আমাদের দ্বারা কেউ কষ্ট পেয়ে থাকলে বিনা শর্তে মাফ চাই

মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামকে সুপ্রীম কোর্ট বেকসুর খালাস দেয়ার রায়ের পর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান তার প্রতিক্রিয়ায় মহান আল্লাহ তায়ালার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেছেন, শেষ পর্যন্ত সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই রায়ে প্রমাণিত হলো যে, সত্য চেপে রাখা যায় না।

গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর কাকরাইলে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সের মুক্তিযোদ্ধা মিলনায়তনে আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী বিগত শেখ হাসিনার স্বৈরশাসন আমলে ভয়ঙ্কর জুলুম নির্যাতনের শিকার হয়েছে। জুলুম করে আমাদের বুক থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে ১১জন শীর্ষ দায়িত্বশীল নেতাকে। মিথ্যা মামলা দিয়ে এবং মিথ্যা সাক্ষী বানিয়ে; যাকে জুডিশিয়াল কিলিং বলা হয়েছে। তিনি বলেন সুপ্রীম কোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ আজ এটিএম আজহারুল ইসলামকে সকল অভিযোগ থেকে খালাস দিয়েছে। জাতির এই সংকটময় মুহূর্তে কঠিন বাঁকে তারা তাদের প্রজ্ঞা দূরদর্শিতা দিয়ে পথ দেখাতে পারতেন আমাদের। কিন্তু তাদের দুনিয়া থেকে বিদায় করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু তাদের শিক্ষা এবং কর্ম আমাদের পাথেয়। তারা বেঁচে থাকলে এই জাতিকে সততার সঙ্গে সেবা দিতেন এবং রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আসতো।

ডা. শফিকুর রহমান বলেন, তাদের বিচারের ক্ষেত্রে সীমাহীন জাল জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। কিভাবে তা করা হয়েছে তা সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা নিজের অপরাধ স্বীকার করে তার লেখা নিজের বইয়ে বলেছেন। কিভাবে বিচার করা হবে তা ঠা-া মাথায় তার ছক বিচার বিভাগ এবং সরকার মিলে তৈরি করেছিল। এর পাশাপাশি এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল অন্যায়ের প্রতিবাদ করার মতো সামান্যতম সুযোগটুকু দেওয়া হয়নি। যে কয়টা রায় বাস্তবায়ন করা হয়েছে, যাদের খুন করা হয়েছে বিচারিক আদালতের মাধ্যমে তারা তো আল্লাহর দরবারে চলে গেলেন। একই সময়ে পরিবারের সদস্যদের ও নির্মম অত্যাচার করা হয়েছে।

উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি যেদিন জোর করে কার্যকর করা হলো- সেই রাতে তার বাসায় হামলা করা হলো। তার পরিবারের সদস্যদের শারীরিকভাবে নাজেহাল করে কষ্ট দিয়ে জেলে দেওয়া হলো। একেকটা পরিবার ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। চলে যেতে হয়েছে বিদেশে। আজকে যার রায় হলো তার একটা মেয়ে ছাড়া দেশে কেউ নেই। ছেলেটাও দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। মাঝখানে একটা নিমন্ত্রণে এসেছিল আমরাই বলেছি বাবা তুমি চলে যাও। স্কাইপি কেলেঙ্কারির ঘটনাতো সারাবিশ^ জানে। ধিকৃত হয়েছে, তিরস্কৃত হয়েছে। গোটা বিচার প্রক্রিয়ার সময় দুইটা টর্চার সেল বানানো হয়েছে। একটার নাম দেওয়া হয়েছিল সেফ হোম। আরেকটার নাম দেওয়া হয়েছিল সেফ হাউস। সেফ হোমে ভিকটিম নেতৃবৃন্দদের নিয়ে নাজেহাল করা হতো। সেখানে জিজ্ঞাসাবাদে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মানা হতো না। সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দিনের পর দিন অত্যাচার করা হয়েছে। আমরা তখন নিরবে সহ্য করেছি। সংযত অবস্থান থেকে প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছি। চোখের পানি দিয়ে আল্লাহকে বলেছি।

