই। একজন গুলী খেয়েছে তাকে ধরে পিছু নিয়ে যাচ্ছে তার বন্ধু, সে অবস্থাকে গুলী করেছে এরকম কোন ফুটেজ, কোন বর্ণনা আমি মুক্তিযোদ্ধার বর্ণনায় পাই নাই। অন্যরকম নৃশংস থাকতে পারে, কিন্তু এরকম (জুলাই-আগস্ট গণহত্যা) নৃশংসতার গল্প পাই নাই।
তিনি বলেন, শেখ হাসিনা এবং তার দোসররা যে অপরাধ বাংলাদেশে করেছে, সেরকম জঘন্য অপরাধ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী বাহিনীও করেনি।
আইন উপদেষ্টা বলেন, আপনারা বিভিন্ন প্রত্যাশার কথা, বেদনার কথা বলেন, মাঝে মাঝে একটু দুঃখ লাগে। তাজুল (চিফ প্রসিকিউটর) কিছু কথা বলল যে আমরা কীভাবে কাজ করি। আমি আপনাদের বলতে পারি, তাজুল কীভাবে কাজ করে। তাজুল রাত ২টা পর্যন্ত কাজ করে, একটা নতুন কিছু হলে চকচকে চেহারা করে আইন মন্ত্রণালয়ে দৌড়ে আসে, স্যার ওরকম একটা এভিডেন্স পেয়েছি। এই যে ইমোশন এই যে পরিশ্রম, এই যে কষ্ট এই পুরা টিম করছে। আমরা লেগে আছি।
ট্রাইব্যুনালে গণহত্যার বিচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, তাজুলের সঙ্গে দেখা হলে প্রথম কথা, আমরা নিজের কাছে নিজে মুখ দেখাতে পারবো না, আল্লাহর কাছে জবাব দিতে পারবো না। বারবার একটা কথাই বলি, বিচার কত ভালোভাবে করা যায়, কতটুকু করা যায়। তারপরও অনেক অভিযোগ শুনি, অনেক কিছু শুনি, খুব দুঃখ লাগে মাঝে মাঝে।
আইন উপদেষ্টা বলেন, এটার জন্যই তো আমাদের সন্তানরা প্রাণ দিয়েছিল, আপনারা আমাদের প্রশ্ন করবেন, সমালোচনা করবেন। কষ্ট লাগলো, শুনবো আবার রিফোকাস করবো। কিন্তু আপনাদের একটা জিনিস বলতে চাই, আমি একজন রিলিজিয়াস মানুষ আমি যখন নামাজ পড়ি বা যখন আমি এই দায়িত্ব গ্রহণ করেছি, সবসময় বলি আমি যেন আল্লাহর কাছে জবাব দিতে পারি। আমি যখন জায়নামাজে যাই, দোয়া পড়ি তখন মনে হয় যে আল্লাহ তো আমাকে দেখছে। আমি কি আল্লাহর কাছে জবাব দিতে পারবো? উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করার পর আপনাদের কনফিডেন্টলি বলে যাই, ওপরে আল্লাহ আছে। অবশ্যই পারবো।
অনুষ্ঠানে আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘জুলাই বিপ্লবের নায়করা আমাদের পথ দেখাবে। তিনি আরো বলেন, জুলাই বিপ্লবের নায়কদের মধ্যে শহীদ আবু সাঈদ, ইয়ামিন, মুগ্ধরা আমাদের পথ দেখিয়েছে। বাংলাদেশ যতদিন থাকবে, তাদেরকে কেউ ভুলতে পারবে না।
আওয়ামী লীগ সরকারের বিচারব্যবস্থার অপশাসনের উদাহরণ দিয়ে মাহমুদুর রহমান বলেন, তিনি মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাইকোর্টে গিয়েছিলেন আগাম জামিনের জন্য, কিন্তু বিচারক তাকে ভৎর্সনা করে বলেছিলেন, তিনি মাহমুদুর রহমানের চেহারা দেখতে চান না। বর্তমান বিচার ব্যবস্থাকে সঠিকভাবে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেছেন, গণহত্যায় জড়িত শীর্ষ পর্যায়ের বড় অংশের বিচার এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে সম্পন্ন হবে।
তাজুল ইসলাম বলেন, মোবাইল কোর্ট ও গণহত্যার বিচার এক বিষয় নয়। তাই এই বিচার সময় নিয়ে, পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে যাতে কোনো সরকার বা আন্তর্জাতিক মহল এ বিচার নিয়ে প্রশ্ন তুলতে না পারে—সেই বিষয়টি মাথায় রেখেই বিচার কাজ পরিচালিত হচ্ছে।
আগামী ৩ আগস্ট প্রথম সাক্ষী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবেন বলে জানিয়েছেন তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, যে গুলি করেছে সে আসামি না বরং যে গণভবনে বসে নির্দেশ দিয়েছে সে প্রকৃত আসামি।
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, তদন্ত সংস্থায় যারা কাজ করেন, তারা পুলিশ বাহিনী থেকে আসলেও স্বৈরাচারের দোসর না। তারা বিগত সরকারের আমলে বিভিন্ন ভাবে বঞ্চিত ছিলেন। সেখানে থেকে বেছে বেছে আমাদের তদন্ত সংস্থায় আনতে হয়েছে।
অনুষ্ঠানে জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ এবং মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহত মানুষের জন্য দোয়া করা হয়। অনুষ্ঠানে জুলাই অভ্যুত্থান নিয়ে ‘ট্রায়াল অব জুলাই কার্নেজ’ শীর্ষক একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।