জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের প্রস্তাবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি এনসিপিসহ বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল একমত পোষণ করেছে। তবে এর বিপক্ষে মত দিয়েছে বিএনপি। তবে অন্যদের পক্ষ থেকে বিএনপিকে বিকল্প মত দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে ন্যাশনাল নাগরিক পার্টি এনসিপি। গতকাল বুধবার রাজধানীর বেইলি রোডে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে চলমান ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের সংস্কার আলোচনায় এনসিসি গঠনের প্রস্তাবটি প্রাধান্য পেয়েছে।
জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনে অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের সম্মতি রয়েছে জানিয়ে জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, প্রথম পর্বের আলোচনায় রাজনৈতিক দলগুলো পৃথক পৃথকভাবে তাদের অবস্থান জানিয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় পর্যায়ে পারস্পরিক আলোচনার সুযোগ তৈরি হয়েছে। সে প্রেক্ষিতে দলগুলো নিজেদের অবস্থানের পাশাপাশি অন্যদের অবস্থান সম্পর্কেও জানতে পারছে। দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনায় সকল রাজনৈতিক দল মতামতও দিচ্ছেন আবার মতবিনিময়ও করছেন। যা কমিশনকে অগ্রসর হতে সাহায্য করছে।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ আরো বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) এবং রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা দু'টি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। সাংবিধানিক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা রাজনৈতিক দলগুলো অনুভব করে। দুয়েকটি দলের মধ্যে এ ব্যাপারে নীতিগত মত পার্থক্য থাকলেও একটি সাংবিধানিক ব্যবস্থার বিষয়ে সকলে মত দিয়েছেন।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে সংবিধান সংস্কার কমিশন এবং নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের দুটি প্রস্তাব রয়েছে উল্লেখ করে তিনি জানান, ক্ষমতার ভারসাম্যের জন্য রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। এসব বিষয়ে পুনর্বার আলোচনা অব্যাহত থাকবে। কাউন্সিলের জবাবদিহিতা কাঠামো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘প্রস্তাব অনুযায়ী, কাউন্সিলের সদস্যরা হবে নির্বাচিত প্রতিনিধি। তারা যেহেতু জনগণের ভোটে নির্বাচিত, তাই তাদের মাধ্যমেই জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
সংলাপে দুইটি রাজনৈতিক দলের ওয়াকআউট প্রসঙ্গে আলী রীয়াজ বলেন, ‘এতগুলো দলের মধ্যে মতপার্থক্য ও ক্ষোভ থাকবেই। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সংলাপে অংশ নেওয়া বেশিরভাগ দল সহযোগিতামূলক মনোভাব দেখিয়েছে। আলোচনা ছিল শান্তিপূর্ণ এবং গঠনমূলক।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে গতকালের আলোচনায় অংশ নেয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণঅধিকার পরিষদ, গণসংহতি, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টিসহ ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা। আজ বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায় আবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসবে কমিশন।
সৌহার্দ্যরে বার্তা :
ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় এক সৌহার্দ্যরে পরিবেশ দেখা গেল গতকাল। হাতে হাত রেখে পরস্পর সৌহার্দ্যরে বার্তা দিয়েছেন বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ, জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা চলাকালে বিরতির সময় হাতে হাত রেখে ছবি তোলেন তারা। এদিন দুপুরে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় দিনের বৈঠকের বিরতির ফাঁকে এই চিত্র দেখা গেছে। পরে নাহিদ ইসলামকে বুকে টেনে নেন সালাহউদ্দিন আহমদ। এসময় কেমন আছেন নাহিদ ? জিজ্ঞেস করেই বুকে টেনে নেন সালাহউদ্দিন।