সেফ হোমে নির্যাতনের পাশাপাশি মিথ্যা সাক্ষী দেওয়ার জন্য লোকজনকে ধরে এনে সেফ হাউসে রাখা হতো। এর সব কিছু তখনকার মিডিয়াতে উঠে এসেছে। সারা বিশ^ মানবাধিকার সংগঠন, বিবেকবান রাষ্ট্রনায়ক ও মানুষের পক্ষ থেকে এই বিচার প্রক্রিয়ার নিন্দা করা হয়েছে। স্পেশাল এনভয় পাঠিয়ে স্বচ্ছ বিচার করার জন্য তাদের অনেক পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তারা জাতে স্বচ্ছ বিচার হলে খুন করা যাবে না।

জামায়াতের আমীর বলেন, আমরা ও আমাদের নেতৃবৃন্দ দেশকে ভালবাসি। ভালবাসার জায়গা থেকে তারা চেষ্টা করেছেন দেশের জন্য ভাল কিছু করার জন্য। তাদের সবটুকু যোগ্যতা উজার করে দিয়ে বাংলাদেশে সুস্থধারার রাজনীতি প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন। শুধু অবস্থানে থেকে রাজপথে নয়; সরকারের ক্ষুদ্র অংশ হওয়ার পরও সেখানে গিয়ে চেষ্টা করেছেন সরকার ব্যবস্থাপনাকে ভাল করা যায় কি-না। দুজন মন্ত্রী তিনটি মন্ত্রণালয় পরিচালনায় আল্লাহতায়ালা বিশেষভাবে সাহায্য করেছেন। তারা সততা এবং স্মার্টনেসের সাথে পুরো সময়জুড়ে তাদের দায়িত্ব পালন করেছেন। এটা একটা বিরল প্রমাণ, বাংলাদেশের জনগণের জন্য রেখে গেছেন। সততার নজিরবিহীন উদাহরণ তারা রেখে গেছেন। আমরা আশা করি তাদের অবদান জাতিকে অনুপ্রাণিত করবে যুগের পর যুগ।

তিনি বলেন, আদালত পরিচালনা করতে গিয়ে কি হয়েছে তা আপনারা দেখেছেন। আদালতে ট্রায়াল চলা অবস্থায় গুমের পরিবারের সদস্যদের কারো সাক্ষ্য নেওয়া হয়নি। বরং একভাই সাক্ষ্য দিতে এসেছিলেন যার নাম সুখরঞ্জন বালি। তাকে আদালত প্রাঙ্গন থেকে অপহরণ করা হয়েছে। সরকারী বাহিনী তাকে অপহরণ করেছে। নির্যাতন করে ভারতের মাটিতে ফেলে এসেছে। জেল খেটে দীর্ঘদিন পর ফিরে এসেছে। আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। তিনি শুধু বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সম্পদ ছিলেন না। তিনি ছিলেন সারা বিশে^র বিশ^াসী মানুষের সম্পদ। তার সাথে কি আচরণ করা হয়েছে আপনারা দেখেছেন। তার মামলার ব্যাপারে সঠিক কথাটা বলতে সাহস করে সুখরঞ্জন বালি এসেছিলেন। কিন্তু আইনজীবীর গাড়ির দরজা খুলে সেখান থেকে কিডনাপ করা হয়েছে। এর আগে বাংলাদেশের আদালতে জীবনেও এরকম ঘটনা ঘটেনি।

