ডাক্তার এসএম মামুন, রিদম ব্লাড সেন্টারের পরিচালক এবং রিদম বাংলাদেশের ট্রাস্টি। জুলাই আন্দোলনে রক্তের জোগান দিয়ে অনেক প্রাণ বাঁচিয়েছেন। তিনি বলেছেন সেই সময়ের ঘটনা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইবরাহীম খলিল।
দৈনিক সংগ্রাম : আপনার কঠিন সময়ে অর্থাৎ ১৯ জুলাই থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত রক্তের জোগান দিয়েছেন। কিভাবে আপানারা শুরু করলেন? সেই ঘটনা জানতে চাই।
ডাক্তার এসএম মামুন : ২০২৪ সালের ১৭ জুলাই থেকে অনেক রোগী পাচ্ছিলাম হাসপাতালগুলোতে। পরে আমরা যখন দেখলাম আহতের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে, তখন ১৮ তারিখ থেকে প্রথমে রিদমের যে এম্বুলেন্সে আমরা ৬ জন ডাক্তার প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার জন্য যা যা প্রয়োজন সেগুলো নিয়ে বের হই। আমরা দেখলাম রাস্তায় অনেক মানুষ আহত। তারা হাসপাতালে আসতে পারছে না। বিভিন্ন জায়গাতে বাধা দেওয়া হচ্ছে, অনেকে ভয় পাচ্ছে। এই ভাবনা থেকে ১৮ তারিখ থেকে চিকিৎসা দেওয়া শুরু করি রাস্তায়। স্পটে যারা আহত হয়েছিল স্পটেই আমরা চিকিৎসা দিতে লাগলাম। তবে যারা গুরুতর আহত ছিল, দেখলাম যে এম্বুলেন্সে চিকিৎসা দিয়ে কাভার করা যাবে না, তাদের আমরা হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছি।
দৈনিক সংগ্রাম : প্রথমে আপনারা কেন স্পটটায় শুরু করেন ?
ডাক্তার এসএম মামুন : আমরা ১৮ তারিখে শুরু করি বুয়েটের সামনে। পলাশির মোড়। ওইখানটাতে হামলা পাল্টা হামলা চলছিল এবং সেখানে বেশিরভাগই আহত ছিল। সেখানে ফাস্ট এইড দেই সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত। এরপর আমরা আসি সাইন্সল্যাবে। এরপর আরও কয়েকটি স্পট টাচ করে মিরপুর-১০ পর্যন্ত সেবা দেই। রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত আমরা কাজ করি। ১৯ জুলাই থেকে আমরা তিনটা গাড়ি নিয়ে বের হই। ওই দিন থেকে ৫০জনের মতো ডাক্তার যারা রিদমের সাথে সংযুক্ত; তাদের নিয়ে আমরা রোস্টার করি। যারা যার হাসাপাতালে ডিউটির বাইরে এক্সট্রা সময় দিবে। এর মধ্যে একটা সংখ্যা ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসা দিবে। পরবর্তীতে ডাক্তারের সংখ্যা বাড়তে থাকে। সবশেষ আড়াইশত ডাক্তার আমাদের রোস্টারে যুক্ত হন। সেখানে আরও অনেক স্বেচ্ছাসেবী ছিল নার্স ছিল, টেকনোলজিস্ট ছিল। ১৯ তারিখ আমি গুলশান এক নম্বরে ছিলাম। গুলশান থেকে বাড্ডা লিংক রোডে। সেখানে সকালেই দুজনকে গুলীবিদ্ধ পাই। একটা মেয়ে ছিল আরেকটা ছেলে ছিল। এদের গুলীটা পায়ে লেগেছিল। আমরা তাদের ফাস্ট এইড দিয়ে এম্বুলেন্সে করে এ এমজেড হাসপাতালে যাই। সেখানে নামানোর পর হাসপাতাল তাদের রিসিভ করে। হাসপাতালটি অ্যাক্টিভ ছিল। তখন আহত হলেই বলা হতো এএমজেডে যান। তারা আমাদের সাপোর্ট দিচ্ছে। এরপর বাড্ডাতে যে ঝামেলাটা হচ্ছিল। এরপর আমরা সেখানে অবস্থান করে ফাস্ট এইড দেওয়া শুরু করি। তখন আনুমাানিক এগারটা সাড়ে এগারোটা বাজে। তখন গুলি চলছে। একজনের মাথায় গুলী লাগলো, সাথে সাথে আমরা তাকে গিয়ে ধরলাম। তার মাথার মগজ আমরা হাতে গলে গলে পড়ছিল। মাথাটা ফাঁকা হয়ে পড়ছিল। একদম গলে গলে পড়ছিল। ছেলেটার নাম ছিল সোহাগ। তার বড়ি বাড্ডাতেই। আমরা ফাস্ট এইড দিয়ে এএমজেডে পাঠানোর পর তারা বললো যেহেতু বুলেট ইনজুরি তো আপনারা ওকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যান। আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল কয়েকজন ডাক্তার ফাস্ট এইড নিয়ে স্পটে অবস্থান করবো। আর বাকীরা ঢাকা মেডিকেলে যাবো। তবে পরিস্থিতিটা এমন ছিল যে গাড়ি ছাড়া ফাস্ট এইড নিয়ে কেউ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গাতে যাওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল। আমরা যখন সোহাগকে নিয়ে ঢামেকে আসি তখন এক দেড়টা বাজে। তখন আমাদের বিভিন্ন রোড ঘুরে আসতে হয়েছে। এখানে এসে দেখলাম সোহাগের অবস্থা খুব খারাপ ছিল। স্যালাইন চালু করে দেই। কিন্তু তার রক্তের দরকার ছিল। তখন সোহাগের চাচা ছিল আমাদের সাথে। ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম আপনার রক্তের গ্রুপ কি ? তিনি তা বলতে পারলেন না। তখন আমরা রিদমে স্টকে থাকা রক্ত দিচ্ছিলাম। ওই সময় ঢাকা মেডিকেলে যারা কাজ করছিল, তারা বললেন যে আরও অনেক রক্তের প্রয়োজন। অনেক মানুষ রক্ত না পেয়ে মারা যাচ্ছে। আমার কথা হচ্ছে কোন একজনের পায়ে গুলি লেগেছে। তার যে পরিমাণ রক্ত ক্ষরণ হয়েছে, সময় মতো যদি রক্ত ক্ষরণ বন্ধ করে দেওয়া যেত; প্রয়োজনীয় স্যালাইন এবং রক্ত দেওয়া যেত তাহলে তাকে বাচানো যেতো।
দৈনিক সংগ্রাম : ১৯ তারিখেই এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে ?
ডাক্তার এসএম মামুন : জি¦ ১৯ তারিখেই। তখন আমাদের মধ্য থেকে ঢাকা মেডিকেলের পরিচালকের সাথে কথা বললেন। আমরা বললাম স্যার আমরা এখানে ব্লাড কালেকশন এবং ইন্সস্ট্যান্ড ডেলিভারি দিতে চাই। তিনি বললেন যে ঠিক আছে। ঢাকা মেডিকেলের সন্ধ্যানিকেও আহ্বান জানালাম। তারাও আমাদের সাথে ছিল। আমরা ১৯ তারিখ ঢাকা মেডিকেলের সামনের খালি জায়গাটায় ব্লাড ডোনেশন শুরু করি। তখন মানুষ সিরিয়াল দিয়ে রক্ত দিচ্ছিল। বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী আমাদের সাথে এসে যোগ দেয়। অনেক সাধারণ মানুষ এসে যোগ দেয় যে আমরা কিভাবে সহযোগিতা করতে পারি ? ওরা চিৎকার করে করে বলছিল যে ব্লাড লাগবে ব্লাড লাগবে। আপনারা রক্ত দেন। মানুষ সিরিয়াল দিয়ে রক্ত দিচ্ছি। আমরা আসলে নিতে পারছিলাম না। চাহিদাও ছিল। সমস্যা ছিল যাদের রক্ত লাগছিল তাদের আত্মীয় স্বজন সাথে নাই। অনেক সময় চলে যাচ্ছে রোগী অজ্ঞান থাকা অবস্থায়। রক্তের গ্রুপ জানে না। আমরা তখন সাথে সাথে রক্ত গ্রুপিংয়ের জন্য আলাদা একটা টিম বসিয়ে দিলাম। তারা রক্ত লাগবে এমন এবং রক্ত দাতাদের রক্ত নিয়ে গ্রুপিং করছিল। ১৯ তারিখ সন্ধ্যা থেকে শেষ রাত পর্যন্ত ১৭০ ব্যাগ রক্ত কালেক্ট এবং ডোনেট করেছিলাম। সেদিন ৩৫ ব্যাগ রক্ত থেকে যায়। সেই রক্ত ঢামেকে ব্লাড ব্যাংককে দিয়ে দেই। পরের দিন থেকে আবার শুরু করি। পরদিন আরও বেশি হতাহত আসে। মাঝখানে একটু কম ছিল। ইন্টারনেট বন্ধ থাকা অবস্থায়। পরে আবার বৃদ্ধি পেলো। তো আমরা ১৯ তারিখ থেকে শুরু করে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছিলাম। ৫ আগস্ট কিন্তু আমাদের টিম ঢাকা মেডিকেলেই ছিল। তারা ব্লাড কালেক্ট করেছে। ৬ তারিখ সকাল পর্যন্ত আমরা সেখানেই সেবা দিয়েছি।
দৈনিক সংগ্রাম : ৫ তারিখ বিজয় মিছিলে অনেক গুলি চলেছে।
ডাক্তার এসএম মামুন : ৫ তারিখ সন্ধ্যার পর অনেক হতাহত বিভিন্ন মেডিকেলে এসেছে। এমনকি ৬ তারিখ দিনের বেলায় আমরা ঘোষণা দিয়েছি যে যাদের রক্ত লাগবে তারা যেন আমাদের রিদম থেকে এসে নিয়ে যান। ৬ তারিখ সকাল পর্যন্ত ৭শ’ ব্যাগ রক্ত আমার ম্যানেজ করি। এগুলো দিয়েছি কোনরকম টাকা ছাড়াই। এখনো পর্যন্ত যাদের রক্ত প্রয়োজন হয়. ঐারা জুলাই যোদ্ধা হাসপাতালে আছে, এখনো তারা রিদম থেকে এসে রক্ত নিয়ে যায়।
দৈনিক সংগ্রাম : এক্ষেত্রে প্রশাসনিক কোন বাধার সম্মুখীন হয়েছেন কি-না ?