বিএনপির বক্তব্য :
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদ বলেছেন, প্রস্তাবিত জাতীয় সাংবিধানিক কমিশন (এনসিসি) গঠনের সঙ্গে একমত নয় বিএনপি, কারণ এর মধ্যে ‘জবাবদিহিতার ঘাটতি’ রয়েছে। তিনি বলেন, এনসিসির (জাতীয় সাংবিধানিক কমিশন) মতো একটি কর্তৃপক্ষকে যেসব কার্যক্রম ও দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, সেগুলো সাধারণত নির্বাহী বিভাগ, আইন বা সাংবিধানিক বিভিন্ন বিধানের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। এই নেতা বলেন, এনসিসির মতো একটি সংস্থা যার ক্ষমতা ও দায়িত্ব আছে, কিন্তু জবাবদিহিতা নেইÑএমন একটি প্রতিষ্ঠানকে গণতান্ত্রিক দল হিসেবে আমরা সমর্থন করতে পারি না। তিনি আরও বলেন, এ ফাংশনগুলোকে আলাদা করে যদি আরেকটা প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হয়, তাহলে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হবে।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিষয়ে তিনি বলেন, ইউনিয়ন পর্যায় থেকে সংসদ সদস্য পর্যন্ত প্রায় ৭০ হাজার ভোট থাকবে, এমন একটি পরিস্থিতিতে এখন নতুন কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন নেই। তিনি বলেন, আমরা বলেছি, বর্তমান সংসদ সদস্যদের মাধ্যমে এবং উচ্চকক্ষ গঠিত হলে সেখানকার সদস্যদের মাধ্যমেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হওয়া উচিত। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে তিনি বলেন, বর্তমানে প্রচলিত আইনগুলো সংশোধন করে আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন, যাতে একটি ভারসাম্যপূর্ণ রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তোলা যায়।
এর জবাবে এনসিপি নেতা খালেদ সাইফুল্লাহ অভিযোগ করেন, বিএনপি তাদের অবস্থান বদলে ফেলছে। খালেদ বলেন, ২০২২ সালে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নিজে আওয়ামী লীগের আইনের সমালোচনা করেছিলেন নির্বাচন কমিশন সদস্যদের নিয়োগে সার্চ কমিটি গঠনের জন্য। এখন বিএনপি ক্ষমতায় আসার পথ দেখছে বলে নিজেদের সুবিধার জন্য সেই কথা ভুলে গেছে। তিনি আরও বলেন, আমরা অতীতে দেখেছি, কীভাবে দুর্নীতি দমন কমিশনকে নখদন্তহীন বাঘে পরিণত করা হয়েছিল। বিএনপি এনসিসির বিরোধিতা করছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর বিকল্প প্রস্তাব দেয়নি।
জামায়াতের অবস্থান :
বিকেলে দ্বিতীয় দফায় সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন জামায়াতের নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের। এসময় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান ও এইচ এম হামিদুর রহমান আজাদ উপস্থিত ছিলেন।
ডা. তাহের বলেন, আজকে দুটি বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। একটা হচ্ছে এনসিসি। ন্যাশনাল কনস্টিটিউশনাল কাউন্সিল এবং এব্যাপারে অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই ঐকমত্য পোষণ করেছে নীতিগতভাবে। মডিউল, ফাংশনাল ও স্ট্রাকচারাল যে অথোরিটি এসব বিষয়গুলোর আলোচনা শেষ হয়নি। আরেকটি পয়েন্ট হলো প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। আমাদের সিস্টেম হলো পার্লামেন্ট প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে। ঐকমত্য কমিশন যেটা রেফার করেছে; প্রেসিডেন্ট নির্বাচনটি গ্রাসরোট লেবেল (তৃণমূল পর্যন্ত) আপটু মেম্বার পর্যন্ত ইলেকট্ররাল বডি তৈরি হবে। এটা প্রায় ৭০ হাজার, এবং তাদের মাধ্যমে ভোটে ডাইরেক্ট