ডা. শফিকুর রহমান বলেন, পাতানো ট্রায়ালের খবর মিডিয়াতে এসেছে। আপনারা দেখেছেন। বিচারক বলছেন খাড়াইয়া যাবেন আমি বসাইয়া দেবো। তখন জনগণ বুঝবে আমাদের মধ্যে কোন বোঝা পড়া নাই।’ আপিল বিভাবে ট্রায়াল হয়েছে, আর প্রধান বিচারপতি সরকার পক্ষের কৌসুলীকে বলছেন আপনারা যে ডকুমেন্ট দিয়েছেন তাতেতো মতিউর রহমান নিজামীকে এক মিনিটের শাস্তি দেওয়ার সুযোগ নেই। আমরা আশা করেছিলাম সত্য কথাটার মর্যাদাটা তিনি রাখবেন। কিন্তু না আগেই যে ছক কাটা। বিদেশ থেকে সাপ্লাই দেওয়া রায়ের ভিত্তিতে তাকেও একই পরিণতির দিকে ঠেলে দেওয়া হলো। তিনি বলেন, বহু কায়দা কানুন করে নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে জোর করে যা নয় তা স্বীকার করানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এমনকি রায় বাস্তবায়নের আগেও চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তারা ছিলেন স্থির চিত্ত, ঈমানের বলে বলিয়ান। তারা ছিলেন সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এজন্য মহান আল্লাহর ওপর ভরসা করে ফাঁসির তক্তার ওপর গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। কিস্তু অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। তারা আমাদের শিখিয়ে গেছেন যে মর্যাদাবান জাতি সত্যের ওপর অবিচল থাকলে ফাঁসি কোন বিষয় নয়। মৃত্যু একবারই হবে। তবে অপমানের মৃত্যু নয়। মৃত্যুটা হঊক বীরের মতো। তাদের মৃত্যু ছিলো বীরোচিত মৃত্যু।

এই মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে ইন্টারন্যাশনাল কাস্টমারি যে ল আছে তা ফলো করা হয়নি। আবার ডমেস্টিক কাস্টমারি যে ল আছে এটাও ফলো করা হয়নি। সাক্ষ্য আইনকে বেমালুম দলিত মথিত করা হয়েছে। আমাদের দেশের সাক্ষ্য আইনকে মোটেও ফলো করা হয়নি। সেদিন সংবিধান কোন বিষয় ছিল না আইন কোন বিষয় ছিল না। যাদের ইশারায় কোর্ট পরিচালনা করা হতো তাদের ইচ্ছা-ই ছিল আইন।’ সেটা বৈধ হউক আর অবৈধ হউক।

তিনি বলেন, এই ধরনের একটি মামলা বৃটেনে পরিচালিত হয়েছে। বৃটেনের উচ্চ আদালত তাদের রায়ে বলেছে এই মামলাগুলো ছিলো বিচারের নামে জাস্ট জেনোসাইড অব দ্য জাস্টিস। বিচারকে গণহত্যা করা হয়েছে। তারা কিলিং অব দ্য জাস্টিস বলেনি। সিঙ্গেল কেইস হলে বলতো কিলিং। এখানে ছিল একাধিক কেইস। তিনি বলেন আমরা তাদের স্মরণ করবো আমাদের কর্মের মাধ্যমে। তাদের রেখে যাওয়া কাজের আমানত দারিতার মাধ্যমে।

জামায়াতের আমীর এটিএম আজহারের ব্যাপারে আদালতের রায়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলেন, বৃটেনের আদালত বলেছে জেনোসাইড টু দ্য জাস্টিস আজকে আমাদের আদালত আপিল বিভাগ বলেছে, মিস ক্যারিয়েজ অব দ্য জাস্টিস। ন্যায়ভ্রষ্ট রায়। অন্যায় রায়। হ্যা এই রায়ের মধ্য দিয়ে প্রমাণ হলো এটা ছিল ইচ্ছাকৃত নেতৃত্ব গণহত্যা।