ডাক্তার এসএম মামুন : আমরা কয়েকটা জায়গাতে বাধা প্রাপ্ত হয়েছি। আমরা যখন ফাস্ট এইড দিচ্ছিলাম। বিভিন্ন জায়গাতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, আপনারা কারা কোথায় থেকে এসেছেন ? আমরা বলেছি যে আমরা উভয় পক্ষকে দিয়েছি। এরপরও শাহবাগের কাছে আমাদের গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। এরা ছিল যুবলীগ ছাত্রলীগ। তখন আমি আহত হই। ফোন চেক করেছে অনেকগুলো স্পটে। উভয় পক্ষ চেক করেছে। আপনারা কারা ? ফোনটা দেখান। আন্দোলনকারীরাও এই বলে চেক করেছেন যে এম্বুলেন্সে করে এসে আমাদের ওপর হামলা করে চলে গেছে।
দৈনিক সংগ্রাম : সোহাগের গল্প বলছিলেন। সোহাগ কি বেঁচেছিল ?
ডাক্তার এসএম মামুন : সোহাগ বাঁচেনি। তাকে বাচানো যায়নি। যারা আমাদের সাথে কাজ করেছিল তাদের জন্য সবংর্ধনার আয়োজন করা হয়। আমরা আসলে এক সাথে ৬টা কাজ করেছি। প্রথমত রাস্তায় ফাস্ট এইড দিযেছি। দ্বিতীয়ত আহতদের হাসপাতালে নিয়েছি, তৃতীয়ত হাসপাতালে ব্লাডের ব্যবস্থা করেছি। চতুর্থত যারা কাজ করেছে তাদের বাসায় পৌছে দিয়েছি। ইমার্জেন্সি কোন কিছু শর্ট পড়লে তার ব্যবস্থা করেছি। আমরা বিভিন্ন মার্কেট মিটফোর্ড যা যেখানে পাওয়া গেছে তা কিনে এনেছি। একাজ গুলো আমরা একই সাখে করেছি। কারণ আমাদের বড় টিম ছিল। কেউ এটা করেছি, কেউ ওটা করেছি।
দৈনিক সংগ্রাম : কারফিউর সময়ে আপনারা কিভাবে কাজ করেছেন ?
ডাক্তার এসএম মামুন : তারপরও আমরা এম্বুলেন্সে জরুরী চিকিৎসা সেবার স্টিকার লাগিয়ে চেষ্টা করছিলাম যে মুভ করার জন্য।
দৈনিক সংগ্রাম : কি ধরণর অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল।
ডাক্তার এসএম মামুন : আসলে লেথেল ওয়েপন ছাড়া তো মাথার মগজ বের হওয়ার কথা না।
দৈনিক সংগ্রাম : জুলাই আন্দোলনে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করেছে রিদম ব্লাড সেন্টার। অনেক প্রাণ সেভ করেছে। ভবিষৎতে কি করতে চায় রিদম ব্লাড সেন্টার ?
ডাক্তার এসএম মামুন : রিদম ব্লাড সেন্টার স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান। এটা চিকিৎকদ্বারা পরিচালিত। এটি একটি ট্রাস্ট। রিদম বাংলাদেশ ট্রাস্ট। বাংলাদেশে একটি হেলদি জেনারেশন গড়ে তোলা আমাদের লক্ষ্য। প্রোডাক্টিভ জেনারেশন তৈরি করা। বাংলাদেশে ৯ থেকে ১১ লক্ষ্য ব্যাগ রক্তের ঘাটতি থাকে। একারনে প্রতি বছর প্রায় ৭০ হাজার মানুষ মারা যায়। এরমধ্যে বেশির ভাগ নারী এবং শিশু। কোন মানুষ যেন রক্তের অভাবে না মারা যায়। আমরা চেষ্টা করি হেলডি বডি থেকে রক্ত জোগার করি। দেশের মানুষ যদি ২ ভাগ মানুষ রক্ত দেয় তাহলেই ঘাটতি মোকাবেলা করা সম্ভব।