বিগত আওয়ামীলীগ সরকারের লুটপাটের অন্যতম ছিল বিদ্যুৎ খাত। কোন নিয়ম কানুন না মেনে দায়মুক্তি অধ্যাদেশ জারি করে এখাত থেকে লুট নেয়া হয়েছে কোটি কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ব অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হলেও সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি থেকে কখনো আনুষ্ঠানিক অনুমোদন নেয়া হয়নি। বিপিডিবি শুধুমাত্র সে সময় বিদ্যুৎ বিভাগ কিংবা জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের অনুমোদনক্রমে পৃথক বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি অনুযায়ী এসব কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনেছে । সরকার পরিবর্তনের পর বিদ্যুতখাত সংস্কারের উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। যে দিকে হাতে দেয় শুধু লুটপাটের ক্ষত চিহ্ন দেখতে পায়।
এরই মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয়টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের শুল্কহার কমানোর প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। কয়েক বছর ধরে বাণিজ্যিকভাবে চালু থাকা এসব কেন্দ্রের নতুন শুল্কহার অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে উপদেষ্টা পরিষদের অর্থনৈতিক বিষয়ক কমিটি।
বিপিডিবি সূত্র জানিয়েছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট (আরওই) ১২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৬ শতাংশ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এর ফলে শুল্কহারও আনুপাতিক হারে হ্রাস পাবে। মোট ৭০৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার এই ছয় কেন্দ্রের মধ্যে চারটি গ্রামীণ বিদ্যুৎ কোম্পানি লিমিটেডের (আরপিসিএল) এবং দুটি বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানি লিমিটেডের (বিআর পাওয়ারজেন)।
আরপিসিএলের মালিকানাধীন কেন্দ্রগুলো হলো ময়মনসিংহ ২১০ মেগাওয়াট, কোদ্দা ৫২ দশমিক ১৯৪ মেগাওয়াট, রাউজান ২৫ দশমিক ৫০ মেগাওয়াট ও গাজীপুর ১০৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র। অন্যদিকে মীরসরাই ১৬৩ মেগাওয়াট ও কোদ্দা ১৫০ মেগাওয়াট কেন্দ্র দুটি পরিচালনা করছে বিআর পাওয়ারজেন।
সূত্র জানায়, ২০১২ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হলেও সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি থেকে কখনো আনুষ্ঠানিক অনুমোদন নেয়া হয়নি। বিপিডিবি শুধুমাত্র সে সময় বিদ্যুৎ বিভাগ কিংবা জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের অনুমোদনক্রমে পৃথক বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি অনুযায়ী এসব কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনেছে বলে জানা গেছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের এক অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষায় বিষয়টি সামনে আসার পর বিদ্যুৎ বিভাগ ও বিপিডিবিকে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে। ইতিমধ্যেই অর্থ মন্ত্রণালয় ২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রে ভর্তুকি প্রদানের অর্থ আটকে দিয়েছে।
বিপিডিবির তথ্য অনুযায়ী, হাই সালফার ফুয়েল অয়েল (এইচএসএফও) চালিত কেন্দ্রগুলোতে ইউনিটপ্রতি (কিলোওয়াট-ঘণ্টা) বিদ্যুতের দাম ২০-২২ টাকা, কয়লা চালিতগুলোতে ১১-১৩ টাকা এবং গ্যাস চালিতগুলোতে ৫-৬ টাকা।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ সমিতির (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম এ ঘটনাকে ‘গুরুতর অনিয়ম’ আখ্যা দিয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে দুর্নীতি তদন্তে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে একটি স্বাধীন কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছেন। এনার্জি ক্রাইমে জর্জরিত এ খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে স্টেকহোল্ডারদের সম্পৃক্ত করতে হবে জানান তিনি।
এদিকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর বহু বছরের প্রচেষ্টা চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে এবং আমদানি করা জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা দেশটিকে বৈশ্বিক মূল্য ওঠানামা ও সরবরাহ ঘাটতির ঝুঁকিতে ফেলছে বলে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন।
আন্তর্জাতিক জ্বালানি অর্থনীতি ও আর্থিক বিশ্লেষণ ইনস্টিটিউটের (আইইইএফএ) এক নতুন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমদানি করা জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মোট বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রায় ৬৫ শতাংশই এসেছে আমদানি থেকে যার মধ্যে রয়েছে বিদ্যুৎ আমদানি এবং দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত আমদানি করা জ্বালানি। এটি ২০১৯-২০ অর্থবছরের তুলনায় জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতায় ৬৩ শতাংশ বৃদ্ধি নির্দেশ করে, যেখানে একই সময়ে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে ৪৩ শতাংশ।