নির্বাচিত হবে। তিনি বলেন আমাদের এখানে মত হচ্ছে --- একটা টেকনিক্যাল ইস্যু। যদি স্থানীয় সরকার নির্বাচন কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে হয়, কারণ আমরা অতীতে দেখেছি যে সরকারের অধীনে লোকাল গভর্মেন্ট নির্বাচন হয়, তারাই হয়ে যায়। এখানে সত্তর হাজার লোক আর সত্তর লক্ষ মানুষের কোন ব্যবধান নাই। সেজন্য আমরা দুটো কথা বলেছি যে, প্রথম হচ্ছে কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে লোকাল গভর্নমেন্ট নির্বাচন হতে হবে; যেখানে ফেয়ার ইলেকশনের মাধ্যমে মেম্বাররা নির্বাচিত হবে এবং তাদের নিয়ে যে কনস্টিটিইউন্সি তৈরি হবে, সেটার ব্যাপারে আমরা ডাইরেক্ট ইলেকশনের পক্ষে। তবে মেম্বার পর্যন্ত হবে নাই কনসাইজ করে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান পর্যন্ত থাকবে তা নিয়ে আমরা আলোচনার পক্ষে।
এনসিপির বক্তব্য :
জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল-এনসিসি গঠন না হলে গণঅভ্যুত্থান ও সংস্কার কমিশন ব্যর্থ হবে বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় ধাপে দ্বিতীয় দিনের আলোচনা শেষে তিনি সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন কমিশন ও দুর্নীতি দমন কমিশন নিয়ে ব্যাপক বিরোধিতা দেখিয়েছিল এবং ভবিষ্যতে তারা ক্ষমতায় গেলে এ বিষয়গুলো সংস্কার করবে বলেও প্রস্তাবনা রেখেছিল। কিন্তু এখন মনে হয়েছে কয়েকটি দল এনসিসি গঠনের বিষয়ে বিরোধিতা করেছেন। তিনি বলেন, এই এনসিসির বিষয়ে কোনো বিকল্প প্রস্তাব তারা দেয়নি। যারা এটার বিরোধিতা করেছেন তারা যেন একটা বিকল্প প্রস্তাব দেয়। তা না হলে গণঅভ্যুত্থান ও সংস্কার প্রস্তাবনা ব্যর্থ হবে।
তিনি বলেন, আমরা প্রশ্ন রেখেছিলাম দুর্নীতি দমন কমিশন, নির্বাচন কমিশন, মানবাধিকার কমিশনসহ গুরুত্বপূর্ণ কমিশনগুলো বিগত সময়ে দলীয়করণ হয়েছে এবং বিরোধী দল-মত দমনে ও ভোটাধিকার হরণেও তারা ভূমিকা রেখেছে। এই অবস্থা থেকে উত্তোরণের উপায় হিসেবে সংস্কার কমিশন প্রস্তাবনা করেছে একটা এনসিসি বা কাউন্সিল প্রয়োজন। যেখানে নিরপেক্ষতা ও আস্থার ভিত্তিতে আমরা নিয়োগগুলো করতে পারবো।
আজকের ঐকমত্য কমিশনের সভা হতাশার উল্লেখ করে নাহিদ ইসলাম বলেন, সার্বিকভাবে আজকের দিনটা হতাশার। আমরা আশা করছিলাম এনসিসির বিষয়ে নীতিগত ঐক্যে আমরা আসতে পারবো যাতে করে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঐকমত্য আস্থার ভিত্তিতে নিরপেক্ষ ও নিয়োগ হবে। একদলীয়ভাবে আগের মতো প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা অনুযায়ী নিয়োগ হবে না। কিন্তু সেই ঐকমত্য হয়নি। তিনি আরও বলেন, এনসিসি গঠন না হলে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো আগের নিয়মে চলবে বলে শঙ্কা ও সংশয় তৈরি হয়েছে।
এবি পার্টির সভাপতি মুজিবুর রহমান মঞ্জু বলেছেন, এনসিসি গঠনে সমর্থন দেওয়া একটি নৈতিক বাধ্যবাধকতা। আমরা যদি এনসিসির মতো জবাবদিহি ব্যবস্থা তৈরি না করি, তাহলে গণঅভ্যুত্থানের মূল চেতনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে। বর্তমানে পুরো সাংবিধানিক নিয়োগের ওপর নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্ব রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের জন্য হাজারো তরুণ জীবন দিয়েছে। আমরা এটা নষ্ট হতে দিতে পারি না। উপস্থিত ৩০টি দলের অধিকাংশই এনসিসি গঠনের সমর্থন দিয়েছে।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, স্থিতিশীল ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য এনসিসির মতো তদারকি সংস্থার বিষয়ে একমত হওয়া অপরিহার্য। এটি নতুন কিছু নয়Ñঅনেক গণতান্ত্রিক দেশে এমন কাউন্সিল আছে। অন্তত নির্বাচন কমিশন, দুদক ও পাবলিক সার্ভিস কমিশনে নিয়োগ এনসিসির মতো কাঠামোর মধ্য দিয়ে হওয়া উচিত।