তিনি বলেন, দায়িত্বশীল নেতা ঘন ঘন জন্মায় না ঘরে ঘরে জন্মায় না। এটা আল্লাহর দান। একটা রাজনৈতিক দলের নেতাদের হত্যার করার অর্থই হচ্ছে জনগণকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেওয়া।

তিনি আবারো বলেন, সত্য মেঘের আড়াল ভেদ করে আলোর ঝলক নিয়ে আসে। সেই সত্যটাকে আল্লাহ আমাদেরকে দেখালেন।

তিনি বলেন, ‘বিপদ ঘাড়ে নিয়েও আমরা চেষ্টা করেছি দেশবাসীর বিপদে পাশে থাকার। এমনকি ফ্যাসিস্ট সরকার বিদায় নেওয়ার পরেও আমরা চেষ্টা করেছি আমাদের শহিদ পরিবার, আহত পঙ্গু ভাই-বোনদের পাশে থাকার। কিন্তু আমরা এটা বিশ্বাস করি যে, আমাদের পুরো কর্তব্য আদায় করতে পারিনি অনেক সীমাবদ্ধতার কারণে। আমাদের সীমাবদ্ধতা ক্ষমা করবেন। আমাদের কোন আচরণে, কোন পারফরমেন্সে আপনারা কষ্ট পেয়ে থাকলে আমাদের ক্ষমা করে দিবেন। যখন যেভাবে হউক, মানুষ আমরা ভুলের উর্ধ্বে না। দল হিসেবে আমরা বলি না যে ভুলের উর্ধ্বে। এই সংগঠনের প্রতিটি কর্মী সহকর্মী কিংবা দলের দ্বারা যে যেখানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, কষ্ট পেয়েছেন, সবার কাছে কোন শর্ত নাই বিনা শর্তে মাফ চাই। আপনারা আমাদেরকে ক্ষমা করে দিবেন।

তিনি আরও বলেন, ‘দেশবাসীর সমর্থন ও সহযোগিতায় যদি এই দেশের সেবা করার দায়িত্ব আমাদের ওপরে আসে, আমরা প্রতিশোধের রাজনীতির অবসান ঘটাবো, বৈষম্যের রাজনীতির অবসান ঘটাবো ইনশাআল্লাহ।

তিনি মিডিয়ার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং দেশের অসমাপ্ত ইস্যুগুলো অগ্রাধিকার ও দেশের স্বার্থকে সামনে রেখে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি বলেন দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেলে বৈষম্যমূক্ত, দুর্নীতিমুক্ত, মানবিক বাংলাদেশ গড়ে তুলে।

কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য এবং কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি এড. মতিউর রহমানের সঞ্চালনায় সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন নায়েবে আমীর সাবেক এমপি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান ও সাবেক এমপি ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোঃ তাহের, ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মা’ছুম, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, সাবেক এমপি ড. হামিদুর রহমান আযাদ, এড. এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, মাওলানা আবদুল হালিম, মাওলানা মোয়ায্যম হোসাইন হেলাল, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য আবদুর রব, সাইফুল আলম খান মিলন, অধ্যক্ষ শাহাবুদ্দিন, মোবারক হোসাইন, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমীর নূরুল ইসলাম বুলবুল, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তরের আমীর মোঃ সেলিম উদ্দিন, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ল’ইয়ার্স কাউন্সিলের সভাপতি এড. জসিমউদ্দীন সরকার, ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ, ঢাকা মহানগরী উত্তরের সেক্রেটারি ডা. রেজাইল করিম, শহীদ মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পুত্র মাসুদ সাঈদী, শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর পুত্র ব্যারিস্টার নাজিবুর রহমান মোমেন, শহীদ আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের পুত্র আলী আহমাদ মাবরুর, জনাব এটিএম আজহারুল ইসলামের পুত্র তাসনিম আজহার সুমন, শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লার পুত্র হাসান জামিল এবং এটিএম আজহারুল ইসলামের মামলার আইনজীবীগণ প্রমুখ।