আইইইএফএ’র প্রধান বিশ্লেষক শফিকুল আলম বলেন, পরিণাম ইতোমধ্যেই দৃশ্যমান। ডলার-নির্ভর আমদানি ঢাকাকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করছে; হয় এলোমেলো লোডশেডিং করে সরবরাহ সীমিত করতে হচ্ছে, অথবা ব্যয়বহুল তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে হচ্ছে গ্রিড সচল রাখতে। এদিকে দেশের সবচেয়ে কার্যকর গ্যাসভিত্তিক অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র গ্যাসের অভাবে নিস্ক্রিয় পড়ে আছে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০১২ সাল থেকে জাতীয় গ্রিড নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহে ব্যর্থ হওয়ায় শিল্প খাত ব্যাপকভাবে নিজেদের ‘ক্যাপটিভ পাওয়ার’ বা স্বতন্ত্র বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থায় বিনিয়োগ করেছে। এতে বলা হয়েছে, “কিছু খাত দক্ষতায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে, কিন্তু অনেকেই এখনো পুরোনো, অপচয়ী জেনারেটর ব্যবহার করছে।”
আইইইএফএ অনুমান করছে, যদি শিল্প খাত তাপ-পুনরুদ্ধার প্রযুক্তি গ্রহণ করে এবং পুরোনো যন্ত্রপাতি বদলায়, তবে বছরে ৫ হাজার কোটি ঘনফুট আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সাশ্রয় করা সম্ভব হবে।কিন্তু ক্যাপটিভ পাওয়ার বৃদ্ধির কারণে এক ধরনের উল্টো প্রভাব তৈরি হয়েছে। এতে জাতীয় গ্রিডের জন্য অত্যাধুনিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে সরবরাহ করার বদলে মূল্যবান গ্যাস শিল্প খাতের কম দক্ষ ইউনিটে চলে যাচ্ছে। ফলে আধুনিক কেন্দ্রগুলো অব্যবহৃত থাকে। এই অব্যবহৃত কেন্দ্রগুলোর জন্য সরকারকে ‘ক্যাপাসিটি পেমেন্ট’ দিতে হয় অর্থাৎ বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলেও মালিকপক্ষকে টাকা দিতে হয়। এতে খরচ আরও বেড়ে যায়। দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকলে এসব কেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্তও হয়, যা ভবিষ্যতে প্রযুক্তিগত জটিলতা তৈরি করে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ঢাকা এখন এক কঠিন মোড়ের সামনে দাঁড়িয়েছে। হয় শিল্পের ক্যাপটিভ জেনারেটরে কঠোর দক্ষতা মানদণ্ড আরোপ করতে হবে, নয়তো জাতীয় গ্রিডকে এতটাই শক্তিশালী করতে হবে যেন এগুলো কেবল ব্যাকআপ হিসেবেই থাকে।
যে পথ বেছে নেওয়া হবে, তাই নির্ধারণ করবে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত কতটা সহনশীল হবে, বিশেষ করে ২০২৬ সালের নভেম্বরে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের পর আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার ক্ষেত্রে। চাহিদা বাড়তে থাকায় সরকার আগাম সংকট মোকাবিলায় উদ্যোগ নিয়েছে।
২০২৫ সালের গ্রীষ্মে সর্বোচ্চ ব্যবহার ১৮ হাজার মেগাওয়াটে পৌঁছাতে পারে বলে অনুমান করা হয়েছিল, যেখানে ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে সর্বোচ্চ ব্যবহার ছিল ১৭ হাজার মেগাওয়াট। এ কারণে আগেভাগেই কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়: ফেব্রুয়ারিতে একটি সার্কুলারে বলা হয় গৃহস্থালি শীতাতপ নিয়ন্ত্রকের তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে সেট করা যাবে না। পাশাপাশি টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সরকারি অফিসের জন্য নতুন দক্ষতা মানদণ্ড নির্ধারণ করে।
অপ্রত্যাশিত ভারি বৃষ্টিতে কিছুটা স্বস্তি আসে, ফলে ঠান্ডা রাখার চাহিদা কমে যায়। জুলাই মাসে সর্বোচ্চ চাহিদা দাঁড়ায় ১৭ হাজার ৯৯ মেগাওয়াটে, যা গত বছরের তুলনায় সামান্য কম। কিন্তু এই স্বস্তি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। সেপ্টেম্বরে কয়লা ও গ্যাস আমদানির ঘাটতি ব্যাপক লোডশেডিং সৃষ্টি করে, প্রতিদিন গড়ে ৪০৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ঘাটতি দেখা দেয়। এপ্রিলের শেষ দিকে এক পর্যায়ে ঘাটতি ২ হাজার ৩৫৩ মেগাওয়াটে পৌঁছায়।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ৩১ আগস্ট থেকে ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে গ্যাস সংকটে পড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ১২ থেকে বেড়ে ১৯-এ পৌঁছায়। এর ফলে ঘরবাড়িতে হঠাৎ ব্ল্যাকআউট হয় এবং শিল্প খাতে উৎপাদন ক্ষতি ও খরচ বেড়ে যায়। বাংলাদেশের এই অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ।
নীতিনির্ধারক ও বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, যদি ঢাকা অপচয় কমাতে না পারে এবং জ্বালানি মিশ্রণে বৈচিত্র না আনে, তবে অর্থনীতি চাঙ্গা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শীতলীকরণের চাহিদা বাড়ার ফলে এই ভঙ্গুরতা আরও গভীর হবে।
আইইইএফএ’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,দেশটির বিদ্যুৎ ব্যবস্থাকে শুধু বড় নয়, আরও সহনশীল হতে হবে। এর মানে হলো অপচয় কমানো, ডলার-নির্ভর জ্বালানি আমদানি থেকে বেরিয়ে আসা, এবং এমন একটি আধুনিক গ্রিডে বিনিয়োগ করা যা নবায়নযোগ্য জ্বালানি অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম।