আন্দোলনে অংশ নেওয়ার অপরাধে স্কুলছাত্র ইউসূফকে
গুম করে র্যাব ॥ শরীরে পাওয়া যায় ১৮ বুলেট
মুজাহিদুল ইসলাম ইউসুফ। পাইয়ুনিয়র স্কুল এন্ড কলেজের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। জুলাই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন মা-বাবাকে না জানিয়েই। আন্দোলনে অংশ নেওয়ার অপরাধে তাকে গুম করে রাখে র্যাব। তার শরীরে লাগে ১৮টি বুলেট। স্কুল শিক্ষার্থী হয়েও আন্দোলনে অংশ নেওয়ার গল্প দৈনিক সংগ্রামকে বলেছেন ইউসূফ। লিখেছেন ইবরাহীম খলিল।
বয়স মাত্র ১২/১৩। নবম শ্রেণিতে চলছে পড়া শোনা। অবিভাবকের সাই নেই। কিন্তু আন্দোলনে তো যেতেই হবে। বন্ধুরা সবাই অংশ নিচ্ছে। প্রথম প্রথম অবিভাবকের কথা শুনলেও পরে সিদ্ধান্ত নেই মাকে না বলেই যাবো আন্দোলনে। যেই কথা সেই কাজ। বন্ধুদের সাথে চলে যাই উত্তরার বিএনএস ভবনের সামনে। সেখান থেকে র্যাব গুম করে রাখে। শরীরে আবিস্কার করি ১৮টি বুলেট।
টঙ্গীর গাজীপুরায় বাসায় বসে শিশু ইউসূফ শুনিয়েছেন তার আন্দোলনে অংশ নেওয়ার গল্প। ইউসূফ বলেন, এক বছর আগের এই দিনগুলোতে আমিসহ আমাদের পুরো দেশ একটা গোটা জেনারেশন আমাদের দেশে সংঘটিত হওয়া জুলাই যুদ্ধের সাক্ষী হয়েছে। জুলাই যুদ্ধে যদিও আমার অবদান খুবই সামান্য। মুজাহিদুল ইসলাম ইউসূফ বলেন, আমি আসলে জুলাই যুদ্ধ যদিও জুলাইয়ের প্রথম দিক থেকে শুরু কিন্তু মায়ের নিষেধাজ্ঞার কারণে ইচ্ছা থাকলেও জুলাই মাসের শুরুর দিকে অংশ নিতে পারিনি। বাসা থেকে নিষেধ করার কারণেই পারিনি। এছাড়া আমার বাসার পাশের সবাই আওয়ামী লীগ করে। তারা আমার ক্রিটিসাইজ করতো। তাই সবার সাথে আন্দোলনে শামিল হতে পারিনি। কিন্তু স্কুলের বন্ধুদের কাছ থেকে সব সময় আন্দোলনের গল্প শুনেছি। আর আফসোস করেছি, যদি আন্দোলনে অংশ নিতে পারতাম!
অবশেষে ১৮ জুলাই উত্তরা বিএনএস আন্দোলন হচ্ছে শুনে বন্ধুদের নিয়ে মাকে না জানিয়েই চলে গেলাম। সেদিন সেখানে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। সকালবেলা ৯টার দিকে আমরা সবাই মিলে চলে যাই। এর এক ঘন্টা পর আনুমানিক দশটার দিকে শুরু হয় পুলিশ আর ছাত্র লীগের গুলীবর্ষণ। সাথে স্মোক গ্রেনেড আর সাউন্ড গ্রেনেড হামলা। মানুষ দিকবিদিক ছুটাছুটি করতে শুরু করে। আমরা কোনদিকে যাবো বুঝতে পারছিলাম না। সবাই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম। কি করবো বুঝে উঠতে না পেরে আমরা আট নয় জন কোনভােেব একটি শপিং মলের অভ্যন্তরে আশ্রয় নিলাম। ততক্ষণে পুলিশের বেপরোয়া গুলি চললো সবার ওপর। শপিংমলে ঢোকার পর স্মোক গ্রেনেডের কারণে চোখ মুখ জ্বলছিল, এরই সাথে নিজের শরীরে ১৮টা রবার বুলেট আবিষ্কার করি।
এরপরও পুলিশ র্যাবের আক্রমণ থামছিল না। মার্কেটের ভেতরেও পুলিশের তল্লাশি চলছিল। দৌড়াদৈাড়ির এক পর্যায়ে আমি আমার বন্ধুদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। ওই মুহূর্তে কয়েকজন পুলিশ সদস্য শপিং মলের ভেতরে আমার কাছে আসে এবং ইট দিয়ে মুখে আঘাত করে। আমার মুখ থেকে কল কল করে রক্ত বের হতে থাকে। এরপরও মার্কেট থেকে বের হওয়ার জন্য বলতে থাকে। আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। এরপরও অনবরত পুলিশ আমার ওপর আঘাত করতেই থাকে। জানি বের হলেই আমাদের ওপর আরও আঘাত আসবে। তাই বের না হওয়ার চেষ্টা করি।
পুলিশের আক্রমণ আর পিটুনিতে মার্কেটের ভেতর না থাকতে পেরে বের হই। বের হয়ে মেইন রোডে আসতেই আমি এবং সঙ্গীরা র্যাবের সামনে পড়ে যাই। আমাদের সবাইকে র্যাব আটক করে। আমরা ছোট আর শিক্ষার্থী বলার পরও তারা মানেনি। আমাদের সবাইকে পেটাতে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ পেটানোর পর আমাদের গাড়িতে তোলা হয়। পরে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় উত্তরার র্যাব-১ এর কার্যালয়ে। আমাদের কাছ থেকে মোবাইল ফোন নিয়ে নেওয়া হয়। ফলে কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি। আবারা কাউকে খবর দিতেও দেওয়া হয়নি। বার বার অবিভাবকের সাথে যোগাযোগ করতে চাইলেও তারা সেই সুযোগ দেয়নি। আমাদেরকে র্যাব-১ এর অফিসে আটকে রাখা হয় দুপুর বারোটা থেকে রাত বারোটা অবধি।
রাতে আমাদের অবিভাবকদের কাছে কল দেওয়া হয়। বলা হয় অতি তাড়াতাড়ি উত্তরা র্যাব অফিসে যাওয়ার জন্য। আমার মা কল পেয়ে আমাকে নিতে আসেন। আমার সকল ডিটেলস সহ মায়ের দস্তখত নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয় আমাকে। একইভাবে অন্যদেরও একে একে ছেড়ে দেওয়া হয়। সেদিন আমি বেঁচে গেলেও আমার অসংখ্য ভাই বোন জুলাইয়ে নিজের প্রাণ অকাতরে বিলিয়েছে। অসংখ্য ভাইবোনকে আজীবন পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে। তাদের জীবনের বিনিময় আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ। জুলাই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা প্রত্যেক ভাই-বোনের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
মুজাহিদুল ইসলাম ইউসুফের মা আয়েশা আক্তার সেদিনের স্মৃতিচারণ করে বলেন, সারাদিন ছেলেকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কেউ স্বীকার করছিল না। আমি বুঝতে পারছিলাম যে আমার ছেলে নিশ্চয় আন্দোলনে গেছে। হাসপাতালগুলোতে খোঁজ নেওয়া শুরু করি। আহত কিংবা নিহত হয়ে থাকলে লাশটা অন্তত পাওয়া যায় কি-না। ততক্ষণে উত্তরায় বিভিষীকাময় পরিস্থিতি। ঘর থেকে বাইরে বের হওয়া দুষ্কর। আমার ভাইয়েরা সাংবাদিকদের খবর দেওয়া শুরু করে। আমার ভাইয়েরা আন্দোলনে যুক্ত থাকায় রাস্তায় বের হতে পারছিল না। তাদের নামে আগে থেকেই রাজনৈতিক মামলা ছিল। আমার অপেক্ষার শেষ হয় না। গভীর রাতে আমাকে ফোন করা হয় র্যাব অফিস থেকে। পুরুষ মানুষ একজনও যাওয়ার মতো নাই। কারো বাইরে যাওয়ার সুযোগ নাই। টঙ্গী থেকে মেইন রোড দিয়ে কাউকে যেতে দিচ্ছে না। এরপরও আমি মা আমার ছেলের সন্ধান পাওয়া গেছে। আমাকে যেতেই হবে। আমি বাসা থেকে বের হয়ে যাই। দেখি রাস্তায় নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে মানুষকে। মানুষ দেখলেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। আমি মেইন রোড থেকে অনেক দূর দিয়ে উত্তরার র্যাব অফেিসর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। দেখি মূল সড়কে ইট পাথর টেয়ার গ্যাসের এমন পরিস্থিতি যে হাঁটার উপায় নাই। মাঝে মাঝেই ছোপ ছোপ রক্ত। এক বিচ্ছিরি পরিস্থিতি। আমি অনেক ঘুরে র্যাব অফিসে পৌছাই এবং ছেলের মুখ দেখে আত্মায় পানি ফিরে পাই। ছেলের মুখ দেখে এই শান্তনা পাই যে, অন্তত ছেলেটা বেঁচে আছে।